বাংলায় সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে বহিরাগত মুসলমানদের স্থান ছিল উপরে। বহিরাগত মুসলিমরা ছিলেন ধর্ম প্রচারক, পির, শাসক, সমাজপতি। তারা এদেশে এসে নিজেদেরকে দাবি করতেন সৈয়দ, মির, শেখ, মুঘল, পাঠান, খান ইত্যাদি বংশীয় পদবিতে। এসব পদবি ছিল বাঙালি মুসলমানের কাছে আভিজাত্যের প্রতীক। বাঙালি মুসলিম সমাজে তারা খুবই সমাদৃত ছিলেন। তাদের আগমণ আরব, ইরাক, ইরান, তুরস্ক, উজবেকিস্তান, আফগানিস্তান প্রভৃতি অঞ্চল থেকে। তাদের ভাষা ছিল আরবি-ফারসি-উর্দু। বহিরাগত মুসলমানের নিকট এদেশের ধর্ম, ভাষা ছিল নিন্দনীয়। তাই বাংলায় যত অভিজাত মুসলমান ছিল যেমন সৈয়দজাদা, মিরজাদা, পিরজাদা, নবাবজাদা, জমিদারজাদা, খাজাজাদা তাদের সবার ভাষা ছিল উর্দু।
নবাব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী, নবাব সলিমুল্লাহ, খাজা নাজিমুদ্দিন, খাজা শাহাবুদ্দিন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নূরুল আমিন খান, মোনায়েম খান, মাওলানা আকরাম খাঁ, ফজলুর রহমান (সালমান এফ রহমানের পিতা), হাবিবুল্লাহ বাহারÑ এ রকম অভিজাত মুসলমানদের ভাষা ছিল উর্দু। ভাষা আন্দোলনে বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদদের মধ্যে ভাসানী ব্যতীত সকলেই ছিলেন উর্দুর পক্ষে। মওলানা আকরাম খাঁ বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সভাপতি, খাজা নাজিমুদ্দিন, বগুরার মোহাম্মদ আলী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এ তিন জন বাঙালি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, ফজলুর রহমান ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী, হাবিবুল্লাহ বাহার ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী, খাজা শাহাবুদ্দিন ছিলেন তথ্যমন্ত্রী। এরা বাঙালি হয়েও ছিলেন উর্দুর পক্ষে। ঢাকার নবাব, সরদার ও কুট্টিদের ভাষা ছিল উর্দু। তারা উর্দুর পক্ষে মিছিল করত এবং বাংলা ভাষার পক্ষে যারা মিছিল করত তাদেরকে পিটুনি দিত।
এ কে ফজলুল হক পারিবারিক পরিবেশে ও উচু সমাজে উর্দু, নিচু সমাজে বাংলা ব্যবহার করতেন। ভাষা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা ছিল না। তিনি উর্দুর পক্ষেও ছিলেন, আবার বাংলার পক্ষেও ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী একটি গোষ্ঠী এ সংগ্রামে বড় বড় ব্যক্তির সমর্থন আছে দেখানোর জন্য একটি প্রচারপত্র বিলি করে। এতে ভাষা আন্দোলনের সমর্থনকারী হিসেবে তাঁরা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নামও প্রচার করে। কিন্তু এর প্রতিবাদে ফজলুল হক দৈনিক আজাদে এক বিবৃতি দেন। এ বিবৃতিতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তাঁর সমর্থন আছে বলে যে প্রচারপত্র বিলি করা হচ্ছে তাতে তিনি জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। প্রতিবাদ পত্রে তিনি বলেন, ‘এটা বর্তমান সরকারের সঙ্গে আমার পদাধিকার সংক্রান্ত সম্পর্ক ও প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভাঙ্গন ধরাবার অপচেষ্টা মাত্র।’ তখন তিনি নূরুল আমিন সরকারের ঢাকা হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট জেনারেল ছিলেন। তৃতীয় বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতির ভাষণে মওলানা আকরাম খাঁ বলেন, ‘উর্দু আমাদের মাতৃভাষাও নহে, জাতীয় ভাষাও নহে। কিন্তু ভারতবর্ষে মোছলেম জাতীয়তা রক্ষা ও পুষ্টির জন্য আমাদের উর্দুর দরকার।’
