বুদ্ধের ২৫৮৫তম জন্মজয়ন্তী। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পবিত্রতম উৎসব। বুদ্ধের ত্রিস্মৃতি বিজড়িত পুণ্যোৎসব বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে উদযাপিত হচ্ছে। এই পবিত্র তিথিতে বুদ্ধ লুম্বিনীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, বুদ্ধগয়ায় বোধিলাভ করেছিলেন এবং কুশীনগরে পরিনির্বাণ লাভ করেছিলেন। এইদিনে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীগণ শুচিবস্ত্রে বুদ্ধবিহারে বুদ্ধের বন্দনা করেন, প্রদীপ প্রজ¦লিত করেন, আরাধনায় নিমগ্ন হন এবং পঞ্চশীল, অষ্টশীল, সূত্রপাঠ, সূত্রশ্রবণ, সমবেত প্রার্থনা করেন। আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিবিধ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।
কোশলরাজ্য উত্তরে পার্বত্যভূমি হতে শুরু করে দক্ষিণে গঙ্গানদী পর্যন্ত এবং পশ্চিমে পাঞ্চাল রাজ্য হতে শুরু করে পূর্বদিকে গণ্ডক নদী বা সদানীরা পর্যন্ত বিস্তৃত। রাজধানী শ্রাবস্তী তৎকালীন ভারতবর্ষে ছয়টি মহানগরীর মধ্যে অন্যতম। কোশলরাজ্যের অধীনে শাক্যদের গণরাজ্য। যার রাজধানী কপিলাবত্থু। শুদ্ধোদনের রাজত্ব। মুক্তফলার অবর্ণ ছায়া-লাবণ্যে উদ্ভাসিত কপিলাবত্থু। উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রযোগে কপিলাবত্থু নগরীতে চলছে আষাঢ়ী পূর্ণিমাৎসব। উৎসবের সাতদিন মহামায়া সুগন্ধি মাল্যে ভূষিত হয়ে উৎসব পালন করলেন। সপ্তম দিবসে পূর্ণিমাতিথিতে প্রত্যুষে সুবাসতজলে স্নান শেষে সর্বাভরণে বিভূষিতা হয়ে সহস্র মুদ্রা ব্যয়ে মহাদান দিয়ে দুপুরের আগে উত্তম আহার্য সম্প্রাদন করে উপোস ব্রতগ্রহণ করলেন।
সারাদিন উৎসব শেষে সন্ধ্যায় সুসজ্জিত প্রকোষ্ঠে রাজপালঙ্কে শুয়ে মহারাণী মহামায়া। নিদ্রোপগতায় স্বপ্নে দেখতে লাগলেন চার দিকপাল এলেন। রাণীর পালঙ্ক তুলে নিয়ে চললেন শুভ্র তুষারমণ্ডিত মায়াময় লোকে। চার দিকপাল রাণীর পালঙ্ক বহন করলেন আলতো স্পর্শে, যেন এক তুলা খণ্ড। পালঙ্ক বহন করে হিমালয়ের ষাট যোজন ৪৮০ মাইল বিস্তৃত ‘মনোসিলা’ তলে সপ্তযোজন ছাপান্ন মাইল উচ্চ মহাশালবৃক্ষ তলে নামালেন। রহস্যঘেরা হিমালয়ের এক রহস্যময় স্থান। এরপর দেবকন্যারা মহামায়াকে নিয়ে গেলেন অনবতপ্ত হ্রদে। মানস-সরোবরে রাণীকে স্নান করালেন। উত্তম বসন-ভূষণ ও গন্ধানুলেপনে করালেন সুসজ্জিত। পাশে রজত পর্বত, তার কোলে সুরম্য কনক প্রাসাদ। সেই প্রাসাদের কক্ষে পূর্বশীর্ষ বহু রত্নখচিত দিব্য শয্যায় উত্তম বসন-ভূষণ সালংকায় মহামায়াদেবীকে দেবকন্যারা শয়ন করালেন। স্বর্ণ কুসুমের সৌরভ আমোদিত কক্ষের চারিদিক। দূরে কৈলাস পর্বতের শিখর থেকে নেমে এলো শ্বেত হস্তী, উত্তোলিত শুঁড়ে শ্বেত-পদ্ম। রজতশুভ্র শুণ্ডে শ্বেতপদ্ম গ্রহণ করে মহাবহংণশনাদে কনকপ্রাসাদে প্রবেশ করে মহামায়াদেবীর শয্যা তিনবার প্রদক্ষিণ করলেন। শ্বেত-হস্তী রানীর জঠরের গর্ভে ডান দিকে শ্বেতপদ্মটি প্রবেশ করিয়ে দিল।
কপিলাবত্থু ও দেবদহ দুই নগরের মধ্যবর্তী লুম্বিনী উদ্যান চারদিক পরিষ্কৃত। ভ্রমর ও নানা পাখীর মধুর স্বরের কূজন। শালবন অপূর্ব সাজে সজ্জিত। সদ্যপ্রস্ফুটিত সুগন্ধ পুষ্পের শোভায় বৃক্ষরাজি সুশোভিত। কাননের পুষ্পের গন্ধে আকুলিত সমীরণ। সাজানো উদ্যান সুশোভন হম্যে, সরোবরে। লুম্বিনী উদ্যান মঙ্গলশালবন। আকাশে বৈশাখী পূর্ণিমার উজ্জ্বল চাঁদ। রাণী কিছুদূর হেঁটে শালতরুর নিচে দাঁড়িয়ে বাষ্পে নমিত শালশাখা ধরলেন। তখনই তাঁর প্রসববেদনা শুরু হলো। আর অপূর্ব এক আনন্দের উচ্ছাসে মূর্ছা গেলেন। কোলিয়শাক্যরাজ অঞ্জন কন্যা মায়াদেবী প্রসব করলেন এক পুত্র সন্তান। লুম্বিনী কাননের শালবৃক্ষ তলে বৈশাখী পূর্ণিমার শুভক্ষণে জগতের আলো ভাবীকালের বুদ্ধ ভূমিষ্ঠ হলেন।
