প্রস্তাবিত বাজেটে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে ধরে রাখার লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার কালে যখন দেশের মানুষ বিশেষত কম আয়শ্রেণির পরিবারগুলো মূল্যস্ফীতির কারণে হিমশিম খাচ্ছে, তখন মূল্যস্ফীতি এই মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তা নিশ্চয়ই একটি বড় অর্জন হবে। সত্যি বলতে আসছে অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার কত হলো বা না হলো তার চেয়ে মূল্যস্ফীতি কতটা নিয়ন্ত্রণ করা গেল, সেদিকেই বেশি নীতি-মনোযোগ কাম্য। তবে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে ধরে রাখার লক্ষ্য অর্জন আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে ভাবার সুযোগ আছে।
কারণ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জানাচ্ছে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে কখনোই মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের নিচে ছিল না, আর মে মাসে গড় মূল্যস্ফীতি তো প্রায় দুই অঙ্কের কাছে ঠেকেছে (৯.৯৪ শতাংশ)। বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ওপরে ছিল সর্বশেষ ২০১০-১১ অর্থবছরে (১০.৯২ শতাংশ)। এই অর্থবছরের এপ্রিল নাগাদ তা ছিল ৮.৬৪ শতাংশ। উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরে এর লক্ষ্যমাত্রা ৭.৫ শতাংশ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিবৃতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ‘মধ্য মেয়াদে সতর্ক রাজস্ব নীতি’ অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি ভর্তুকি যৌক্তিকীকরণ ও সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর মানোন্নয়নের কথাও বলা হয়েছে। সর্বোপরি মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা আনতে একক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করার কথাও শোনা যাচ্ছে। এর প্রভাবও মূল্যস্ফীতির ওপর নিশ্চয়ই পড়বে।
ফলে বাজেটের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য অর্জন বহুলাংশে নির্ভর করছে মুদ্রানীতির সঙ্গে বাজেটের সমন্বয়ের ওপর। আশার কথা, বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ মনিটারি পলিসি রিভিউ ২০২২-২৩-এ সেই সমন্বয়ের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। নিম্ন ও মধ্য আয়ের নাগরিকদের মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সুরক্ষা দেওয়ার দিকেই আগামী জুলাই-ডিসেম্বর ২০২৩ সময়কালের মুদ্রানীতিতে মনোযোগ দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সর্বশেষ প্রকাশনায়। শেষ বিচারে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির ধারাবাহিকতা ধরে রাখবে বলেই আশা করা যায়। বর্তমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সেটিই কাম্য।
ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতির কারণে নেট ফরেন অ্যাসেট দ্রুত কমে আসায় আমাদের ব্রড মানির (গ২) বৃদ্ধির হার ২০২২-এর জুনে ৯.৪৩ থেকে কমে ৯.১৩ শতাংশে নেমে এসেছে এ বছরের মার্চে। ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহেও একরকম ভাটার টান দেখা যাচ্ছে (একই সময়ের ব্যবধানে এই হার ১৩.৬৬ থেকে কমে ১২.০৩ শতাংশ হয়েছে)। মুদ্রা সংকোচনের এই ধারা অব্যাহত রাখা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। আর মূল্যস্ফীতির আশঙ্কার আলোকে সেটিই কাম্য। নিঃসন্দেহে স্বল্পকালীন মূল্যস্ফীতি দীর্ঘকালীন উপদ্রব হিসেবে জনজীবনে চেপে বসুক, তা কেউই চায় না। এই প্রেক্ষাপটে আগামী ছয় মাসের মুদ্রানীতিতে গ২-র বৃদ্ধির হার ১১.৫ শতাংশ এবং ব্যক্তিখাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির হার ১৪.১ শতাংশে নেওয়ার লক্ষ্য স্থির করা হবে বলে জানানো হয়েছে। মোট কথা, আগামী ছয় মাসের জন্য সতর্ক ও বাস্তবতার প্রতি সংবেদনশীল (Cautiously Accomodative) একটি মুদ্রানীতি আমরা পেতে যাচ্ছি। তবে এর মূল চরিত্র সংকোচনমূলকই থাকবে বলে আশা করা যায়।
বাজেট, মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রানীতিমনে রাখা চাই, মূল্যস্ফীতির যে চাপ এখন আমরা মোকাবেলা করছি তার প্রধান উৎস বহির্বাণিজ্য। টাকার অবমূল্যায়নের পাশাপাশি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং বিশ্ববাজারে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির জেরে আমরা ব্যাপক মূল্যস্ফীতির মুখোমুখি হয়েছি। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমে আসতে শুরু করেছে (যেমনÑ জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৭০ থেকে ৭৫ ডলারে নেমে এসেছে, যা প্রায় করোনা মহামারি আসার আগের দামের সমান)। তবে এর প্রভাবে রাতারাতি বাংলাদেশে পণ্যমূল্য পরিস্থিতির উন্নতি আশা করা ঠিক হবে না। কেননা ডলারের বিপরীতে টাকার যে অবমূল্যায়ন হয়েছে তার জেরে আমাদের আমদানি খরচ আগের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া আপাতত অসম্ভবই মনে হচ্ছে। এসবের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারি ঋণের কারণেও মূল্যস্ফীতির চাপ বহাল থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দুই লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকার যে বাজেট ঘাটতি দেখানো হয়েছে তার ৫১ শতাংশই সরকার অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ করবে। সরকার যদি এই টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নেয়, তাতেও বাজারে টাকার সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি হতে পারে (চলতি বছরে সরকারকে ঋণ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাপাতে হয়েছে)। অন্যদিকে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে ব্যক্তি খাতের জন্য ঋণের সরবরাহে ভাটা পড়ার ভয় আছে। ঋণ সরবরাহ সংকুচিত হলে বিনিয়োগ ও উৎপাদন কম হবে, তাতে বাজারে পণ্য সরবরাহ কমবে। এতেও পণ্যমূল্য বাড়বে। তা সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতির কারণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির তেতো ওষুধ হয়তো আমাদের খেতেই হবে।
এই প্রেক্ষাপটে পণ্য আমদানি বাবদ ডলার খরচ কমানো জরুরি। সে জন্য আমদানি নিয়ন্ত্রণের কিছু উদ্যোগ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়েছে। ডলারভিত্তিক বাণিজ্য অর্থায়নের ওপর মনিটরিংয়ের চাপও বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তা না করে উপায়ও ছিল না। গেল বছরের শেষ দিকে আমরা তার কিছু ইতিবাচক প্রভাবও দেখেছি। তবে আমদানিতে ঢালাও কড়াকড়ি বেশিদিন বহাল রাখলে তাতে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। ইনপুট আমদানি ব্যয় বাড়লে উৎপাদন কমবে, তাতে সরবরাহও কমবে। আর তার ফলে পণ্যমূল্যের বৃদ্ধি ঠেকানো কঠিন হবে। আর বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হলে কর্মসংস্থান তথা মানুষের আয়েও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এই প্রভাবের কারণে শহরের অনানুষ্ঠানিক কর্মে নিয়োজিত মানুষের একটি অংশ যথেষ্ট আয়-রোজগার না করতে পেরে গ্রামে চলে গেছে বলে সম্প্রতি বিবিএসের জরিপে ধরা পড়েছে। এরই মধ্যে আমাদের অর্থনীতিতেও এমন কিছু সংকেত দৃশ্যমান। তবে আশার কথা এই যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিবৃতিতে আমদানির ওপর এসব কড়াকড়ি ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতেও নিশ্চয়ই আমরা এর প্রতিফলন আশা করতে পারি। নিশ্চয়ই ছোট ছোট এলসির জন্য ডলার সরবরাহের একটি আলাদা পাইপলাইন খুললে সাধারণ আমদানিকারকদের টিকে থাকা সহজ হবে।
অর্থনীতিকে সচল রাখতে আমদানি তো করতেই হবে। তবে ডলার রিজার্ভ ধরে রাখার দিকেও নীতি-মনোযোগ অব্যাহত রাখা চাই। তা রাখার জন্য আইএমএফের বাড়তি চাপও আছে। এই বিবেচনার জায়গা থেকেই আমাদের দুই বড় বাণিজ্য সহযোগী দেশ ভারত ও চীনের সঙ্গে ডলারের পরিবর্তে যথাক্রমে রুপি ও ইউয়ানে বাণিজ্য করার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। গত বছর থেকেই বিষয়টি আলোচনায় আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, পাইলট প্রগ্রাম হিসেবে ভারতের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে চারটি ব্যাংকের মাধ্যমে রুপিতে লেনদেন চালু হওয়ার কথা রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক এবং ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও আইসিআইসিআই। পাইলট ভিত্তির এই উদ্যোগে বিনিময় হার হবে সরাসরি টাকা থেকে রুপি বা রুপি থেকে টাকায়। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে যাবেন বা ভারত থেকে পণ্য আমদানি করবেন, তারা ওই ব্যাংক হিসাবে ভারতীয় রুপি যোগ করতে পারবেন। এটি এক ধরনের ‘কারেন্সি সোয়াপ’ ব্যবস্থা। ডলার ধরে রাখার জন্য এটি সহায়কই হবে। তবে মনে রাখতে হবে যে ভারত সঙ্গে আমাদের বড় বাণিজ্য ঘাটতি আছে। আমরা ভারত থেকে এক হাজার ৬০০ কোটি ডলারের মতো পণ্য/সেবা আমদানি করি। পক্ষান্তরে রপ্তানি করি ২০০ কোটি ডলার। ২০০ কোটি ডলারের যে রপ্তানি আয় বাংলাদেশ করছে, সে পরিমাণ বাণিজ্য ভারতীয় মুদ্রায় সম্ভব হবে। বাকি এক হাজার ৪০০ কোটি ডলার কিন্তু আগের মতো মার্কিন ডলারেই পরিশোধ করতে হবে। তবে ভারত যদি বড় অঙ্কের রুপি ঋণ (ধরুন, পাঁচ বিলিয়ন ডলারের সমান) বা সোয়াপ দেয় স্বল্প সময়ের জন্য, তাহলে তা থেকেই এ দেশ থেকে আমদানি করা মূল্যে শোধ করা সম্ভব। এর ফলে ডলার রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ কমানো যাবে। কারেন্সি সোয়াপের আরো প্রসারিত প্রয়োগ নিয়ে নিশ্চয়ই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ রয়েছে। সে সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিশ্চয়ই এর ঝুঁকির দিকগুলোও বিবেচনায় রাখবেন। তবে কারেন্সি সোয়াপ আপাতত কিছুটা স্বস্তি দিতে পারবে কেবল। দীর্ঘতর মেয়াদের জন্য এটিকে স্থায়ী সমাধান হিসেবে বিবেচনার সুযোগ নেই। আশার কথা, দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এই বিষয়টি নিয়ে বসেছিলেন। দুই দেশই এ নিয়ে কাজ করছে। পাশাপাশি কম সুদের দীর্ঘমেয়াদি বিদেশি ঋণ (এডিবি, আইআইবি, বিশ্বব্যাংক ইত্যাদি) নেওয়ার উদ্যোগ বজায় রাখতে হবে। এই অর্থবছরে এসব সূত্র থেকে ১.০২ বিলিয়ন ডলার মিলবে।
বহির্বাণিজ্যের স্থিতিশীলতা ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য মধ্যমেয়াদি কৌশল নিয়েই এগোতে হবে। এ জন্য বাজারভিত্তিক সমাধানের বিকল্প নেই। সুদের হার বাজারভিত্তিক করা এবং একক মুদ্রা বিনিময় হারের দিকে এগোনোর কথা আমরা আরো আগে থেকেই বলছি। যত দূর জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের আগামী মনিটারি পলিসি স্টেটমেন্টে পুরোপুরি এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত না হলেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে। অচিরেই একক মুদ্রা বিনিময় হারের সিদ্ধান্তই বাংলাদেশ ব্যাংক নেবে বলে মনে করা হচ্ছে। আর সুদের হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক না করলেও একটি করিডর ব্যবস্থার মাধ্যমে কিছুটা ম্যানুভারিংয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে। ‘মন্দের ভালো’ এই উদ্যোগটিকেও স্বাগত জানাই। সব মিলিয়ে বলতে চাই যে মূল্যস্ফীতির জাঁতাকল থেকে মানুষকে বাঁচাতে হলে মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি, সামাজিক সংরক্ষণ নীতি এবং কৃষিসহ দেশি অর্থনীতির নানা অংশের জন্য পর্যাপ্ত বাজেটারি সহায়তা বাড়িয়ে যেতেই হবে। কেননা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাহিদা ও সরবরাহ—দুটি দিকের ওপরই নীতি-মনোযোগ বজায় রাখতে হবে। সবাই মিলে চেষ্টা করলে মূল্যস্ফীতিসহ এই সংকটকালীন ম্যাক্রো অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে।
লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
বাবু/জেএম