শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫ ২৮ আষাঢ় ১৪৩২
শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫
মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি এবং স্বাধীনতা
ডা. মো.শহীদুল্লাহ সিকদার
প্রকাশ: শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০২৩, ৫:৪০ PM আপডেট: ২৫.০৩.২০২৩ ৫:৫৪ PM

হাজার বছরের বঞ্চিত বাঙালি স্বাধীনতার স্বপ্নে দীর্ঘ সময় অনেক চড়াই-উৎরাই পেড়িয়ে ১৯৭০ এর নির্বাচনের পরে জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সেই অ আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পরে, যেখানে ‘জয় বাংলা’ ছিল নিয়ামক স্লোগান। যেই স্লোগানের মাধ্যমে বাংলাদেশ একাত্তরে স্বাধীনতা লাভ করে, বাংলাদেশ নামের নতুন দেশ বিশ্বে আবির্ভূত হয়। দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশের শ্রমিক-কৃষক, খেটে-খাওয়া মানুষ, কামার-কুমার, তাতি-জেলে, গৃহবধূ, ছাত্র-শিক্ষক, জনতা তাদের সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহ্যের ধারায় পুষ্ট বাঙালির একটি নিজস্ব ভূখণ্ডের সন্ধানে আন্দোলন করেছে বৃটিশদের বিরুদ্ধে, আন্দোলন করেছে পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে, আন্দোলন করেছে মঙ্গোলিয়ান্দের বিরুদ্ধে, আন্দোলন করেছে মধ্য এশিয়ানদের বিরুদ্ধে, পার্শিয়ান্দের বিরুদ্ধে। ঠিক তেমনি এই ভূখণ্ডের যারা শাসক-শোষক, দালাল, বিজাতীয়দের দোষর তাদের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্ন খণ্ড খণ্ড এবং সঙ্গবদ্ধ আন্দোলনের অনেক ইতিহাস এদেশের মানুষের রয়েছে। কিন্তু বাঙালি কখনও স্বাধীন দেশ লাভ করেনি।

জয় বাংলা হল সেই স্লোগান যেই স্লোগান কৃষকের জয়ের কথা বলেছে, যেই স্লোগান শ্রমিকের জয়ের কথা বলেছে, ছাত্রের জয়ের কথা বলেছে, যেই স্লোগান বলেছে এদেশের গৃহবধূর কথা, সাধারণ মানুষের জয়ের কথা। এই জয় শুধু সাংস্কৃতিক জয় নয়, এ জয় শুধু একটি স্লোগানের জয় নয়- এ জয় ছিল প্রকৃত অর্থে প্রতিটি মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় পরিপুষ্ট জয়ের আবেদন। আমাদের শিল্প-সাহিত্যের অগ্নিপুরুষ নজরুল এক সময় জয় বাংলা শব্দটি ব্যাবহার করেছিলেন বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়। প্রকৃত মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থেকে এই সাংস্কৃতিক বা জাতীয়তাবাদের যে জয় বাংলার স্লোগান সেটিকে বঙ্গবন্ধু প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে সাংগঠনিক কাঠামোয় নিয়ে এসে বাংলার তৎকালীন  সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিজয়ের সংগ্রামে গাঁথতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাঙালিরা পরাধীন থাকবে না, বাঙালি পরিজিত হবে না। বাঙালি বিজাতীয় দখলদারদেরকে পরাজিত করে জয়ী হবে, যে জয় সামগ্রিকভাবে প্রতিটি মানুষের জীবনের জয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

এক সময় ছিল এদেশের মানুষ প্রাণ ভরে বাংলায় সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা করতে পারত না। শুধু সাহিত্য-সংস্কৃতি নয়, বাঙালির বঞ্চনার পরিধি ছিল বিশাল এবং দুর্বিনীত তাই ঐতিহ্যগত চর্চার যে বঞ্চনা, এই বঞ্চনাই কিন্তু এক সময় বাঙালিকে শিখিয়েছে তাদের নিজেদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। ঘুরে দাঁড়াতে হবে কার উপর নির্ভর করে? কোন সে শক্তি? শক্তি হল সকল বাঙালির সম্মিলিত ঐক্যের শক্তি। এ শক্তির মূল প্রেরণা হল আমাদের চেতনা। সে চেতনার একটি মাত্র স্লোগান যেখানে দুটি মাত্র শব্দ ‘জয় বাংলা’ বাঙালির জয়, বাংলার জয়। বঞ্চনা থেকে বঞ্চিত মানুষের জয়, সর্বহারা মানুষের জয়। এ জয় সহজ ছিল না। এর জন্য দীর্ঘদিন থেকে বঙ্গবন্ধু যেমন আন্দলন সংগ্রাম করেছেন, তেমনিভাবে এদেশের সূর্যসেন, প্রীতিলতা, ইলা মিত্র, ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীন, চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাস বসু সহ অংখ্য বীর বাঙালি তাদের বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন, উৎসর্গ করেছেন জীবন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ বীর বাঙালি তাদের জীবন দানের মাধ্যমে দু-লক্ষ মা-বোন তাদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন। স্বাধীনতা শব্দটি বাঙালির অনেক দিনের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন। এ স্বপ্ন কত ত্যাগ এবং শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে সেটি জয় বাংলা শব্দটিকে আমরা যদি অনুধাবন করতে সক্ষম হই তাহলে সঠিকভাবে বুঝতে পারব। স্বাধীনতা মানেই জয় বাংলা। জয় বাংলা মানে প্রকৃত অর্থেই মানুষের জয়, বাংলার প্রকৃতির জয়, সংস্কৃতির জয়। জয় বাংলা শব্দটি এখনো জীবন্ত, কারন ৩০ লক্ষ শহীদ যে স্বপ্নকে সামনে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন সে জয়ের স্বাদ এখনও বাংলার মানুষ পুরোপুরি লাভ করতে পারে নাই। যেই জনপ্রিয় স্লোগান ৭০ এর নির্বাচনে বাঙালিকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করেছিল, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করার চেতনায় উজ্জীবিত করেছিল সেই জয় এখনও বাংলাদেশের মানুষ পুরোপুরি অর্জন করতে পারেনি। সময়ের বিবর্তনে মানুষের চাহিদার পরিবর্তন হবে, সেই চাহিদা পুরনের ক্ষেত্রে জয় বাংলা স্লোগান আমাদের জন্য একটি চলমান অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে কাজ করবে আমাদের ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে। সুতরাং এই জয় বাংলাই আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। এই জয় বাংলাই আমাদের স্বাধীনতাকে ধরে রাখবে এবং এই জয় বাংলা আমাদেরকে প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ এবং মুক্তির স্বাদ আস্বাদনে শক্তি যোগাবে।

বিশ্বের প্রায় একশো ষাটটি দেশে জাতীয় স্লোগান আছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, স্লোগান একটি জনগোষ্ঠীর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, দাবি-দাওয়া, চাহিদা পূরণ করতে ব্যবহৃত হয়।  তবে একটি স্লোগান যে একটি জাতি, একটি ভূখণ্ড, একটি দেশের জন্ম দিতে পারে তা ইতিহাসে বিরল। বাঙালির এক অবিনশ্বর, অক্ষয়, অমর শব্দগুচ্ছ যা কোটি প্রাণে নির্ভয় এক সাহস ও আত্ম বিশ্বাস যুগিয়েছিল, যে শব্দগুচ্ছের মর্ম অনুধাবনে কোটি বাঙালি জীবনকেও উৎসর্গ করে দেবার মত সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতেও প্রস্তুত ছিলেন তা ইতিহাসের সব চাইতে শক্তিশালী শব্দ যুগল ‘জয় বাংলা’। যা বাঙালির পরিচয় বহন করে বিশ্বদরবারে বাঙালিকে অকুতোভয় জাতি হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।

এই ভূখণ্ডের মানুষের একটি মাত্র স্লোগান যেটি ধারণ করে আমাদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শৃঙ্খল থেকে মুক্তি; নারী-পুরুষের বৈষম্য থেকে মুক্তি, সাম্প্রদায়িকতার সংকট থেকে মুক্তি, সাংস্কৃতিক ও পশ্চাৎপদতা থেকে মুক্তি, বিজাতীয় রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক শৃঙ্খল থেকে মুক্তির বাণী সেটিই হল অবিনশ্বর স্লোগান জয় বাংলা। জয় বাংলা শুধু রাজনৈতিক নেতার জয় নয়, যিনি ক্ষমতায় থাকবেন শুধু তার জয় নয়, যারা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন শুধু তাদের বিজয় নয়, এই জয় বাংলা কোনো নির্দিষ্ট ব্যাক্তি বা গোষ্ঠীর জয় নয়, এ জয় সকলের। যিনি নিঃস্ব, সর্বহারা অসহায় মানুষ মুক্তির আকাক্সক্ষায় মৃতপ্রায় জীবন নিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে বেঁচে ছিলেন এ জয় তাঁর।

এই দেশের মানুষ শুধু রাজনৈতিক ভাবে বঞ্চনার স্বীকার হয়নি। দ্বিজাতিত্বত্তের ভিত্তিতে ভারত উপমহাদেশ ভাগ হবার দরুন এই ভূখণ্ডের মানুষ পাকিস্তানি শাসকদের শাসন ব্যবস্থার জন্য বঞ্চনা শিকার হয়েছেন। কিন্তু বঞ্চনার এই সংকট, সামাজিক যে দুঃশাসন বা অপসংস্কৃতির যে দৈন্য তা শুধু আর্থিক দৈন্য নয় এখানে ধারণাগত  দৈন্যও ছিল।

জয় বাংলা সকলকে আশ্বস্ত করেছে যে, বাঙালির চেতনার এই শক্তি বাঙালিকে নিজস্ব যোগ্যতায় ঘুরে দাড়াতে বলিয়ান করবে। বাঙালিরাও অপরাপর বিশ্বের স্বাধীন দেশগুলোর মত নিজেদের ভাগ্য নিজেরা তৈরি করার সুযোগ পাবে, একটি পরিবর্তন আসবে। আর সেই পরিবর্তনটা আসবে জয় বাংলারই মাধ্যমে। জয় বাংলার শক্তি আমরা ’৬৯, ’৭০ এবং ’৭১ এ দেখেছি। জয় বাংলা স্লোগানের শক্তি যেন মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে ক্রমেই দূর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু জয় বাংলার শক্তিতো কমে যাবার কথা নয়। কাক্সিক্ষত জয়ের স্বাদ কি যুদ্ধের সময়ের স্বপ্ন দেখা সাড়ে ৭ কোটি মানুষ বা আজকের দিনের ১৭ কোটি মানুষ পেয়েছে?  সত্যিকারের জয়ের স্বাদ এখনও বাঙালি পায়নি। বিশ্বাস করি জয় বাংলা স্লোগানের আবেদন কমে যায়নি, শক্তিও কমেনি। তাহলে আজকের স্বাধীনতা দিবসে আমাদের কি অবস্থা, সাম্প্রদায়িকতার সংকট, দুর্নীতির সংকট, মূল্যবোধের সংকট, সততা ও ন্যায়ের সংকট আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা এখনও এমন অনেক সংকট কাটিয়ে উঠতে পারি নি কেন? যেটি ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদের এবং সম্ভ্রমহারা ২ লক্ষ মা-বোনের আরাধ্য ছিল, যেটি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল যে- বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার পরে স্বাবলম্বি হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবে, অপরাপর স্বাধীন সমৃদ্ধ জাতিসমূহের ন্যায়।

এই স্বপ্ন এবং বিশ্বাসের জায়গায় আজকের দিনে কোনো কারণে মনে হয় একটি হতাশা ভর করেছে। জয় বাংলার শক্তি যেন ক্রমেই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। জয় বাংলার শক্তি যদি ম্লান হয়ে যায় তবে তার যে আবেদন, যে স্বপ্ন, যে সংগ্রামী চেতনা যেটি তৎকালীন সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, সেই স্বপ্নের এবং ঐক্যের সম্ভাবনায় সংকট তৈরি হবে, যা কোনো অবস্থাতেই জাতি হিসেবে আমাদের কাম্য নয়। যদি তাই হয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে গোটা বাংলাদেশ আর বাঙালি জাতি। এখানে কোন দলমত, গোষ্ঠী, শ্রেণি-পেশা, নারী-পুরুষ, কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক-ছাত্র, ধনী-গরিবের প্রশ্ন থাকবে না সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে সমভাবে। বঞ্চিত হবে গোটা জাতি। সুতরাং জয় বাংলার যে আবেদন জয় বাংলার যে শক্তি এই শক্তিকে ম্লান হতে দেওয়া যাবে না। আজকে ২০২৩ সালে স্বাধীনতা দিবসে স্বাধীনতার ৫২ বছর পরে আমাদেরকে বারবার ফিরে যেতে হবে সেই জয় বাংলার উত্তাল আবেদনের কাছে।

জয় বাংলাকে যারা অন্যভাবে চিহ্নিত করতে চায় তাদেরকে মনে রাখতে হবে জয় বাংলা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ছিল না বা কোনো বিশেষ ধর্মেরও ছিল না জয় বাংলা গোটা বাঙালির স্লোগান, ঐক্যের স্লোগান, বাঙালির চিরায়ত আবেদনের স্লোগান, এই স্লোগানই আমাদের প্রকৃত ঠিকানা। এই ঠিকানায়ই আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। যে ঠিকানার মাধ্যমে আমরা আজকের ২০২৩ সালে ১৭ কোটি মানুষ এ বিশ্বদরবারে  স্বাধীন বাংলাদেশকে প্রকৃত অর্থেই সৎ দেশপ্রেমিক, মানবিক, উন্নত-সমৃদ্ধ বাঙালি জাতি হিসেবে তৈরি করতে সক্ষম হব। এই স্লোগানের আবেদন অম্লান এবং এর চর্চা সব সময়ে একই গতিতে নিরন্তর চলমান রাখতে হবে।

লেখক : সাবেক উপ-উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

-বাবু/এ.এস
« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত