বুধবার ৯ জুলাই ২০২৫ ২৫ আষাঢ় ১৪৩২
বুধবার ৯ জুলাই ২০২৫
বঙ্গবন্ধু টানেল
গতি আনবে কর্মসংস্থান ও অর্থনীতিতে
কাজী রবিউল ইসলাম
প্রকাশ: রবিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৩, ৩:৫৩ PM
যোগাযোগ অবকাঠামো উদ্বোধনের মাহেন্দ্রক্ষণ পার করছে বাংলাদেশ। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ উদ্বোধনের মাধ্যমে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সম্ভাবনার নতুন দুয়ার উন্মোচিত হচ্ছে। চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা এবং প্রকল্প বাস্তবায়নকালে কষ্টভোগ ও ত্যাগ স্বীকারের ফল অবশেষে বাস্তব রূপ পেল। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলকে আগলে রেখেছে যে কর্ণফুলী তার বুকচিরে তৈরি হয়েছে ৩ দশমিক ৩১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে দেশের প্রথম এ সুড়ঙ্গপথ। আর এই সুড়ঙ্গপথ শুধু যোগাযোগব্যবস্থারই উন্নতি করবে এমনটি নয়; বরং এই প্রকল্পের সংযোগকারী প্রভাব পর্যটনশিল্প, অর্থনীতির বিভিন্ন খাত, বাণিজ্যের সম্ভাবনা, মেরিটাইম অর্থনীতি, নৌবন্দরের সুষ্ঠু ব্যবহারসহ বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের হাব হয়ে উঠবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, কী উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার এমন একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। কর্ণফুলী টানেল কি শুধু আমাদের যোগাযোগব্যবস্থারই উন্নয়ন করবেÑ এমন প্রশ্নও ইতোমধ্যে অনেকের মধ্যে দেখা দিয়েছে। যেকোনো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের ফল তাৎক্ষণিক পাওয়া সম্ভব নয়। সেজন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়। তবে তাৎক্ষণিকভাবে যে একেবারেই কিছু সুফল পাওয়া যায় না তা কিন্তু নয়। এমন একটি প্রকল্প নির্মাণের জন্য সরকারকে নিজস্ব অর্থায়ন, বৈদেশিক ঋণ ও সহায়তা ব্যবহার করতে হয়েছে। তাই এমন একটি প্রকল্প থেকে আয় করতে হলে সরকারকে অপেক্ষা করতে হবে। এ কারণে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে এর সুফল অনুমান করতে পারি না। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, কর্ণফুলী টানেল একটি অনিবার্য প্রকল্প। পদ্মাসেতু যেমন একটি অনিবার্য প্রকল্প ছিল, এই প্রকল্পও তেমনি একটি অনিবার্য প্রকল্প। এই প্রকল্পের সম্ভাবনাগুলো খতিয়ে দেখলেও তেমনই প্রতীয়মান হয়। যদি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে এই প্রকল্পের সম্ভাবনাগুলো অর্জন করা যায়, তাহলে এর সুফল সারা দেশবাসী ভোগ করবে। এখন আসি এর সম্ভাবনাগুলোর বিষয়ে। প্রথমত, কর্ণফুলী টানেল উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে যোগাযোগব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হবেÑ এ নিয়ে সন্দেহ নেই। সারাদেশের সঙ্গেই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এই সংযোগসাধন হবে। এক্ষেত্রে এশিয়ান হাইওয়ের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সংযোগের কথা চিন্তা করলে কর্ণফুলী টানেলের গুরুত্ব বোঝা সহজ। সম্প্রতি ঢাকা-চট্টগ্রাম ডাবল লাইনের মতো উচ্চগতির রেলপথ উদ্বোধন করা হয়েছে। পাশাপাশি এমন বড় প্রকল্প থাকলে যোগাযোগ আরও সহজ হয়ে উঠবে। কর্ণফুলী টানেল সমুদ্রের খুব কাছাকাছি হওয়ায় বন্দরের পণ্য আনা-নেওয়া, নোঙর, বহির্নোঙর করার ক্ষেত্রেও আলাদা সুবিধা পাওয়া যাবে। শুধু তাই নয়, প্রকল্পের কাছাকাছি থাকা পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত ও নেভাল সমুদ্রসৈকত কাছাকাছি হওয়ায় পর্যটকদের যাত্রাপথও হবে মসৃণ। এমনকি উত্তরবঙ্গের সঙ্গেও বন্দর নগরীর সংযোগ তৈরি হবে। যোগাযোগ অবকাঠামোর ক্ষেত্রে এই একটি প্রকল্প যে পরিবর্তন আনবে তা খুব দ্রুতই দৃশ্যমান হয়ে উঠবে।

যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে অবধারিতভাবেই পর্যটনখাতের উন্নয়ন হবে। পর্যটন আমাদের দেশে সম্ভাবনাময় একটি খাত। সম্প্রতি সরকার এ খাতের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে শুরু করেছে। চট্টগ্রামের অনেক অঞ্চলেই পর্যটকদের যাতায়াত তুলনামূলক কঠিন ছিল, কিন্তু যোগাযোগব্যবস্থায় এরকম মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ায় এই অঞ্চলে পর্যটকদের ভিড় বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন হলে পর্যটন খাত নানাভাবে লাভবান হয়। তবে পর্যটন খাতের উন্নয়নের জন্য সঠিক পর্যটন অবকাঠামোও নির্মাণ করা জরুরি। যদি তা করা সম্ভব হয়, তাহলে এ খাতেও আমরা লাভবান হতে পারি। বিদেশি পর্যটকরাও আসবে। স্থানীয় মানুষরা নানাভাবে আয়ের সুযোগ পাবে। পর্যটন খাত থেকে বিদেশি আয় আকর্ষণের এই সুযোগটিও আমাদের জন্য একটি বড় বিষয়।

পর্যটনখাতের পাশাপাশি শিল্প ও বাণিজ্য খাতেও আমরা উন্নয়নের সম্ভাবনা দেখছি। কর্ণফুলী টানেলকে কেন্দ্র করে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে কর্মসংস্থান বাড়বে। বিশেষত যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন হওয়ায় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য বিপণন, পণ্য রপ্তানি এবং কাঁচামাল আমদানিতে বিশেষ সুবিধা পাবে। বিশেষত আমাদের তৈরি পোশাক শিল্প খাত বেশি লাভবান হবে। চট্টগ্রামে বহু আগে থেকেই তৈরি পোশাক শিল্পের কারখানা রয়েছে। কিন্তু এই টানেলের উদ্বোধনের মাধ্যমে যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাও সহজে যাতায়াত করতে পারবে। আগের মতো ঘুরতি পথে বা অতিরিক্ত পথে যেহেতু পণ্য পরিবহন কিংবা যাতায়াত করতে হবে না, তাই বিদেশি বিনিয়োগও আকৃষ্ট হবে। অর্থাৎ শিল্পখাতের অসংখ্য সম্ভাবনা এখানে রয়েছে। মূলত বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি সম্ভাবনার জায়গাটিও দেখানো জরুরি। তৈরি পোশাক শিল্প খাতকে কেন্দ্র করে এখানে পরিবেশ সংবেদনশীল ইকোনমিক পার্ক গড়ে উঠতে পারে। আমরা দেখছি, চট্টগ্রামে ইকোনমিক জোন সমাপ্তির পথে। তা ছাড়া চট্টগ্রামে একাধিক মেগাপ্রকল্প নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সেগুলোও উদ্বোধন হচ্ছে। এই মেগাপ্রকল্পগুলো সমন্বিতভাবে আমাদের অসংখ্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে। কর্ণফুলী টানেল এখানে একটি হাব হিসেবে কাজ করছে। যেমনটি বলেছি, এত বড় প্রকল্পের সুফল দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় প্রথমেই মন্তব্য করা যায় না। কিন্তু সম্ভাবনাগুলো অনিবার্য হলে তা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

কর্ণফুলী টানেল উদ্বোধন হওয়ায় দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং পার্শ্ববর্তী বড় জেলাগুলোর বাসিন্দা এর সুফল ভোগ করবেন। শুরুতে প্রকল্পটি এই অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের পথ মসৃণ করবে। তবে দীর্ঘমেয়াদে আমাদের প্রত্যাশাÑ এই টানেলকে ঘিরে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষিত হবে। শুধু বিদেশি বিনিয়োগই নয়, বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান, কারখানা ও বাণিজ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক গতিসহ অনেক দিকেই লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। যদি তা সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকের সদিচ্ছার মাধ্যমে করা সম্ভব হয়, তাহলে বলা সম্ভব হবে এই অবকাঠামোগত উন্নয়ন আমাদের টেকসই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। কর্ণফুলী টানেলকে ঘিরে যে উন্নয়নগুলো নিশ্চিত হবে তা যদি বিদেশিদের সামনে তুলে ধরতে পারি, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। ফলে বাড়বে জিডিপি। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ প্রতিটি দেশের জন্যই জরুরি। জরুরি অর্থনীতিকে গতিশীল রাখা। আপাতদৃষ্টে এই প্রকল্প আমাদের নানা সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে। আমরা সব সম্ভাবনাকে ধরতে চাই। করতে চাই বাস্তব। 

লেখক : সভাপতি, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত