সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একদা লিখেছিলেন- ‘কেউ কথা রাখেনি’... ব্রাজিল অবশ্য হেঁটেছে বিপরীত পথে, ঠিকই কথা(!) রেখেছে ব্রাজিল। শিরোপা জয়ের ‘হেক্সা মিশন’ দিয়ে না পারলেও, অনাকাঙ্ক্ষিত একভাবে আজ ‘হেক্সা’ জয় করেছে ব্রাজিল।
একের পর এক হারে ২০২৬ বিশ্বকাপের কনমেবল অঞ্চলের বাছাইয়ের দলগুলোর পয়েন্ট তালিকার নিচে নামতে নামতে ‘ছয়ে’ চলে যাওয়ার মাধ্যমে সমর্থকদের অনাকাঙ্ক্ষিত ও লজ্জার এক ‘হেক্সা’ উপহার দিয়েছে ব্রাজিল।
৬ ম্যাচে ১৫ পয়েন্ট নিয়ে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে রয়েছে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। ২ পয়েন্ট কম নিয়ে টেবিলের দুইয়ে উরুগুয়ে। ১২ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের তিনে রয়েছে কলম্বিয়া। চার ও পাঁচ নম্বরে রয়েছে যথাক্রমে ভেনেজুয়েলা ও ইকুয়েডর। আর সমান সংখ্যক ম্যাচে ৭ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের ছয়ে অবস্থান করছে ব্রাজিল।
পয়েন্ট টেবিলে ব্রাজিলের এই ‘হেক্সা’ অবনমন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেসবুকে বয়ে যাচ্ছে আর্জেন্টিনা সমর্থকদের ট্রলের বন্যা-
শামস রাশীদ জয় নামে একজন ‘মেসিভক্ত’ লিখেছেন, “বিশ্বকাপ বাছাইয়ে দক্ষিণ আমেরিকার পরবর্তী ম্যাচগুলো হবে (পরের বছরের) সেপ্টেম্বরে। মানে, আগামী দশ মাস ধরে ব্রাজিল থাকবে ৬ নম্বর অবস্থানে। উফ, কি যে কষ্ট লাগছে”।
ট্রলের পাশাপাশি আর্জেন্টিনার সমর্থনে আজকের ম্যাচ নিয়ে একটি হৃদয়স্পর্শী লেখা ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে, যা তুলে ধরা হলো-
এই আর্জেন্টিনা অন্যরকম এক দল। এরা শুধু মাঠে ১১ জন খেলে না। ডাগ আউটের বাকি ১২ জনও নয়। আর্জেন্টিনা ‘দল’ মানে খেলোয়াড়-কোচ-সমর্থক সব মিলেমিশে একাকার। আজ যখন ব্রাজিলের সমর্থক আর দাঙ্গা পুলিশ আর্জেন্টিনা সমর্থকদের ওপর চড়াও হয়েছে, বেদম মারপিট করেছে; এমি মার্টিনেজ, ডি পলরা ছুটে গেছেন সেই সমর্থকদের পাশে। উঁচু দেয়াল বাধা হয়ে ছিল, না হলে গ্যালারিতেই উঠে গিয়ে সমর্থকদের বুক পেতে আগলে রাখতেন।
মেসি অধিনায়ক থেকে নেতা হয়ে উঠেছেন অনেক আগেই। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদে মেসি পুরো দলকে নিয়ে মাঠ ছেড়েছেন। তিন পয়েন্টের চেয়ে সমর্থকদের নিরাপত্তা তার কাছে অনেক বেশি। সমর্থকদের এক ফোঁটা রক্তের দাম ব্রাজিলের বিপক্ষে জয়ের চেয়েও তার কাছে মূল্যবান।
আধঘণ্টা পরে খেলা শুরু হলে মাঠেও ব্রাজিল চড়াও হয়েছে। ২৬টা ফাউল, তিনটা হলুদ কার্ড আর একটা লাল কার্ড দেখেছে ব্রাজিল। এই ব্রাজিল কুৎসিত, ছন্নছাড়া। টানা তিন ম্যাচ হারল এককালের জমিদারেরা। পয়েন্ট টেবিলের এখন ছয় নম্বরে।
পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থাকা আর্জেন্টিনা জয়ের পর আবার ছুটে গেছে সেই সমর্থকদের কাছে। নেচে গেয়ে উদ্যাপন করেছে তাদের সঙ্গে। এই সমর্থকেরা দলের কঠিন দুঃসময়েও জুগিয়েছে অকুণ্ঠ সমর্থন। দীর্ঘ শিরোপাখরাতেও দিয়েছে শর্তহীন ভালোবাসা। আজ তাদের রক্ত ঝরেছে। সেই রক্তের প্রতিশোধই এই ১-০ গোলের জয়।
সবাই ম্যাচ শেষে একসাথে গেয়েছে ‘মুচাচস’, কোরাসে গলা মিলিয়ে বলেছে:
No te lo puedo explicar
porque no vas a entender
(I can't explain it to you,
Because you won't understand)
কেনো এই আর্জেন্টিনাকে আমরা ভালোবাসি তার ব্যাখ্যা তোমাদের দিতে যাব না। কারণ তোমরা তা বুঝবে না!
প্রসঙ্গত, মারাকানায় ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনার ম্যাচ শুরু হওয়ার সব আনুষ্ঠানিকতা শেষেই শুরু হয় প্রথম ঝামেলা। ব্রাজিলের মারাকানায় উপস্থিত আর্জেন্টিনার সমর্থকদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে ব্রাজিলের সমর্থকরা। দ্রুতই সেখানে ছুটে যান স্থানীয় পুলিশের সদস্যরা, ভিডিওতে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের পেটাতে দেখা যায় পুলিশদের। ঘটনার জের ধরে আর্জেন্টিনা অধিনায়ক লিওনেল মেসি পুরো দল নিয়ে চলে যান ড্রেসিংরুমে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান ম্যাচের লাইভ বিবরণীতে জানায়, আর্জেন্টিনার জাতীয় সংগীত চলাকালে ব্রাজিলের সমর্থকেরা দুয়ো দিতে শুরু করলে ঝামেলার শুরু হয়। আর্জেন্টিনা দলের সদস্যরা এবং ব্রাজিলের অধিনায়ক মার্কিনিওস দর্শকদের শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন। এরপর মেসির সঙ্গে আর্জেন্টিনার বাকি খেলোয়াড়রা মাঠ ছেড়ে চলে যান।
মারাকানা স্টেডিয়ামে খেলা শুরু হওয়ার আগের এই দাঙ্গা মাঠেও বেশ প্রভাব রাখে। ব্রাজিলের খেলোয়াড়রা শুরু থেকে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের ওপর চড়াও হন, গোটা ম্যাচেই ব্রাজিলের কয়েকজন খেলোয়াড়ের শরীরী ভাষা ছিল ভীষণ আক্রমণাত্মক। ম্যাচের ১৫ মিনিট না গড়াতেই বাজে ট্যাকল করে কার্ড দেখেন ব্রাজিলের গ্যাব্রিয়েল জেসুস এবং রাফিনহা। ৩৪ মিনিটে আবার কার্ড দেখেন ব্রাজিলের কার্লোস অগাস্টো। গোটা ম্যাচে মোট ১৬টি ‘ফাউল’ করে ব্রাজিল।
প্রথমার্ধে ব্রাজিল একমাত্র সুযোগ পায় ৪৪ মিনিটে। এমিলিয়ানো মার্তিনেজ কর্নার কিক পাঞ্চ করলে গ্যাব্রিয়েল মার্তিনেল্লির শট ব্লক করেন আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার।
এরপর ৬৩ মিনিটে জিওভানি লো সেলসোর কর্নার থেকে দারুণ এক হেডে ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণী গোল করেন নিকোলাস ওতামেন্দি, তাতেই নির্ধারিত হয় ঘরের মাঠ মারাকানায় ব্রাজিলের লজ্জার হার।