অভাব অসীম কিন্তু সম্পদ সসীম। এই দুষ্প্রাপ্যতা সত্ত্বেও আমরা প্রাকৃতিক সম্পদের (জ্বালানি) ওপর নির্ভরতা কমাতে পারিনি। ফলে প্রতিনিয়ত মহাসংকটের দিকে এগোচ্ছি। বলা হয়, সভ্যতার অগ্রগতির অন্যতম চাবিকাঠি জ্বালানি। সুতরাং জ্বালানি সংকট অনিবার্যভাবেই সভ্যতার অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।
জ্বালানি গ্যাস ও তেলের বিশ্ববাজার অত্যন্ত স্পর্শকাতর। ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত আগুনে ঘি ঢালার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় পড়ে রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ প্রথমে সীমিত এবং পরে পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। রুশ গ্যাস নির্ভর ইউরোপ মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিকল্প হিসেবে এলএনজির আমদানি বাড়ায়। চাহিদার সঙ্গে দামও বৃদ্ধি পায়; উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। হুন্ডির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসায় নিম্নগামী হচ্ছে রেমিট্যান্স। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমে ২৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। রির্জাভ কমে আসায় জ্বালানি আমদানি বেশ কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়েছে; যদিও সরকার এই রিজার্ভ সংকট মোকাবেলায় নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। কিন্তু তা কতটুকু কার্যকর হচ্ছে বা হবে সেটা পরিস্কার নয়। ইতোমধ্যেই জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ ও কল-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে দেশের অর্থনৈতিক খাতে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে।
জ্বালানি সংকটের কারণে ইউরোপ-এশিয়ার অনেক উন্নত দেশ বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লোডশেডিং হচ্ছে, বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধিতে জনমনে অসন্তুষ্টিও দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (আইইএ) প্রধান ফাতিহ বিরল বলেছেন যে গভীরতা ও জটিলতার দিক থেকে এত বড় জ্বালানি সংকট এর আগে বিশ্ব দেখেনি। এটি সারাবিশ্বকে ভোগাচ্ছে। ভুগছে বাংলাদেশ। ডলার সংকটের কারণে গত জুলাইয়ে খোলাবাজার থেকে তরলীকৃত গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বন্ধ করে সরকার। আর জ্বালানি তেল আমদানি কমাতে বন্ধ করা হয় ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় লোডশেডিং বেড়ে যায় সারাদেশে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় সরকার।
২০১৫ সালে থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথে দ্রুত হাঁটতে থাকে বাংলাদেশ, অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন অগ্রাহ্য করা হয় ৷ বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৫০ লাখ টন ডিজেল আমদানি করে। বিশ্লেষকরা বলছেন যে বাংলাদেশে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের সংকট উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং এ সংকট আরও বাড়তে পারে। জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, সরবরাহের চেইন বিশৃঙ্খলা, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, রেমিট্যান্স ও রিজার্ভ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ কঠিন অবস্থা অতিক্রম করছে। বিদ্যুৎ সংকট শিল্পখাতে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করায় রপ্তানিতেও ঋণাত্মক প্রভাব ফেলছে।
বস্তুত বিরাজমান জ্বালানি সংকটের জন্য অদূরদর্শী আমদানি নির্ভরতার নীতি যে বহুলাংশে দায়ী তা এখন স্পষ্ট। সম্ভবত ধরেই নেয়া হয়েছিল যে বিশ্ববাজার বরাবরই স্থিতিশীল থাকবে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও অটুট থাকবে। আর তাই আমদানিতে কোনো সমস্যা হবে না। তারপরও যখন সমস্যার আভাস মিলছিল, তখনো ‘সবকিছু ঠিক আছে’ নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। এখন যখন দ্রুত রিজার্ভ ক্ষয়ে যাচ্ছে স্বল্পমেয়াদি অথচ উচ্চ সুদের বেসরকারি ঋণ পরিশোধ করতে এবং আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়াতে, তখন সবকিছু আর ঠিক থাকছে না। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ উৎপাদনের দুটি প্রধান উৎস হচ্ছে কয়লা ও গ্যাস। কিন্তু জ্বালানি আমদানি নির্ভর হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে। সুতরাং এমন পরিস্থিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিকল্প উপায় খুঁজতে হবে। দ্রুত পরীক্ষা-নিরীক্ষ শেষে উৎপাদনে যেতে হবে। বিকল্প হতে পারে দেশের অভ্যন্তরে গ্যাসের অনুসন্ধান চালানো। ভূ-বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুসারে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যতটুকু গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে।
অন্যদিকে গ্যাস অনুসন্ধানের পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে জ্বালানি সংকট কাটিয়ে ওঠা যেতে পারে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হচ্ছে সৌরশক্তি, ভূ-তাপ, বায়ুপ্রবাহ, জলপ্রবাহ, সমুদ্রঢেউ, সমুদ্রতাপ, জোয়ার-ভাটা, বায়োগ্যাস, বায়োফুয়েল, আবর্জনা অন্যতম। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি ও বৈশ্বিক রাজনীতিবিদেরা জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য বায়ু ও সৌরশক্তি ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন করে অনেক দেশ সফল হয়েছে এবং তারা এখন সেদিকেই ঝুঁকছে। চীন শতাধিক কয়লাবিদ্যুৎ বন্ধ করে বায়ুবিদ্যুৎ ও প্রচুর সোলার প্ল্যান্ট কেন্দ্র চালু করে সফলতাও অর্জন করেছে। মরক্কো মরুভূমির বুকে বিশাল সোলার প্ল্যান্ট বসাতে সক্ষম হয়েছে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে বিদ্যুৎ রপ্তানির পরিকল্পনা করছে দেশটি। প্রতিবেশী ভারত বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সোলর প্ল্যান্ট স্থাপন করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন একটি সম্ভাবনা। বিশেষ করে উপকূলবর্তী এলাকায় অনবরত বায়ুপ্রবাহ থাকে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এ প্রবাহকে কাজে লাগাতে পারলে ২০০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হতে পারে বাংলাদেশ। হাতিয়া, সন্দ্বীপ, মহেশখালী, কতুবদিয়া ছাড়াও পদ্মা-মেঘনা-যুমনার চরে বায়ুকল স্থাপন করে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে। শুধু বায়ুপ্রবাহ নয়, সমুদ্রঢেউ, সমুদ্রের তাপ ও জোয়ার-ভাটার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার সম্ভব। ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ। বর্তমানে দেশে ৯টি সৌরশক্তি চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে, যাদের সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা ৪৫০ মেগাওয়াট। একটি বায়ু চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের কাজও চলছে, যেখান থেকে ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। এছাড়া ১২টি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি হচ্ছে, যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৫০০ মেগাওয়াট। আরও কয়েকটি বায়ু ও বায়োমাস বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কাজও চলছে, যাদের সম্মিলিত উৎপাদন সক্ষমতা ১৩০ মেগাওয়াট।
এতেই যথেষ্ট নয়, সংকট মোকাবেলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে আরও মনোনিবেশ করতে হবে। জ্বালানি সংকট দেশের অর্থনীতির সঙ্গে কৃষিখাতেও সরাসরি প্রভাব ফেলে। বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি, খাদ্য ঘাটতি বিশ্বকে মহাসংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে উন্নয়শীল দেশগুলো। সুতরাং নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং গ্যাস অনুসন্ধানই বাংলাদেশের জ্বালানি সংকট কাটিয়ে ওঠার সর্বোত্তম বিকল্প হতে পারে।
বাবু/জেএম