বেকারত্ব বলতে সাধারণভাবে কর্মক্ষম মানুষের কর্মহীনতাকে বোঝায়। একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমার আওতাভুক্ত ব্যক্তির কাজের ইচ্ছা, উপযুক্ত সামর্থ্য ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যদি সে কোনো উপার্জনমূলক কর্মসংস্থান করতে ব্যর্থ হয় তবে সে বেকার। বেকারের কর্মহীন পরিস্থিতিকে ‘বেকারত্ব’ বলে ধরা হয়।
মোটকথা বেকারত্ব হলো, একটি পরিস্থিতি কিংবা অবস্থা। যার সঙ্গে কর্মক্ষম মানুষের কর্মহীন অবস্থার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বেকারত্ব এমন এক অবস্থা যেখানে যোগ্যতা ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তি কর্ম লাভে ব্যর্থ হয়। বেকারত্বের প্রকৃতি অনুসারে একে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হচ্ছে ১. ক্ষণস্থায়ী বেকারত্ব ২. প্রযুক্তিগত বেকারত্ব ৩. মৌসুমি বেকারত্ব ৪. জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বাণিজ্য চক্রজনিত বেকারত্ব ৫. ব্যক্তিগত চরম বেকারত্ব ৬. স্থানগত বেকারত্ব।
নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিষ্ঠিত মদিনা রাষ্ট্রেও বেকারত্ব ছিল। ইতিহাস পাঠে এটাও জানা যায়, মদিনায় বেকারত্বের কারণ ছিল বহুবিধ। যেমন কর্মের সীমিত সুযোগ, শিল্পের বিকাশ না হওয়া, কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি, দারিদ্র্য, কুটির শিল্পের দুর্বল অবস্থা, বিনিয়োগে ত্রুটি পূর্ণতা, মূলধনের অভাব, নিরাপদ অভিবাসনের সমস্যা, শ্রমজীবীদের গতিশীলতার অভাব, অলসতা ও শ্রম বিমুখতা, বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতা প্রভৃতি। এসব কারণে সদ্য বিকশিত ইসলামি রাষ্ট্রে বেকারত্ব একটি অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বেকার সমস্যা মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নেন এবং সে অনুযায়ী কর্মপন্থা গ্রহণ করেন।
বেকারত্ব দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নবী কারিম (সা.) পদক্ষেপ গ্রহণ করে প্রথমে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছেন। কারণ এর সঙ্গে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা জড়িত। কঠোর সাধনা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে মানুষ বেকারত্ব দূর করবে, নিজেদের পরিশ্রমী ও আত্মপ্রত্যয়ী বানাবে ইসলামের চাওয়া এটা। কোরআনে কারিম এবং হজরত রাসুলুল্লাহ সা.-এর শিক্ষা, দেখানো কর্মপন্থা ও অনুপ্রেরণা অনুযায়ী এ উপায়কে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো
>>উপার্জনের নীতি
কোনো অবস্থাতেই বেকার থাকা যাবে না। কোরআনে কারিমে, ‘প্রত্যেক নামাজিকে আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করতে আদেশ করা হয়েছে।’ সুরা জুমআ : ১৩
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিজ হাতে উপার্জনকারী আল্লাহর বন্ধু, যে চেষ্টা করবে রিজিকের সন্ধানে জমিনে ছড়িয়ে পড়বে সে রিজিক পাওয়ার যোগ্য আর যে অলস ভঙ্গিতে বসে থাকে, সে বঞ্চিত হওয়ারই যোগ্য।’
>>কাজ করার নীতি
ইসলামে কাজকে পুণ্য এবং অলসতাকে পাপ গণ্য করা হয়েছে। কোরআনে কারিমে নবী কারিম (সা.) কে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, ‘আর আপনি বলে দিন, তোমরা কাজ করে যাও। আল্লাহ তোমাদের কাজ দেখবেন আর দেখবেন রাসুল ও মুমিনরা।’ সুরা তাওবা : ১০৫
হজরত দাউদ (আ.) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, হে আল্লাহ! নিজের হাতে কামাই করার জন্য আমাকে রোজগারের একটি পথ খুলে দাও। আল্লাহতায়ালা তার প্রার্থনা কবুল করলেন, কঠিন লোহাকে মোমের মতো নরম করে দিলেন যাতে করে তিনি যুদ্ধাস্ত্র ইত্যাদি লোহা উদগত পণ্য তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতে পারেন। সহিহ্ বোখারি
নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘শ্রমজীবীরা আল্লাহর বন্ধু।’ ইসলামে বৈরাগ্যবাদ, সন্ন্যাসবাদ এবং ব্রহ্মচর্চাকে নিন্দা করা হয়েছে। যারা জীবিকা অর্জনের জন্য কোনো কাজ না করে সব সময় শুধু ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকে, তাদের যারা খাদ্য পানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী জোগান দেয় তারা প্রথমোক্তদের চেয়ে উত্তম বলে নবী কারিম (সা.) স্বয়ং বর্ণনা করেছেন। সুনানে তিরমিজি
>>কৃষিকাজের মাধ্যমে উপার্জন
কৃষিকাজের জন্য কোরআনে কারিমে সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও উৎসাহব্যঞ্জক বাণী রয়েছে। একে আল্লাহতায়ালা নিজ অনুগ্রহে সহজ করে দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মানুষকে দেওয়া তার অকৃপণ অনুগ্রহ ও উপকরণগুলো উল্লেখ প্রসঙ্গে কৃষিকাজের মাধ্যমে জীবিকা অর্জনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। কোরআন বলছে, ‘তিনিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন। তা দিয়ে আমরা সব ধরনের উদ্ভিদ উদগত করি। সেখান থেকে আমরা সবুজ পাতা বের করে আনি। উৎপন্ন করি ঘন নিবিড় শস্যদানা। খেজুর গাছের মাথা থেকে বের করে আনি ঝুলন্ত কাঁদি। উৎপন্ন করি নানান ধরনের আঙুরের বাগান, জাইতুন ও আনার। লক্ষ করে দেখো এইসব ফলের প্রতি যখন তা ফলবান হয় এবং যখন তা পাকে। যারা ইমান রাখে তাদের জন্য এতে রয়েছে অনেক নিদর্শন।’ সুরা আনআম : ৯৯
নবী কারিম (সা.) বেকারত্ব দূরীকরণের জন্য কৃষিকাজের ওপর জোর দিয়েছেন।
>>শিল্প ও অন্যান্য পেশা
ইসলাম শিল্পের মাধ্যমে জীবিকা অর্জনের প্রতিও গুরুত্বারোপ করেছে। এ প্রসঙ্গে ডক্টর ইউসুফ আল কারজাভি লিখেছেন, ‘মুসলমানদের অবশ্যই এমন সব শিল্প পেশা এবং দক্ষতার বিকাশ ঘটাতে হবে যা সমাজের জন্য অপরিহার্য। একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী জাতি গঠনের জন্য সহায়ক এবং একটি দেশের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য অনুকূল।’
বেকারত্ব দূরীকরণে নবী কারিম (সা.) শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তার শাসনামলে নগরায়ণ ও শহরে কারুশিল্প ও শিল্পায়ন শুরু হয় এবং এর ফলে কৃষিপণ্য পৌঁছে যায় বিভিন্ন স্তরে। পেশাগত সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং বেকারত্বের অভিশাপ কাটিয়ে মদিনা রাষ্ট্রের নাগরিকরা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের মাধ্যমে জীবিকা অর্জনে আত্মনিয়োগ করে।
>>স্বনির্ভরশীলতার নীতি
কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন না করে।’ -সুরা রাদ : ১১
এই নির্দেশনার অর্থনৈতিক তাৎপর্য হলো, ইসলামি অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কাউকে ততক্ষণ পর্যন্ত সাহায্য করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া উচিত হবে না, যতক্ষণ না তারা নিজেরাই তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের উদ্দেশে কঠোর শ্রম দিতে এগিয়ে না আসবে। অন্য কথায়, ইসলাম এমন সমাজের কল্পনা করে; যেখানে কেউ কারও ওপর নির্ভরশীল নয়। প্রতিটি মানুষের সুপ্ত সম্ভাবনার পূর্ণ ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার ওপর ইসলাম সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে।
ইসলামে মুদারাবার মতো স্ব-নিয়োজিত কর্মোদ্যোগকে উৎসাহিত করা হয়েছে। এজন্য জাকাতের অর্থও দরিদ্রদের ক্ষণিকের প্রয়োজন পূরণে ব্যয়ের চেয়ে তারা যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে তেমনভাবে ব্যবহারের ওপর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সব সক্ষম সবল মানুষ বেকার না থেকে বৈধ উপায়ে পরিশ্রম করে তাদের জীবিকা অর্জনের চেষ্টা করবে এটাই ইসলামের দাবি। পৃথিবীতে মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা রয়েছে এবং তা পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা ছাড়া মানুষ অর্জন করতে পারে না। আল্লাহর লিখিত নির্দেশ হচ্ছে জীবিকা। মানুষকে উপার্জন করতে হবে এজন্য মানুষকে শ্রম দিতে হবে।
>>প্রবাসে উপার্জনের নীতি
বেকারত্ব দূরীকরণে কর্মসংস্থানের জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে ইসলামে। নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘প্রবাসে যাও, ধনী হতে পারবে।’ তাবারানি, আওসাত
এক হাদিসের ভাষ্য এমন যে, ‘আল্লাহর রাসুল (সা.) মদিনায় এক লোকের সমাধিতে দাঁড়িয়ে বললেন, আহ এই (হতভাগ্য) লোকের মৃত্যু যদি প্রবাসে হতো।’ সহিহ্ বোখারি
কোনো বৈধ উদ্দেশে পর্যটন, ভ্রমণ, চাকরি কিংবা রোজগারের জন্য প্রবাসী হওয়ার অথবা প্রবাস জীবনযাপনকারীদের জন্য এর চেয়ে বেশি উৎসাহ দানের দৃষ্টান্ত আর কী আছে? এসব হাদিসের অনুপ্রেরণায় হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগেই মুসলমানরা পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছিলেন। সেখানে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরির পাশাপাশি দ্বীন প্রচার করেছেন। ইতিহাসে এ বিষয়ে বিস্তর আলোচনা রয়েছে।
>>ব্যবসা-বাণিজ্য
পবিত্র কোরআন-হাদিসে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে সম্পদ উপার্জনের প্রতিও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কোরআন মজিদে ব্যবসা-বাণিজ্য বোঝাতে ‘বাই’ ও ‘তিজারত’ পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। ইসলামে ব্যবসা ও ব্যবসায়ীদের মর্যাদা অনেক ওপরে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হে উম্মতরা! তোমরা ব্যবসা করো। কেননা রিজিকের দশ ভাগের মধ্যে নয় ভাগই ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে। সত্যবাদী, ন্যায়পন্থী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়ায় অবস্থান করবেন।’
>>চাকরি
সম্পদ অর্জনের আরেকটি উপায় হচ্ছে চাকরি। চাকরি পেলেও বেকারত্ব দূর হয়। যারা চাকরি করে উপার্জন করেন ইসলামে তাদের ন্যায্য বেতনের নিশ্চয়তা বিধান করা, সুবিচারপূর্ণ বেতন পদ্ধতির আওতায় মৌলিক প্রয়োজন, অতিরিক্ত সুযোগ, পারস্পরিক সমঝোতা ইত্যাদি বিবেচনার দাবি রাখে। ইসলামি অর্থনীতিতে যথারীতি বেতনের ওপর যে কতটুকু গুরুত্বারোপ করা হয়েছে তা একটি হাদিস থেকে জানা যায়। নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘শেষ বিচারের দিন আমি তিন প্রকার ব্যক্তির বিপক্ষে অবস্থান নেবে ১. যে ব্যক্তি আমার নামে প্রতিজ্ঞা করে অথচ অবিশ্বাসীর মতো কর্ম করে, ২. যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে সেই অর্থ নিজে গ্রহণ করে ও ৩. যে ব্যক্তি যেকোনো লোককে কাজে নিয়োগ করে তার কাছ থেকে পূর্ণ কাজ আদায় করে বটে কিন্তু ঠিকমতো বেতন দেয় না।’ সহিহ্ বোখারি
>>দুর্বলদের স্বার্থ সংরক্ষণ
বেকারত্ব দূরীকরণে নবী কারিম (সা.)-এর অন্যতম অবদান হচ্ছে, দুর্বল বঞ্চিত নির্যাতিতদের অবস্থার উন্নয়ন সাধন। গরিব, অসহায়, বিত্তহীন নিম্ন আয়ের মানুষের আর্থিক উন্নতি ও আত্মকর্মসংস্থানের জন্য তিনি অত্যন্ত মনোযোগী হন। নবী কারিম (সা.) এটি করেছেন নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার, সামাজিক সংহতি ও সবার কল্যাণ নিশ্চিতের মাধ্যমে।
>>ভিক্ষাবৃত্তি নয়
আল্লাহর রাসুল (সা.) ভিক্ষাবৃত্তির পরিবর্তে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে একজন আনসারি এসে কিছু ভিক্ষা চাইলে তিনি ওই আনসারিকে জিজ্ঞাসা করেন, তোমার ঘরে কি কোনো জিনিস নেই? আনসারি জবাব দিল, একখণ্ড কাপড় ও পানি রাখার একটি জগ আছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) তা নিয়ে আসার জন্য বলেন। আনসারি দুটি জিনিস রাসুলের কাছে আনার পর তিনি সাহাবিদের মধ্যে ঘোষণা করেন, তোমাদের মধ্যে কে এই জিনিস ক্রয় করতে ইচ্ছুক। একজন সাহাবি আগ্রহ প্রকাশ করলেন এবং এক দিরহাম দেওয়ার কথা জানালেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) জানতে চাইলেন এর চেয়ে বেশি দেওয়ার মতো কেউ আছে কি না। আরেকজন সাহাবি দুই দিরহাম দেওয়ার কথা জানালে উক্ত জিনিসটি তাকে দেওয়া হয়। এক দিরহাম দিয়ে খাবার অন্য দিরহাম দিয়ে কুঠার কিনে তার কাছে আনতে বললেন। তিনি নিজ হাতে আনসারিকে কুঠার কিনে দিলেন এবং হাতল লাগিয়ে দিলেন এবং বললেন, আজ থেকে বনাঞ্চলে গিয়ে কাঠ কেটে এনে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাবে এবং ১৫ দিন পর এর অগ্রগতি জানাবে। বর্ণিত ঘটনা থেকে বুঝা যায়, রাসুল (সা.) বেকারদের ভিক্ষার পরিবর্তে আত্মকর্মসংস্থান ও ব্যবসার প্রতি উৎসাহিত করেছেন।
-বাবু/এ.এস