শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫ ২৮ আষাঢ় ১৪৩২
শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫
নিম্নবর্গের নয়, শ্রমজীবী মানুষের ইতিহাস
রেজাউল করিম
প্রকাশ: শনিবার, ৩ জুন, ২০২৩, ৩:৫৩ PM

কার্ল মার্কস-এর মতে, মানুষের ইতিহাস শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। শ্রেণি সংগ্রাম মানে বিভাজন ও শোষণের ইতিহাস। সমাজের মানুষ ছিল দু’ভাগে বিভক্ত। যেমন- উচু ও নিচু, ধনী ও দরিদ্র, সবল ও দুর্বল, ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন, অত্যাচারী ও অত্যাচারিত, সুবিধাভোগী ও সুবিধাবঞ্চিত, বিলাসী ও নিঃস্ব, শাসক ও শোষিত, জমিদার ও ভূমিদাস, প্রভু ও দাস, মালিক ও শ্রমিক, রাজা ও প্রজা, বুর্জোয়া ও সর্বহারা ইত্যাদি। সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষ হচ্ছে ধনী, শাসক, সবল, সুবিধাভোগী, জমিদার, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, আমলা, বুর্জোয়া। আর নিম্নশ্রেণির মানুষ দরিদ্র, দুর্বল, শাষিত, দাস, সর্বহারা ও শ্রমজীবী মানুষ। শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে আছেন কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, তেলি, জেলে, ধোপা, নাপিত, পাটনী, তাঁতী, রাজমিস্ত্রী, কাঠমিস্ত্রী, রংমিস্ত্রী, ড্রাইভার, ইলেট্রিশিয়ান, রিকশাচালক, দিনমজুর, মেথর, বাউল ইত্যাদি। শ্রমজীবী মানুষ হচ্ছে সবকিছুর কারিগর, উৎপাদনকারী। অথচ সমাজে তারা অবহেলিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত, নিঃস্ব। সমাজে তাদের দাম নেই। কারণ তারা নিম্নশ্রেণির মানুষ।

সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষ উৎপাদন করে না, শুধু ভোগ করে, শোষণ করে, শাসন করে, দুর্নীতি করে, অত্যাচার করে। তারা সবল। তাই তাদের সমস্ত অপকর্মকে গৌরবান্বিত করে ইতিহাস লেখা হয়। ইতিহাসে তাদেরকে মহান হিসেবে দেখানো হয়। শ্রমজীবী মানুষের শ্রমকে তিলে তিলে সঞ্চিত করে সৃষ্টি হয়েছে সভ্যতা। প্রাচীন কালের সভ্যতা হোক, আর বর্তমানকালের সভ্যতাই হোক তা শ্রমজীবী মানুষের সৃষ্টি। মিসরের পিরামিড বল, ভারতের তাজমহল বল, সবই নিপীড়িত শ্রমজীবী মানুষের সৃষ্টি। খুফুর পিরামিডটি তৈরি করতে এক লক্ষ লোকের বিশ বছর লেগেছিল। তাজমহল তৈরি করতে বিশ হাজার লোকের বাইশ বছর লেগেছিল। এসব তৈরি করতে তারা শুধু শ্রমই দেননি, প্রাণও দিয়েছেন। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে যে, যিনি আমার মুখের আহার যোগান দেন তিনি হলেন কৃষক। তাকে তাচ্ছিল্য করে বলি খেত। যিনি আমার পরনের জন্য বস্ত্র বুনন করেন তিনি হলেন তাঁতি। আমরা তাকে হীন করে বলি জোলা। যে মিস্ত্রি চেয়ার, খাট-পালঙ্ক তৈরি করেন সে চেয়ারে তিনি বসতে পারেন না, সে খাট-পালঙ্কে তিনি ঘুমাতে পারেন না। এভাবে কামার, কুমার, তেলি, জেলে, ধোপা, নাপিত, পাটনী, তাঁতি, রাজমিস্ত্রী, কাঠমিস্ত্রী, রংমিস্ত্রী, ড্রাইভার, ইলেট্রিশিয়ান, রিকশাচালক, দিনমজুর কেউ প্রাপ্য মর্যাদা পান না। তাদের নিয়ে ইতিহাস লেখা হয় না। কারণ তারা নিম্নশ্রেণির মানুষ।

ইতিহাস লেখা হয় উচ্চশ্রেণিকে নিয়ে। নিম্নশ্রেণির মানুষকে নিয়ে কেউ ইতিহাস লেখে না। নিম্নশ্রেণির মানুষ ইতিহাসে স্থান পেতে পারে এটা কারো মাথায় আসেনি। মার্কসবাদী ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহ ১৮৮২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে নিম্ন শ্রেণির মানুষের গুরুত্ব উপলব্ধি করে Subaltern Studies-এর উপর দুটি বক্তৃতা দেন। তাঁর সে বক্তৃতা ‘এক্ষণ’ সাময়িক পত্রিকায় নিম্নবর্গের ইতিহাস নামে প্রকাশিত হয়। এ কাজে জড়ো করেন একদল তরুণ ইতিহাসবিদদের। যেমন দীপেশ চক্রবর্তী, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ভদ্র, শাহিদ আমিন, জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে, গায়েত্রী চক্রবর্তী প্রমুখ ইতিহাসবিদ। গুহ ১৯৮৩ সালে প্রথম নিম্নবর্গ অধ্যয়ন সম্মেলনের আয়োজন করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি বের করেন তাঁর গবেষণাসমৃদ্ধ গ্রন্থ Elementary Aspects of Peasant Insurgency in Colonial India। গ্রন্থটি Subaltern Studies-এ ব্যাপকভাবে ধ্রুব হিসাবে বিবেচিত। রণজিৎ গুহের নেতৃত্বে তরুণ ইতিহাসবিদগণ নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চা করে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা মুখর করে তুলেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশেও নিম্নবর্গের ইতিহাস বেশ গুরত্ব পায়। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে। দেশের বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ বর্ষ অনার্স শ্রেণির জন্য নিম্নবর্গের ইতিহাস কারিকুলামে স্থান দিয়েছে।

নিম্নবর্গের ইতিহাসকে কারিকুলামে স্থান দেওয়ার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ধন্যবাদ। আমার প্রশ্ন বা আপত্তি হচ্ছে কোর্সটির নামকরণ নিয়ে। যে মানুষদের আমরা মূলস্রোতে নিয়ে আসতে চাই, মর্যাদা দিতে চাই, গুরুত্ব দিতে চাই সে মানুষদের প্রথমেই যদি নিম্নস্তরের মানুষ, নিম্নবর্গের মানুষ বলে অভিহিত করি, তাহলে তাদের প্রতি গুরুত্ব বা মর্যাদা দিতে গিয়ে কি উপহাস করা হয় না? তাই এ কোর্সটির নাম নিম্নবর্গের ইতিহাস না বলে শ্রমজীবী মানুষের ইতিহাস বা মেহনতি মানুষের ইতিহাস বা নিপীড়িত শোষিত বঞ্চিত মানুষের ইতিহাস বলা করা যেতে পারে। যেমন মহাত্মা গান্ধী ১৯৩৩ সালে সমাজে অস্পৃশ্য দলিত বলে বিবেচিত লোকদের হরিজন নামে নামকরণ করেন। হরিজনের অর্থ হচ্ছে হরি বা ভগবানের লোক। যা-ই হোক, যাদের শ্রমের উপর দাঁড়িয়ে আছে আজকের পৃথিবী, সভ্যতা, শান-শওকত, রাজা-বাদশাহ, আমলা সবকিছু, তাদেরকে নিম্নবর্গের মানুষ বলে অভিহিত করা শোভন নয়। বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক কাউন্সিল ও ইতিহাসবিদদের উচিত বিষয়টি ভেবে দেখা।

নিম্নবর্গ তথা শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমের ঘাটতি ছিল না। তারা রাজনীতি ও সমাজনীতিতে, নিজস্ব অধিকার বিষয়ে একেবারে সচেতন ছিলেন না, তা সত্য নয়। বরং তারাই প্রথম ব্রিটিশ বেনিয়া ও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করেছেন। সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষ যখন ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্রিটিশের দালালি করেছেন, পদলেহন করেছেন, তখন নিম্নশ্রেণির মানুষ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন- লড়াই করেছেন। যেমন ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬৩ -১৮০০), পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা বিদ্রোহ (১৭৭৬-১৭৮৭), রংপুরের কৃষক বিদ্রোহ (১৭৮৩ ), ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহ (১৮২০-১৮৩৩), ওহাবি আন্দোলন (১৮৩১), ফরিয়াজী আন্দোলন (১৮৪০), সাওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-১৮৫৭), নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-১৮৬০), পাবনা বিদ্রোহ (১৮৭২-১৮৭৩)), তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬), নাচলের কৃষক বিদ্রোহ (১৯৪৯)। নিম্নবর্গের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষকে লড়াই করতে হয়েছে দুই শ্রেণির বিরুদ্ধে। যেমন ভিন দেশীয় শাসক ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ও দেশীয় উচ্চবর্গ অভিজাত জমিদার শ্রেণির বিরুদ্ধে। মেহনতি মানুষকে আরেকটি শ্রেণির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। সে শ্রেণি হচ্ছে ধর্মীয় পুরোহিত শ্রেণি। ধর্মীয় উচুশ্রেণি সমাজকে জাতপাত ও বর্ণ-বৈষম্যে বিভক্ত করে রেখেছিল। বাউল সম্প্রদায় জাতপাত ও বর্ণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তাই তো লালন ফকিরের কণ্ঠে শুনিতে পাই ‘জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা/সত্য কাজে কেউ নয় রাজি সবই দেখি তা না না না/আসবার কালে কি জাত ছিলে এসে তুমি কি জাত নিলে/ কি জাত হবা যাবার কালে সেই কথা ভেবে বলো না।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘কউ মালা কেউ তসবি গলে তাতে কি জাত ভিন্ন বলে/যাওয়া কিংবা আসার বেলায় জাতের চিহ্ন রয় কার রে।’

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর

-বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত