বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তির সম্প্রসারণে গত কয়েক বছরে এমনিতেই ই-কমার্সের বাজার একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছিল, মাঝে করোনার কারণে এই গতি আরও তরাণি¦ত হয়। ই-কমার্স এখন সময়ের চাহিদা। আমাদের কাজের চাপে কোথাও প্রয়োজনীয় সময় দেওয়া হয় না। তখনই প্রয়োজন হয় ই-কমার্সের। সব ঝামেলা এড়িয়ে আমাদের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছে চাহিদামাফিক পণ্য।
প্রয়োজনের তাগিদ সেটা ভোক্তা এবং বিক্রেতা উভয়ের ক্ষেত্রেই এই ক্ষেত্রকে আরও প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছে। অনেকেই বুঝতে পেরেছে চাকরির বাজারে না ছুটে অনায়াসেই ঘরে বসেই ব্যবসা করা যায়। সেই অভ্যাসটা করোনার পরেও রয়ে গেছে। আজ ই-কমার্সের আওতায় এসেছে সবধরনের পণ্যই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শুধু ই-কমার্সের কারণেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং প্রচুর সংখ্যক তরুণ-তরুণী এখানে কাজ করছে। আগামী ২০২৬ সালে বাংলাদেশে ই-কর্মাসের বাজার ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার হবে বলে ধারণা করছে ই-কর্মাস খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠন বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়, বর্তমানে দেশে ই-কর্মাসের বাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। দেশীয় টাকায় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রির্চাস অ্যান্ড মার্কেট ডট কমের মতো ২০২৬ সালের দেশে ই-কর্মাসের বাজার হবে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এটি আরও বাড়তে পারে। কারণ দেশের মাত্র ১.৩ শতাংশ ই-কর্মাস থেকে পণ্য ক্রয় করেন।
অথচ দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সংখ্যা ১৩ কোটি। তবে এর পাশাপাশি কিছুটা শংকাও রয়েছে। সেটি হলো বিশ্বস্ততার শঙ্কা। কারণ সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশে ৩২টি ই-কর্মাস প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহকের পাওনা ৫৩১ কোটি টাকা। তারমধ্যে ১৮টি প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়নি। গ্রাহকরা টাকা ফেরত পেয়েছে ৩৮৭ কোটি টাকা। আর ১৪৪ কোটি টাকা ফেরতের আসায় ধারে-ধারে ঘুরছে ভুক্তভোগী গ্রাহকরা। গ্রাহক যদি প্রতারিত হতে থাকে তাহলে অনলাইন কেনাকাটায় মানুষ উৎসাহ হারাবে। সুতরাং এই জায়গায় আরও বেশি সতর্ক হতে হবে। বাংলাদেশে ই-কমার্সের বাজার প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের। দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ওপর। দেশের সার্বিক খুচরা বিক্রির মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশের হিস্যা ই-কমার্সের। এশিয়া মহাদেশের মধ্যেই ভারতে এই হার প্রায় ৭ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ১৪ শতাংশ, চীনে ৩০ শতাংশ।
ই-কমার্স বর্তমান সময়ের ব্যবসা খাতকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি তৈরি করছে নতুন উদ্যোক্তা এবং বেকারত্ব দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বলা যায়, ই-কমার্স স্বপ্ন দেখাচ্ছে। যখন বিশ^ব্যাপী বেকারত্ব নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে সেখানে ই-কমার্স খাত এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে। তরুণ উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি যোগ হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা। ফলে এই খাত আরও শক্তিশালী হচ্ছে। এটা সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থাৎ গতিশীল প্রক্রিয়া। দক্ষ তরুণ-তরুণী যখন চাকরির পেছনে হন্য হয়ে ঘুরছে তখন নতুন কিছু করার তাগিদে অনেকেই ই-কমার্সের মাধ্যমে সাবলম্বীল হওয়ার চেষ্টা করছেন। যদিও এখানে পথটা সহজ নয়। অর্থাৎ অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায় ক্রেতাকে বিশ^াস করানোর কাজটি কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং বিষয়। তবে অনেকেই এখানে সফল হচ্ছেন এবং নিজের পণ্য ক্রেতার কাছে পৌছে দিচ্ছেন। ক্রেতারারও আস্থার সাথেই পণ্যটি কিনছেন। যদিও কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগ আসছে। সে তো প্রত্যক্ষ কেনাকাটাতেও আসে। এসব বাদ দিলে অনলাইনে ব্যবসা সত্যিকার অর্থেই জনপ্রিয়। গতানুগতি পদ্ধতি পার করে বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে এগিয়ে চলেছে। আবার এই ডিজিটালাইজেশন থেকে আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে।
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের স্মার্ট ব্যবসায়ের ধারণা থাকতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে প্রযুক্তিতে। ই-কমার্সের পুরোটাই প্রযুক্তি নির্ভর। যারা প্রযুক্তিতে দক্ষ নন তারা যখন ঘরে বসে থেকে হা-হুতাশ করছেন তখন একজন দক্ষ মানুষ অনায়াসেই ঘরে বসেই ব্যবসার কাজটি সেরে নিচ্ছেন। তার নিজস্ব ক্রেতা তৈরি করছেন। একবার যদি নিজস্ব কিছু ক্রেতা তৈরি করা যায় তাহলে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। আজ শিক্ষা থেকে শুরু করে কেনাকাটা সবক্ষেত্রেই ডিজিটাল পদ্ধতির প্রয়োগ করা হচ্ছে। ডিজিটালাইজেশনের জন্য একদিকে যেমন দ্রুততর হচ্ছে অন্যদিকে নতুন নতুন খাতে কর্মসংস্থান সম্ভব হচ্ছে। আমি যদি ঘরে বসেই হাতে নিশ্চিত এবং আমার চাহিদার মান সম্পন্ন পণ্য পেতে পারি তাহলে এই ব্যস্ততার সময়ে বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়া, বাইরের অনিরাপত্তা বা সময় অন্য কাজে লাগানো এসবের সাথে নতুন করার চেষ্টা যেখানে নিত্যনতুন তরুণ-তরুণী যোগ হচ্ছে এসবই ই-কমার্স খাতকে এগিয়ে নিচ্ছে।
ডিজিটালাইজেশনের যুগে এ খাত ভবিষ্যতে আরও অনেক বেশি শক্তিশালী হবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই স্মার্ট ব্যবসায় শিক্ষিত তরুণ তরুণীরা আসছেন প্রযুক্তির সুবিধা কাজে লাগিয়ে। সাফল্য পেতে প্রয়োজন ধৈয্য এবং একাগ্রতা এবং পরিশ্রমী হওয়া। এটা আমাদের গতানুগতিক বাজার এবং ক্রয় বিক্রয়ের ধারণা থেকে ভিন্ন। কারন এখানে ক্রেতাকে সরাসরি পণ্যটি কেনার জন্য আসতে হয় না। বাইরে বের না হয়ে ঘরে বসে পণ্য কেনার আনন্দই অন্যরকম। আমরা কতটা আধুনিক হচ্ছি তার প্রমাণও এই ই-কমার্স। শহর থেকে শুরু হয়ে এটা এখন গ্রামেও অনেক শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণী ই-কমার্সের মাধ্যমে নিজের অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত করছে। চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেই নিজের ব্যবসা দাড় করাচ্ছে। এটা অনলাইনে পণ্য কেনা বেচার একটি আধুনিক মাধ্যম যেখানে অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে।