মুসলমানদের কোন সভা-সমিতি-সেমিনার হলে সেখানে উর্দু ভাষা ব্যবহার করা হতো। বাংলার মুসলিমদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব ও খবরদারি সবই ছিল উর্দুভাষীদের করায়াত্তে। বাংলা ভাষা ও বাংলাভাষী মুসলমানদের তারা হীন. দীন ও নীচ মনে করত। তাছাড়া দেশের মক্তব-মাদ্রাসায় ও ওয়াজ মাহফিলে উর্দুর বেশ প্রচলন ছিল। পূর্ব বাংলার সহস্রাধিক মক্তব-মাদরাসায় বহু মৌলবি-মাওলানা ও তালবে-এলেম উর্দু ভাষায় মোটামুটিভাবে পারদর্শিতা লাভ করেন। সমাজের মোল্লা-মৌলবি ও অভিজাতদের নিকট বাংলা ভাষায় বিদ্যাশিক্ষা অর্জনকে পাপ কাজ মনে করতেন। এ ব্যাপারে মীর মশাররফ হোসেন তাঁর ‘আমার জীবনী’ গ্রন্থে বলেন, ‘মুন্সী সাহেব (তাঁর ছোট বেলার শিক্ষক) বাঙ্গালা অক্ষর লিখিতে জানিতেন না।.... বাঙ্গালা বিদ্যাকে নিতান্ত ঘৃণার চক্ষে দেখিতেন।.... আমার পূজনীয় পিতা বাঙ্গালার একটি অক্ষরও লিখিতে পারিতেন না।’ উনিশ শতকের ভারতের ওহাবি আন্দোলনের ঢেউ বাংলায়ও এসে পড়ে। ওহাবি আন্দোলনের বাহন ছিল উর্দু, ওহাবি নেতৃবৃন্দের ভাষা ছিল উর্দু। এতে উর্দুর প্রতি সহানুভূতি ও বাংলার প্রতি ঘৃণা বৃদ্ধি পায়। মুসলমানরা যে সব পত্রিকা বের করত তাদের নাম ছিল আরবি-ফারসি-উর্দুতে, বাংলায় নয়। যেমন সওগাত, আজাদ, মিল্লাত, মোহাম্মদী, ইত্তেহাদ, ইত্তেফাক, নওবেলাল, নবনূর, কোহিনূর, আজীজন নেহার, হাফেজ ইত্যাদি। মুসলমানদের ঝোঁক যে উর্দুর প্রতি এ সব নাম থেকেই তা অনুধাবন করা যায়।
১৮৩৮ সালে ইংরেজি রাষ্ট্রভাষা হলে মুসলমানরা তা গ্রহণ করেনি। ১৮৫৫ সালে ৮ মে কলকাতায় তারা আঞ্জুমানে ইসলাম নামে একটি মুসলিম সংগঠন গড়ে তোলেন। এটি ছিল বাংলার মুসলমানদের প্রথম সংগঠন। এর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজদের বিরোধিতা না করে তাদের সহযোগিতা করা এবং তাদের কাছ থেকে মুসলমানদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা আদায় করা। তবে সে সহযোগিতা ভাষার প্রশ্নে নয়। ভাষার প্রশ্নে তারা ফারসি ও উর্দুকে আঁকড়ে ধরে থাকেন। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি মাসে আঞ্জুমানের সভা অনুষ্ঠিত হতো। সভায় প্রবন্ধ পাঠ ও আলোচনা হতো। সভায় বাংলা ভাষা ব্যবহারের অনুমোদন ছিল না। এ সংগঠনের অনুমোদিত ভাষা ছিল ফারসি ও উর্দু। প্রবন্ধ লেখা এবং তা নিয়ে আলোচনা হতো ফারসি বা উর্দুতে। সভার কার্যবিবরণী লেখা হতো ফারসিতে। দূরবীন নামে এ সংগঠনের একটি পত্রিকা ছিল। বাংলার জেলা ও মফস্বল শহরগুলোতে আঞ্জুমানে ইসলাম, আঞ্জুমানে ইসলামিয়া নামে বহুসংখ্যক সমিতি গড়ে উঠে। ১৯০৫ সালে কলকাতায় মুসলমানদের বেওয়ারিশ লাশ দাফনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম। এ সব সমিতি ও প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালিত হতো উর্দু ভাষায়। ফলে উর্দুভাষা শহুরে মুসলমানদের নিকট জনপ্রিয় হতে থাকে।
বাংলার মুসলমানদের মধ্যে নবাব আবদুল লতিফ ছিলেন অগ্রগামী, তবে রক্ষণশীল। তিনি আর্থিক সুবিধার জন্য ইংরেজি শিক্ষার পক্ষপাতী থাকলে তিনি মনে করতেন শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত উর্দু। ১৮৬৩ সালে তিনি ‘মোহামেডান লিটারারি মোমাইটি’ নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এ সোসাইটির উদ্দেশ্য ছিল আরবি, ফারসি, উর্দু ও ইংরেজির মাধ্যমে নানা প্রকার আলোচনা করা এবং সভাসমিতির মাধ্যমে উচ্চ শ্রেণির মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসার ঘটানো। তিনি ছিলেন ঘোর বাংলা বিরোধী। তাঁর সোসাইটিতে বাংলা ভাষা এবং সাধারণ মুসলমানদের কোনো স্থান ছিল না। সোসাইটির সভ্যরা ছিলেন উর্দুভাষী অভিজাত মুসলমান। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার চেয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা প্রবর্তনের পক্ষে বেশি কাজ করেছেন। হান্টার শিক্ষা কমিশন আবদুল লতিফের কাছে জানতে চেয়েছিল বাংলা ও বিহারের মুসলমানদের শিক্ষা দেওয়া হবে কোন ভাষায়? উচ্চ ও মধ্যবিত্ত মুসলমানদের শিক্ষার মাধ্যম হবে উর্দু। তবে নিম্নশ্রেণির মুসলমান যারা জাতিগতভাবে হিন্দুদের থেকে পৃথক নয়, তাদের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাভাষায় শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে। সে জন্য বাংলাকে আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দ দ্বারা পরিশুদ্ধ করা প্রয়োজন। তবে হিন্দু ও সংস্কৃত প্রভাবিত বাংলায় নয়।