ভূমিষ্ট হলো জগতের আলো ভাবীকালের বুদ্ধ সে শিশু সে সময়, যখন মনুষ্য আয়ু শত বছর। জন্মগ্রহণ করলেন জম্বুদ্বীপে, কারণ জম্বুদ্বীপ পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ। এই জম্বুদ্বীপে পূর্বে বহু বুদ্ধ, মহাপুরুষ ও চক্রবর্তীর জন্ম হয়েছে, এই জম্বুদ্বীপের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মধ্যদেশ কোশলরাজ্য, তাই কোশলরাজ রাজধানী কপিলাবত্থুতে জন্মগ্রহণ করলেন। পৃথিবীতে ক্ষত্রিয়কুল শ্রেষ্ঠ, তাই ক্ষত্রিয়কুলে জন্মগ্রহণ করলেন। জন্মগ্রহণ করলেন ৩২ প্রকার মহাগুণসম্পন্না, মহাপুণ্যবতী মাতৃগর্ভ হতে এবং সর্বগুণোপতি মাতৃশুদ্ধ, পিতৃশুদ্ধ পুণ্যতেজ তেজস্বী চক্রবর্তীবংশ সমুদ্ভূত অপরিমিত ধননিধিরত্ন সমন্বাগত অভিরূপ দর্শনীয় ধর্মল ধর্মরাজ প্রজানুরঞ্জক কোশলের অধিপতি সুর্যবংশীয় শাক্যবীর শাক্যসিংহ শাক্যকুলপ্রদীপ মহরাজ শুদ্ধোদনের ঔরস্যে।
বোধিলাভের পূর্বে ধ্যানের চারটি স্তর অতিক্রম করলেন। পুরুষসিংহ শাক্যসিংহ সিদ্ধার্থ সঙ্কল্পের বর্ম্মে আবৃত হয়ে সাধনসমরে প্রবৃত্ত হলেন। জ্ঞাননেত্রে দেখলেন ‘ধম্মই সত্য, ধম্মই পবিত্র বিধি, ধম্মেই জগৎ বিধৃত হয়ে আছে। একমাত্র ধম্মের মাধ্যমেই, মানব ভ্রান্তি পাপ দুঃখ হতে মুক্তিলাভ করতে পারে।’ সিদ্ধার্থর প্রজ্ঞানেত্রের সম্মুখে জন্ম মৃত্যুর সকল রহস্য উদ্ঘাটিত হলো। বুঝলেন, দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখের নিরোধ এবং দুঃখনিরোধের উপায় এই চারটি আর্য্য সত্য। অর্থাৎ জন্মে দুঃখ, জরা ব্যাধি মৃত্যুতে দুঃখ, অপ্রিয়ের সাথে মিলনে দুঃখ, প্রিয়ের সাতে বিচ্ছেদে দুঃখ। তৃষ্ণা হতেই দুঃখের উৎপত্তি হয়ে থাকে। তৃষ্ণার নিবৃত্তি হলেই দুঃখের নিরোধ ঘটে।
এই দুঃখনিবৃত্তির উপায় আটটি, সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সঙ্কল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম্মান্ত, সম্যগাজীব, সম্যক ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি। রজনী অবসানপ্রায়, এমন সময় ধ্যানভঙ্গে নেত্র উন্মীলিত করে সিদ্ধার্থ এক বিমল আলোকমালা দর্শন করলেন। আধ্যাত্মিক উপলব্ধির সিদ্ধার্থকে দিল মহান বোধিজ্ঞান। পিপলবৃক্ষ তলে রাতের তৃতীয় প্রহরে বোধিজ্ঞান লাভ করলেন।
বর্তমান ক্রমবর্ধমান পারস্পরিক নির্ভরশীল বিশ্বে কল্যাণ এবং সুখ অনেক মানুষের উপর ও পারস্পরিক সুসম্পর্কের উপর নির্ভর করে। আজ বিশ্ব যুদ্ধ, খাদ্যসংকট, অর্থনৈতিক বৈষম্যসহ কহু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এরপরেও মানুষের সুখ-শান্তির মৌলিক ইচ্ছা সমান। বুদ্ধ ধম্ম, দান, ভাবনা, ধ্যান মনকে শান্ত করে। যদি আমরা একটা মানব পরিবারের সদস্য হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি, সমন্বিতভাবে একত্রিত হয়ে প্রচেষ্টা করি, তাহলে আমরা অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে পারবো। বুদ্ধের ধম্ম হলো অহিংসার শিক্ষা, জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা। শান্তি ও করুণাধারায় সিক্ত হোক বিশ্ব।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
-বাবু/এ.এস