বাঙালির মাথায় একবার একটা কিছু ঢুকিয়ে দিলেই হলো তা চলে অনন্তকাল। পরিবর্তনের চিন্তা নেই। তাতে সে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তা বোঝার বোধ নেই। বাঙালির হিতাহিত জ্ঞান নেই, ভালোমন্দ বোধ নেই, দূরদর্শিতা নেই। এরা পরের মাথায় ছাতা ধরতে পারলে আর পরের কথায় গা ভাসিয়ে দিতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করে। তাই মাথায় ছোট বহরে বড় বাঙালি জাতি বিশ্বব্যাংক ও বহিঃশক্তির পরামর্শ শুনে অদূরদর্শী কাজের সিদ্ধান্ত নেয়।
তন্নধ্যে স্লুইসগেট প্রকল্প একটি। একসময় বাংলাদেশে বর্ষা হত, বন্যা হত। বন্যায় ক্ষেতের ফসল তলিয়ে যেত। তখন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু প্রকৌশলী সরকারকে পরামর্শ দিল, শাখা নদী ও খালের উৎসমুখে স্লুইসগেট বসিয়ে পানিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে দেশে বন্যা হবে না, ক্ষেতের ফসলহানি হবে না। সরকার তাদের পরামর্শ গ্রহণ করে স্লুইসগেট স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকৌশলীদের পোয়াবারো হয়। বসাও সমস্ত খাল ও নদীর উৎসমুখে স্লুইসগেট। স্লুইসগেটগুলো বাঙালির কতটুকু উপকার করেছিল তা গবেষণার বিষয়।
তবে বর্তমানে তা দেশকে ধ্বংসের কিনারে নিয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে গবেষণার দরকার নেই। উজান অঞ্চলে বাংলাদেশের বড় নদীগুলোর মধ্যে পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, সুরমা, তিস্তা, মহানন্দা অন্যতম। এসব নদী থেকে তৈরি হয়েছে অসংখ্য শাখা প্রশাখা নদী। যেমন পদ্মা শাখা নদী হচ্ছে গড়াই, বড়াল, আড়িয়াল খাঁ, কুমার, মাথাভাঙ্গা, কপোতাক্ষ ইত্যাদি। আবার পদ্মার বিভিন্ন প্রশাখা নদীসমূহ হলো মধুমতী, নবগঙ্গা, চিত্রা, পশুর, ভৈরব ইত্যাদি। এই নদীগুলো কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, নড়াইল, মাগুরা, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী ইত্যাদি জেলার উপর দিয়ে বিস্তৃতি লাভ করেছে।
পদ্মার এসব শাখা প্রশাখা নদীর উৎসমুখে স্থাপন করা হয়েছে স্লুইসগেট। নদীর পানি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাবে কী করে? ধরুন ফরিদপুরের কুমার নদীর কথা। নদটি বয়ে গেছে ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার উপর দিয়ে। সেখানকার মানুষ পাট জাগ দেওয়ার পানি পাচ্ছে না। জাগ দেওয়ার সুবিধা না থাকায় অনেক কৃষক পাট কাটছে না, ক্ষেতে শুকিয়ে যাচ্ছে। কারণ নদীতে পানি নেই। নদীতে পর্যাপ্ত পানি না থাকার কারণে খালে বিলেও পানি নেই। কুমার নদীতে পানি কম। কারণ স্লুইসগেট। কয়েকদিন আগে কুমার নদীর স্লুইসগেট দেখতে গেলাম। গিয়ে দেখি মাত্র দুটি গেট খোলা রয়েছে। দুপাশের পানির ব্যবধান কয়েক হাত। সবগুলো গেট খুলে দিলে সমস্যা কী? যেখানে স্লুইসগেটের দরকার নেই সেখানে মাত্র দুটি গেট খোলা রেখেছে। পদ্মার দুই পাড়ের যত খাল ছিল তাদের উৎসমুখ হয় স্লুইসগেট নয়তো মাটি দিয়ে ভরাট করে আটকে দেওয়া হয়েছে। দেওয়া হয়েছে বেড়িবাঁধ। তাছাড়া পলি পড়ে নদীর পাড় উঁচু হয়ে গেছে। ফলে পদ্মার পানি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে পারছে না। জমিতে পানি না উঠলে সে জমির উর্বতা হ্রাস পেতে পেতে মরুভূমি হবে। নিচে থেকে স্যালো বা ডিপটিউবওয়েল বসিয়ে পানি তুললে পানির স্তর নেমে যায়। কুষ্টিয়া মেহেরপুর অঞ্চলে নরমাল টিউবওয়েলে পানি উঠে না। পানির স্তর নিচে নেমে গেচে। পানি তো নিচে অ্যাবজর্ব হতে হবে। উপরে পানি না থাকলে অ্যাবজর্ব হবে কী করে?
গতমাসে জেলা প্রশাসক বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র শিক্ষক ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নিয়ে কুমার নদের কচুরিপানা পরিষ্কার করান। প্রশ্ন হল, নদী কচুরিপানায় ভরে যায় কেন? স্রোত না থাকলে, পানির প্রবাহ না থাকলে তো কচুরিপানা হবেই। এমনিতেই দেশে বৃষ্টি নেই, বর্ষা নেই সেখানে স্লুইসগেট কেন? আশি ও নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত দেশে বর্ষা হত, চার মাস নৌকায় চলাচল করতাম। নৌকায় করে স্কুলে যেতাম, হাটবাজারে যেতাম, আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম। ডুবিয়ে পাট কেটে ক্ষেতেই জাগ দেওয়া হত। ডুবিয়ে ক্ষেতের আখ কাটা হত। আজ ক্ষেত তো দূরের কথা, খাল-বিল ও নদীতে পানি নেই। আজকাল পাট জাগ দিতে হয় স্যালো মেশিনের পানিতে। পদ্মায় যতটুকু পানি আছে তা বঙ্গোপসাগরে চলে যায়। স্লুইসগেটের কারণে ছোট নদী ও খালে পানি প্রবেশ করতে পারছে না। তাই বাংলাদেশে যত স্লুইসগেট আছে তা ভেঙে ফেলা উচিত। মাটি দিয়ে খালের উৎসমুখ বন্ধ করা হলে তাও খুলে দেওয়া উচিত। প্রকৃতির স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করলে প্রকৃতি বিরূপ ধারণ করে এবং ধীরে ধীরে তা প্রতিশোধাত্মক হয়ে উঠে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর
বাবু/এ.এস