মুসলমানদের একটি গ্রুপ মধ্যযুগ থেকে আরবি হরফে বাংলা চর্চা করে আসছেন। আরবি হরফে মধ্যযুগের অনেক বাংলা পুঁথি পাওয়া যায়। যেমন ষোলো শতকের লেখা মোজাম্মিলের ‘নীতিশাস্ত্রবার্তা, সতেরো শতকের মোহাম্মদ খানের ‘মক্তুল হোসেন’, আরাওলের ‘তোহফা প্রভৃতি আরবি হরফে বাংলা পুঁথি পাওয়া গেছে। ১২২৩ মঘি অব্দে ফয়জুল্লাহ আরবি হরফে ফকির গরিবুল্লাহর ‘ইউসুফ জুলেখা’ অনুলিপি করেন, তেমনি ১২২৫ মঘি অব্দে শের জামাল খাঁ করেন আলী রাজার ‘জ্ঞানসাগর’। আরবি প্রচলনের জন্য চট্টগ্রামের মওলানা জুলফিকার আলী ১৯২৮ সাল থেকে বিশ বছরের অধিক সময় ধরে আরবি হরফে ‘হুরুফুল কুরআন’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ এবং তা বিনামূল্যে বিতরণ করে যাচ্ছেন। মওলানা জুলফিকার আলী প্রতিষ্ঠা করেন ‘হুরুফুল কুরআন সমিতি’। এর সাথে যুক্ত হন ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ওসমান গণি, আরমানিটোলা স্কুলের মওলানা আবদুর রহমান বেখুদ। উদ্দেশ্য আরবি হরফে বাংলা প্রবর্তন।
পাকিস্তানের গণপরিষদের ভাষা ছিল দুইটিÑ ইংরেজি ও উর্দু। গণপরিষদে বাঙালি সদস্যগণেরও বাংলায় কথা বলার অধিকার ছিল না। অথচ গণপরিষদে পূর্ব বাংলার বাঙালি সদস্য ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রথম গণপরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৬৯। এর মধ্যে পূর্ব বাংলার সদস্য সংখ্যা ছিল ৪৪ জন। পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশ মিলে ছিল মাত্র ২৫ জন সদস্য। ৬৯ জনের মধ্যে ১৫ জন ছিল অমুসলমান সদস্য। ১৫ জনের মধ্যে ১৩ জন ছিলেন পূর্ব বাংলা থেকে। ১৩ জনের মধ্যে ৯ জন ছিলেন কংগ্রেস দলের এবং বাকি ৪ জন ছিলেন তফশিলি সম্প্রদায়ের। কংগ্রেস ছিল গণপরিষদের বিরোধী দল। তফশিলি সম্প্রদায় ছিল সরকার সমর্থক। যা-হোক, ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের ভারপ্রাপ্ত বিরোধীদলীয় নেতা কংগ্রেস দলীয় সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮৬-১৯৭১) গণপরিষদ অধিবেশনে এক সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তাঁর প্রস্তাবটি ছিল ইংরেজি ও উর্দুর সাথে বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা করা হোক। কেননা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের ভাষা বাংলা। আর উর্দু পাকিস্তানের কোন অঞ্চলের ভাষা নয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশোধনীর উপর আলোচনা হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পাশাপাশি কংগ্রেস দলীয় সদস্য প্রেম হরি বর্ম, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত, শ্রীসচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলার পক্ষে জোরোলো যুক্তি তুলে ধরেন। তুমুল বিতর্কের পর প্রস্তাবটি অগ্রাহ্য হয়। পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগের বাঙালি সদস্যরাই তাঁর প্রস্তাবটি সমর্থন করেননি। অথচ তারাই ছিলেন গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাঙালি সদস্যগণ যদি সেদিন চাইতেন তাহলে বাংলা অনায়সে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হয়। এর জন্য আন্দোলনেরও দরকার হতো না, রক্তক্ষয়ও হতো না।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস, সম্পাদক, এনসিটিবি