নারী উদ্যোক্তারাও ই-কমার্সে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করছেন। লাখ লাখ নারী উদ্যোক্তা ফেসবুকে তাদের পণ্য বিক্রি করছেন। এতে একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে ই-কমার্স মানুষের আস্থা অর্জন করছে। এই আস্থার জায়গা ধরে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জের। করোনাকালে ই-কমার্সের যে দ্রুত অগ্রগতি ঘটেছে সেই ধারা বজায় থাকলে আগামী কয়েক বছরে এই খাত কর্মসংস্থানের একটি বড় উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। চাকরির বাজারে চাপ কমবে এবং আত্ননির্ভরশীল হতে সাহায্য করবে। এক্ষেত্রে কিছু ক্ষেত্রে ক্রেতাদের অভিযোগ রয়েছে। যে পণ্যটি ক্রেতা অর্ডার করছে তা পাচ্ছে না। তার বদলে অন্য নিন্মমানের পণ্য দেওয়া হচ্ছে। আবার পণ্য অর্ডার দিয়ে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এসবের প্রতিকারও এখন হচ্ছে। ই-কমার্স বা অনলাইনে ব্যবসার ধারণাটিতে অন্যান্য দেশ অনেক এগিয়ে গেছে। করোনাকালীন সময়ে দেশে বেকার সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে। এই সমস্যার সমাধানে চাকরির নতুন খাত সৃষ্টি করা যথেষ্ট নয়। বরং উদ্যোক্তা তৈরিতে উৎসাহ দিয়ে নিজে আত্ননির্ভরশীল হওয়ার মাধ্যমে আর একাধিক বেকারের সংস্থান করার উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে ই-কমার্স যা করছে তা হলো একজন উদ্যোক্তা তৈরি করছে, ব্যবসায়ে উদ্বুদ্ধ করছে এবং আরও অনেককে এ খাতে উৎসাহিত করছে।
দেশের ই-কমার্স খাতের ইতিহাস প্রায় এক যুগের। সেখান থেকে শুরু হয়ে আজকের পর্যায়ে পৌঁছেছে। সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি অর্জন করেছে করেনাকালীন সময়ে। এই অগ্রগতি এখন আরও দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এ খাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে।
অনলাইনে অর্ডার দিয়ে আমরা কি পাচ্ছি না। নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুই পাচ্ছি বাড়িতে বসে। খাবার পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছে আমাদের কাছে। ব্যস্ত জীবনের এই সময়ে অনেক ঘুরে একটি পণ্য পছন্দ করার সময় কোথায়। তার চেয়ে ঘরে বসে, অবসরে নির্ধারিত সাইটে ঢুকে পছন্দ মতো পণ্য অর্ডার করলেই এত ঝামেলা পোহাতে হয় না। প্রয়োজনীয় পণ্যের সবকিছুই এখন ই-কমার্সের আওতায় রয়েছে। এই খাতে আস্থা আরো শক্তিশালী করতে হবে। কারণ ক্রেতাদের আস্থাই এখানে মুখ্য। একটি পণ্য সরাসরি না দেখে ফেসবুক বা সেই প্রতিষ্ঠানে সাইটে ভিজিট করে দেখে ক্রেতা অর্ডার করছে। সুতরাং এর গুণগতমান হতে হবে ক্রেতার আশানুরুপ। কারণ ব্যবসায়ের প্রাণ হলো ক্রেতা এবং ক্রেতার আস্থা।
ই-কমার্স থেকে যেন ক্রেতা প্রতারিত না হন সেজন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আসতে বাধ্য করতে হবে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে দুই বছর আগে চালু হয়েছে ডিজিটাল বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন (ডিবিআইডি) কার্যক্রম। গ্রাহক প্রতারণা ঠেকাতে এই কার্যক্রম চালু করা হলেও অধিকাংশ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানই এখনো রয়ে গেছে শনাক্তকরণের বাইরে। নাগরিক জীবনে ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় ই-কমার্সের ওপর ঝুঁকছে বহু মানুষ। সেক্ষেত্রে মানুষের সাথে প্রতারণার বড় সুযোগও রয়েছে এ খাতেই। গ্রাহকের টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে কম ঘটছে না। এরকম হলে ক্রেতা তার আস্থা হারাতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সম্ভাবনাময় একটি ব্যবসা খাত যা বিশ্ববাজারকে প্রভাবিত করতে পারে। ভবিষ্যত অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে ই-কমার্স খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রচুর কর্মসংস্থান এবং ব্যবসার নতুনত্ব এই দুইয়ে ই-কমার্স ক্রমেই এগিয়ে যাবে। ফলে ক্রেতার স্বার্থ প্রাধান্য দিয়ে তারা যেন প্রতারণার শিকার না হন, হয়রানির ঘটনা না ঘটে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট