সোমবার ১৪ জুলাই ২০২৫ ৩০ আষাঢ় ১৪৩২
সোমবার ১৪ জুলাই ২০২৫
রেসকোর্সের বজ্রকণ্ঠ থেকেই বাংলাদেশ
এস.এম রাকিব সিরাজী
প্রকাশ: রবিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২২, ৮:৪৩ PM
গ্রেট ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বলেছেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরুক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারাবিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।’ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বৈষম্য-শোষণ থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষা এবং অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এই ত্রিমাত্রিক বৈশিষ্ট্যের মূলমন্ত্রকে তিনি সঞ্চারিত করেছিলেন প্রতিটি বাঙালির চেতনায়।

বাঙালিরা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দেশ শাসনে যতটা না উৎসুক ও উদগ্রীব ছিল তারচেয়েও বেশি আগ্রহী ও সংকল্পবদ্ধ ছিল স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে নিজেদের অধিষ্ঠিত করার জন্য। সঙ্গত কারণে এদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। কারণ ৭ মার্চের ভাষণের পিছনে রয়েছে দীর্ঘ আর্থ- সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত নামক দু'টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মাঝখানে ভারত নামক বিশাল রাষ্ট্র রেখে দু’[পাশের দু'টি অংশ নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের ফলে এক অদ্ভুত ভৌগোলিক অবস্থান তৈরি হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তান প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণমূলক মনোভাব অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রেই বাঙালিরা উপেক্ষিত হতে থাকে ( রহমান : ২০১৮)।

১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দু গ্রহণ করার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানের দু’টি অংশের মধ্যে প্রথম সংঘাতের সৃষ্টি হয়। শহীদ হয় রফিক, জব্বার, বরকত শফিউরসহ নাম না জানা আরো অনেকে। ভাষার জন্য রক্তদান বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম বাঙালিরাই সৃষ্টি করে। তবে বাঙালিরা আত্মসচেতন হয়ে ওঠেন। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত পূর্ব বাংলার আইনসভার নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। শাসনক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তানের নেতাবৃন্দের কাছে হস্তান্তর করতে টালবাহানা করে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা। শোষণ-শাসনের এই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা সামরিক শাসন জারি করেন। সামরিক শাসন জারির পর বঙ্গবন্ধুসহ বহু নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা উত্থাপনের মাধ্যমে পশ্চিমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় বাঙালির প্রাণের দাবি। যার লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন। ১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তদানীন্তন প্রধান সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচন ছিল অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম ও শেষ সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা (৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন) অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী বাঙালির কাক্সিক্ষত আওয়ামী লীগ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। মূলত তাদের উদ্দেশ্য ছিল যে কোনভাবে পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে। পাকিস্তানি সামরিক আমলা এবং শিল্পপতিদের চক্র বাঙালিদের ক্ষমতায় আসতে দিতে চান না। সাথে এটিও প্রমাণিত হল পশ্চিম পাকিস্তানের লোকজন বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দিতেও প্রস্তুত নয়।

১ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে সামরিক সরকার এ ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন। ক্ষোভে, প্রতিবাদে এবং ঘৃণায় ফেটে পড়ল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি। কেন্দ্রের শাসন উপেক্ষা করে তারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করে লাখো বাঙালি একসাথে সভা-সমাবেশ-মিছিল-মিটিং করা শুরু করল। অন্যদিকে বিদ্রোহ দমনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্লেন বোঝাই করে সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র এনে বাঙালি জাতিকে নিঃশেষ করার অপতৎপরতা চালানো শুরু করে।
কিন্তু জাতির ভাগ্যাকাশে শেখ মুজিবুর রহমান নামের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের উদয় ঘটেছিল, সেই মুজিব জীবিত থাকতে নিজ ভূমিতে বাঙালি জাতিকে পরাধীন করে রাখা অতোটা সহজ ছিল না। দীর্ঘ ২৩ বছরের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাঙালির করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা নিয়ে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এ মহান নেতা বাঙালির প্রাণের কথা, মনের কথা, বাঁচার কথা, মুক্তির কথা, স্বাধীনতার কথা, একটি লাল সবুজ পতাকার কথা এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের কথা বললেন।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অবিনশ্বর এবং অবিস্মরণীয়। এ ভাষণ পুর্বাহ্নে লেখা বা সম্পাদনা করা নয়। তা স্বতঃস্ফূর্ত হৃদয় থেকে উৎসারিত। প্রতিটি কথা স্পষ্ট ধ্বনিসুষমায় যেন শ্রেষ্ঠ ধ্রুপদী গানের দ্রুতলয়ের মেজাজ, যেন এক কণ্ঠে শত লোকবাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি, স্বজাত্যবোধের, ইতিহাসের, স্বাধীনতা-মুক্তির এক একটি বাণী শ্রোতামণ্ডলীর প্রাণে সেদিন স্পন্দন তুলেছিল। এই ভাষণটি ছিলো হাজার বছর লালিত অন্তরের অন্তঃস্থলে লেখা মুক্তির দলিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আবদুল খালেক লিখেছেন ‘দার্শনিক যারা তাঁরা এই ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে আবিষ্কার করেছেন একজন প্রখ্যাত দার্শনিক হিসেবে; সমাজবিজ্ঞানী যারা, তারা এই ভাষণের ব্যাখ্যা করে বলতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন সমাজবিজ্ঞানী। কবি-সাহিত্যিক যারা, তারা বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা।’

যেকোনো ভাষণের প্রারম্ভিক অনুকল্প, শব্দভাণ্ডার, ধ্বনিব্যঞ্জনা এবং চিত্রশৈলীর উপর শ্রোতার মনোযোগ ধরে রাখতে পারা নির্ভর করে। জাতির জনকের যুগান্তকারী এ ভাষণে তিনি শ্রোতা সকলের দীর্ঘ ২৩ বছরের শাসন-শোষণ-নিপীড়ন-অত্যাচার সহ্য করে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বাঙালির মানসিক অবস্থা এবং স্বাধীনতার প্রতি তীব্র আকাক্সক্ষা অনুধাবন করে শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ শুরু করেন। এ ভাষণে বারংবার ‘মুক্তি’ শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির সনদ রচনা করছেন। জাতির জনকের এই মহাকাব্য গোটা জাতিকে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় উন্মাতাল করে তোলে। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ৭ মার্চের ভাষণে। কঠিনের সাথে কোমলতার এমন মহান সহাবস্থান বিশ্বের অন্য কোনো নেতার ভাষণে বিরল। ভাষণের এক পর্যায়ে শেখ মুজিব বলেন, ‘আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো।’ এটি শত্রুর অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে স্পষ্ট সশস্ত্র সংগ্রামের ঘোষণা হলেও পরক্ষণেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সৈন্যদের আশ্বাস দিয়ে তাদের উদ্দেশ্য করে বাঙালির প্রাণের এ মহান নেতা বলেন ..... ‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাক, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালানোর চেষ্টা করো না... সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।’

নিজ দেশকে মুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয়ের নিয়ে সশস্ত্র-সংগ্রাম ঘোষণার চরম সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও শেখ মুজিব শুধু বাঙালির কথা ভাবেননি, নির্বিশেষে আপামর পাকিস্তানের জনগনের কল্যাণের কথা ভেবেছেন। ৭ মার্চের এই অমর কাব্য বাঙালির জাতীয় জীবনে কতটা মাহাত্ম্যপূর্ণ তা অনুধাবন করা যায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উন্নয়নের গণতন্ত্রের পথে গুটি গুটি পথচলায়। ভাষণের মাঝামাঝি এসে পিতা বলেন, ‘তাকে বলেছিলাম, জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপরে গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। কী করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন।’ দেশের মানুষের প্রতি শেখ মুজিবের এ স্বজাত্যবোধ যেনো ছিল আত্মার। ঠিক তেমনি জাতির পিতার সেই মৃত্যুঞ্জয়ী আদর্শ আজও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ধমনীতে-শিরা-উপশিরায় প্রবাহমান।

পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন এ ভাষণ নিপীড়িত, লাঞ্চিত স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের প্রেরণা ও উদ্দীপনার উৎস হিসেবে কাজ করবে। এ ভাষণ যুগ যুগ ধরে বাঙালি জাতিকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় উজ্জীবিত রাখবে, আমৃত্যু জাতির জন্য এটি একইসাথে হয়ে থাকবে জীবনবোধের এবং অর্থনীতির এবং রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা। রেসকোর্সরে সেই বজ্রকণ্ঠ থেকেই আজকের বাংলাদেশ।

বাবু/জেএম

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত