মঙ্গলবার ১৫ জুলাই ২০২৫ ৩১ আষাঢ় ১৪৩২
মঙ্গলবার ১৫ জুলাই ২০২৫
মৃত্যুকূপে পরিণত হচ্ছে নগরী
প্রদীপ সাহা
প্রকাশ: বুধবার, ২২ মার্চ, ২০২৩, ৪:৪১ PM

গত ৫ মার্চ ২০২৩ সায়েন্সল্যাব এলাকায় তিনতলার একটি ভবনে গ্যাস বিস্ফোরণে মারা যায় ৩ জন এবং আহত হয় কমপক্ষে ১৫ জন। এর মাত্র দুইদিন পর অর্থাৎ গত ৭ মার্চ ২০২৩ বিকেল পৌনে পাঁচটায় গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে কুইন স্যানিটারি মার্কেটের সাততলা ভবনেও ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বলা হচ্ছে, ভবনটির আবদ্ধ স্থানে জমে থাকা গ্যাস থেকে এ বিস্ফোরণ হয়েছে। দুর্ঘটনায় ভবনটির বেজমেন্ট, নিচতলা ও দোতলা অনেকটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এ পর্যন্ত মারা গেছে ২২ জন এবং আহত শতাধিক। হাসপাতালে ভর্তি আছে ৩১ জন। দু’পাশে লাগোয়া দু’টি ভবনেরও কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিস্ফোরণে ধসে পড়েছে দোতলার একটি অংশ। বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেজমেন্ট ও নিচতলা। সামনের সড়কে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে অসংখ্য মানুষ। এদের অধিকাংশই সাধারণ পথচারী বা যাত্রী। বিস্ফোরণের পর দেখা যায়, বিধ্বস্ত ভবনের নিচতলায় কলাপসিবল গেট বিচ্ছিন্ন হয়ে সড়কে পড়ে আছে। দেয়ালের ইট-কাচসহ নানা সামগ্রী ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে সড়কে। সঙ্গে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে আছে মোটরসাইকেল, রিকশা, ভ্যান। সিদ্দিকবাজারের মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের বারবার কাঁদিয়ে তোলে। স্বজনরা এক উৎকণ্ঠার মধ্যে সময় কাটাচ্ছেন।

মাত্র দু’দিনের ব্যবধানে ঢাকায় দু’টি বিস্ফোরণের ঘটনায় বিষয়টিকে সন্দেহের চোখে দেখছে অনেকেই। পুলিশ, র‌্যাব, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাসহ ফায়ার সার্ভিসও এ বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধান করে। কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘ভবনের বেজমেন্টের বদ্ধ কোনো কক্ষে গ্যাস জমে সেটি গ্যাসচেম্বারে পরিণত হয়েছিল। সেখানে যেকোনো উপায়ে স্পার্কের কারণে বিস্ফোরণ ঘটেছে।’ র‌্যাবের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল বলেছেন, ‘এ বিস্ফোরণ গ্যাসলাইনের ছিদ্র বা অন্য কোনো কারণে ঘটতে পারে। তবে বিস্ফোরণের মাত্রাটি ছিল অনেক বেশি। অন্য কোনো কারণ থেকেও এটি হতে পারে।’ বিস্ফোরণের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে প্রায় একই কথা বলেছেন ফায়ার সার্ভিসও। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানীর পয়োনিষ্কাশন ও গ্যাসের লাইনগুলো অনেক ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পুরানো লাইনগুলো ক্ষয় হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া নিয়মনীতি না মেনে ভবন নির্মাণ, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিকের মজুদ ও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে এ নগরী অনেকটা মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে।

বিস্ফোরণের ফলে ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় হওয়ায় উদ্ধার অভিযান চালাতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হয় উদ্ধারকর্মীদের। বিস্ফোরণে যখন কোনো ভবনের বিম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে। হিসেব করে দেখতে হয় ভবনের ওজন। ব্যবহার করতে হয় শোরিং যন্ত্র (ঠেক দেওয়ার জন্য)। কিন্তু ওই ধরনের কোনো যন্ত্র না থাকায় এবং সমন্বয়হীনতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধার অভিযান চালিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য বেশ কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা হয়। ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বাড়ানো হয়। কিন্তু রানা প্লাজা ধসের দশ বছর পরেও একটি শোরিং যন্ত্র এখনো কেন কেনা হয়নি, তা সত্যিই বিস্ময়কর।

সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, গত ৪ মার্চ ২০২৩ সকালে গুলশানের নিকেতনে এক বাসায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১ জন নিহত এবং আরেকজন গুরুতর দগ্ধ হন। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে এসি বিস্ফোরণ হয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ রাতে রাজধানীতে গুলশান-২ নম্বরের একটি ১৪তলা ভবনের ১০তলায় আগুন লাগে। এতে ২ জন নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে এ আগুনের সুত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে মনে করে ফায়ার সার্ভিস। অভিজ্ঞমহল মনে করেন, গুলশানের মতো রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। দেখা যায়, ২০২১ সালের ২৭ জুন মগবাজারের একটি ভবনে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণে ১২ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরনো ঢাকায় চুড়িহাট্টায় রাসায়নিক বিস্ফোরণে ৭১ জনের মৃত্যু হয়। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন মানুষ মারা যান। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবন নির্মাণের নানা ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতির সঙ্গে গ্যাসলাইনের ছিদ্র বা পয়োনালা থেকে সৃষ্ট গ্যাস নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে। তাছাড়া শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে। শহরজুড়েই ত্রুটি আছে। কিন্তু শহরকে তো পরিত্যক্ত ঘোষণা করার উপায় নেইÑ একে সারিয়ে তুলতে হবে।

বাসা-বাড়ি, অফিস ও মার্কেটের ভবনগুলোর পানির ট্যাংক এবং সেপটিক ট্যাংক নিয়মিত পরিষ্কার না করায় সেগুলোতে বিপজ্জনক পরিমাণে গ্যাস জমে থাকে। ওই জমে থাকা গ্যাস থেকেই ঘটছে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। গত কয়েক বছরে রাজধানীর পল্লবী, মিরপুর, কামরাঙ্গীচর, বংশালসহ বিভিন্ন এলাকায় ভবনের ট্যাংকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানির ট্যাংক এবং সেপটিক ট্যাংক নিয়মিত পরিষ্কার না করলে তাতে নানা ধরনের টক্সিক গ্যাস জমা হয়। ঢাকনা বদ্ধ থাকায় সেপটিক ট্যাংকের ভেতর অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন সালফাইড, সালফার ডাই-অক্সাইডসহ সালফারের অন্যান্য গ্যাস, মিথেন এমনকি বিষাক্ত কার্বন মোনোক্সাইড তৈরি হতে পারে। আর পানির ট্যাংকের ঢাকনা বদ্ধ থাকায় তার ভেতরে মিথেন, অ্যামোনিয়া, ক্লোরিন, হাইড্রোজেন গ্যাস জমা হতে পারে। আর সেটা দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার ফলে এসব গ্যাস ক্রমশ ঘন হতে থাকে। এরপর তা বিস্ফোরিত হয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

ঢাকা ও চট্টগ্রামে গ্যাস জমা এবং বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে সাধারণত অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণগুলো হয়েছে। তবে ঠিক কোন কারণে এ গ্যাস জমল এবং শর্টসার্কিট হলো, তা প্রাথমিক তদন্তে এখনো জানা যায়নি। সবগুলো দুর্ঘটনার ভবন রক্ষণাবেক্ষণে মালিকপক্ষ ও তদারকি কর্তৃপক্ষের ঘাটতি-অবহেলা এবং কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহারকারী বা বাসিন্দাদের অসচেতনতা ছিল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গ্যাসের পাইপলাইনের ছিদ্র, পানির ট্যাংক বা সুয়্যারেজ লাইনে জমে থাকা গ্যাস, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট কিংবা এসি বিস্ফোরণ থেকে এসব দুর্ঘটনা ঘটে। বিশেষজ্ঞরা বলছেনÑ অপরিকল্পিত নগরায়ন, ভবন নির্মাণে আইন বা নীতিমালা না মানা, নিম্নমানের সরঞ্জাম ব্যবহার, ভবন এবং বিদ্যুৎ-গ্যাস-সুয়্যারেজ লাইন রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় যত্ন এবং তদারকি না থাকার কারণে এ ধরনের দুর্ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। তাই এখনই গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, বিস্ফোরক, নগরব্যবস্থাপনা ও কলকারখানা পরিদর্শনে নিয়োজিত সংস্থাগুলো কঠোর তদারকি শুরু না করলে এবং ভবন মালিক ও ব্যবহারকারীরা সচেতন না হলে আগামীতে এমন দুর্ঘটনা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা যেন এ নগরীকে মৃত্যুকূপ হিসেবে না দেখি। আর যেন কোনো লোমহর্ষক মৃত্যু আমাদের দেখতে না হয়। আমাদের সামান্য সচেতনতাই এ দুর্ঘটনা রোধ করতে পারে।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

-বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত