শিক্ষকতা একটি মহান পেশা এটি সর্বজনবিদিত। শিক্ষা পেশার দীর্ঘ অভিজ্ঞিতার একটি সোনালি অধ্যায় হলো শিক্ষায় নেতৃত্ব প্রদান। শিক্ষক নিজেবে তিল তিল করে নিজেকে তৈরি করেন তার মেধা, যোগ্যতা, ধৈর্য্য, সহানুভূতি, সহযোগিতা ও সম্প্রীতির অনুপম আদর্শ স্থাপনের মাধ্যমে। দীর্ঘ শিক্ষকতার জীবনে তিনি তার ত্যাগ ও সেবার মহিমায় গড়ে তোলেন একটি সুশীল সমাজ ও দেশ পরিচালনার বলিষ্ঠ কাণ্ডারি।
দেশ ও জাতি গঠনের এমন মহান শিক্ষকেরা একদিন হয়ে ওঠেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান এবং অধিষ্ঠিত হন প্রতিষ্ঠানের গৌরবগাঁথা নেতৃত্বের বিশেষ আসনে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধরন, আকার ও গুণমান ভেদে তিনিই সম্মানিত হন কোথাও অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষক, হিসাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানগণকে বলা হয়ে থাকে উপাচার্য।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান বা অধ্যক্ষদের দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠানের শিখন ও শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় কার্যকর ইনকিউবেটর হিসেবে কাজ করে। ফলে শিক্ষার্থীরা সেখানে শুধুমাত্র শিক্ষিত হয় না বরং জীবনযাপন প্রণালিতে নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সফলতার দ্বার উন্মোচিত করতে পারে। অন্যদিকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের দুর্বল ও অদক্ষ নেতৃত্ব একটি শিক্ষাব্যবস্থার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনকে ব্যাহত করে এবং শিক্ষার কাঠামোগত উন্নয়নকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে। নিম্নে এমন কিছু কৌশলের বর্ণনা দেওয়া হল
এক.
সফল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান বা অধ্যক্ষ একটি সুন্দর সম্প্রদায় গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব দেন। কার্যকর স্কুল নেতারা পারস্পরিক পরিবার ও সম্প্রদায়ের অংশীদারিত্ব বজায় রাখতে চেষ্টা করেন এবং তাদের মধ্য থেকে যারা অন্তর্ভুক্তিমূলক, যত্নশীল এবং সাংস্কৃতিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল তাদেরকে বিশেষ সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার করে থাকেন। এ সম্প্রদায়ের সাথে ভালো নেটওয়ার্ক স্থাপন করতে প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ সকলের সাথে দৃশ্যমান বিশ্বাস ও স্বচ্ছতাবোধ তৈরি করেন। অধ্যাপক মেগান শ্যানেন মোরান তার বই ‘ট্রাস্ট ম্যাটারস’-এ লিখেছেন, ‘শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রধান সহমত ও গঠনমূলক পরামর্শের ভিত্তিতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে একটি সুনিবিড় সম্পর্ক তৈরি করেন।’
দুই.
তারা শিক্ষকদের ক্ষমতায়ন করেন এবং নেতৃত্বের দক্ষতা গড়ে তোলেন। গ্রেট এডুকেশন লিডাররা বিশ্বাস করেন যে, তারা ‘ওয়ান ম্যান শো’ বা ‘একাই সব করবেন’, সেটি হিসাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন না। তারা জানেন যে, তাদেরকে অবশ্যই মহান শিক্ষক এবং সহকর্মীদের সাথে নিজেকে ঘিরে রাখতে হবে এবং শুধু তাই নয়, তাদেরকে অবশ্যই শিক্ষক এবং অ-শিক্ষক কর্মীদের ক্রমাগত শিখতে, বিকাশ করতে এবং ভবিষ্যৎ নেতা হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা দিতে হবে।
তিন.
সফল অধ্যক্ষগণ প্রতিষ্ঠানের সকল ডেটা সংরক্ষণ ও প্রযুক্তির ব্যবহারে গুরুত্ব দেন। শিক্ষা নেতৃত্বে যারা সফল অধ্যক্ষ, তার সমস্ত শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের ডেটা সংরক্ষণ করেন। তারা উক্ত ডেটা অনুযায়ী ন্যায়সঙ্গত এবং সাংস্কৃতিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল সুযোগগুলো কাজে লাগানোর মাধ্যমে সাইট-ভিত্তিক ক্রমাগত উন্নতি সাধন করতে সচেষ্ট হন।
চার.
সফল অধ্যক্ষদের একটি তীক্ষè দৃষ্টি এবং কর্ম পরিকল্পনা থাকে। খুব ভালো শিক্ষানেতারা হয়ে থাকেন স্বপ্নদর্শী। তাদের নেতৃত্বের একটি লক্ষ্য থাকে যে তারা কিভাবে তাদের চারপাশের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরকে একত্রিত করে দলীয়ভাবে কার্য সম্পন্ন করবে। শুধু তাই নয়, তারা তাদের স্কুলের দৃষ্টিভঙ্গি এবং লক্ষ্যগুলো স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হন।
পাঁচ.
তারা সহযোগিতামূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করেন। অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা সমস্ত শিক্ষার্থীকে নিজের ইচ্ছা ও চাহিদা অনুযায়ী শেখার দ্বারকে উন্মোচিত করে এবং নিজের পছন্দমত বিষয়ে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করে।
ছয়.
তারা তাদের কাজ সম্পর্কে উৎসাহী হন। যে সকল অধ্যক্ষ তাদের কাজে সফল এবং সুখী হতে চান তাদের জন্য আবেগ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কারণ, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে একজন অধ্যক্ষ তার প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দারুণ প্রভাব ফেলতে পারেন। শুধু জ্ঞানী হলেই একজন ভাল নেতা বা অধ্যক্ষ হওয়া যায় না। জ্ঞানের পাশাপাশি একজন অধ্যক্ষকে প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরকে নিয়মিত উৎসাহ দিয়ে কাজের প্রতি যত্নশীল করে তুলতে হবে।
সাত.
দক্ষ ও সফল অধ্যক্ষগণ নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে ঝুঁকি গ্রহণকে উৎসাহিত করেন। ব্যর্থতা থেকেই সফলতার আভাস আসে। এটি জীবনের ঝুঁকি নিতে শেখায়। যিনি তার কাজে ও নেতৃত্বে ব্যর্থ হন, তাকে ঝুঁকি নিতেই হয়। শিক্ষকদের যেমন তাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঝুঁকি গ্রহণকে উৎসাহিত করা উচিত, ঠিক তেমনি অধ্যক্ষদেরও তাদের অধস্তন সহকর্মীদের মধ্যে ঝুঁকি গ্রহণকে উৎসাহিত করা কর্তব্য।
আট.
তারা উদাহরণ সৃষ্টির মাধ্যমে নেতৃত্ব প্রদান করেন। কর্মস্থলে আমরা সবাই এ কথাটি শুনে থাকি যে, ‘আমি যেমন বলি তেমন কর, আমি যেমন করি তেমন নয়।’ কথাটির মধ্যে স্বৈরাচারিতা আছে। যে সকল অধ্যক্ষ উদাহরণ স্থাপনের নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন, তারা শুধুমাত্র তাদের স্কুল বা জেলার ছাত্রদের জন্যই নয়, সহকর্মী এবং অভিভাবকদের জন্যও অসাধারণ রোল মডেল হিসেবে অবস্থান করেন।
নয়.
তারা স্বভাবগতভাবেই অধ্যবসায়ী হন। প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নকল্পে সুদীর্ঘকাল ধরে একই কর্মস্থলে কাজ করতে পারলে একজন অধ্যক্ষ তার মেধা ও অভিজ্ঞতার সবটুকু কাজে লাগিয়ে সকলের সুনাম অর্জন করতে পারেন। কোনো অধ্যক্ষ ঘনঘন কর্মস্থল পরিবর্তন করলে তিনি কোথাও উন্নতি করতে পারেন না। সেক্ষেত্রে একদিকে যেমন তার ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার গঠন বাধাগ্রস্ত হয়, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানেরও মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়।
দশ.
সফল অধ্যক্ষগণ নিজেদেরকে আজীবন শিক্ষার্থী মনে করেন। দেশ ও সমাজের পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে তারা প্রতিনিয়তই শিক্ষা গ্রহণ করেন। একজন অধ্যক্ষের যে সমস্ত গুণাবলী থাকতে পারে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল জ্ঞানের অদম্য তৃষ্ণা। জন এফ কেনেডি যেমন বলেছিলেন, ‘নেতৃত্ব এবং শিক্ষা একটি অপরটির সম্পূরক এবং অপরিহার্য।’ সেরা অধ্যক্ষরা যে যে শিল্পেই কাজ করুক না কেন, তারা কখনই সব জানতে পারবে না; তাদেরকে জানার চেষ্টা করতে হবে।
অতএব, শিক্ষকতা জীবনে যিনি সুনাম ও সুখ্যাতির সাথে কাজ করে নিজেকে সফল শিক্ষক হিসেবে পরিচিত করতে পেরেছেন, তিনি যদি শিক্ষা নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হন, তাহলে তার নেতৃত্বের সফলতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পেতে পারে দেশসেরা আদর্শ বিদ্যানিকেতনের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব।
লেখক : অধ্যক্ষ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা
-বাবু/এ.এস