চামেলী খাতুন কবিতা-কন্যা-কানন এ ত্রিমোহনায় যথেষ্ট ঘাম ঝরিয়েছেন; ‘ঈশ্বরের প্রতিরূপ’ কাব্যগ্রন্থটি পঠনে আমার মনে হচ্ছে- তার কবিতাগুলো নিরেট, পাথুরে শব্দ দিয়ে মহাকাল-কাঠামো সৃষ্টির অসাধ্য সাধন, সেক্ষেত্রে তিনি সফলও হয়েছেন। তার নিরলস চেষ্টায় কবিতাগুলোকে ভাঙা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে- ভাঙা যেহেতু কঠিন, সেহেতু কাব্যগ্রন্থটির স্থায়িত্ব নিয়ে আমি অনেকটাই আশাবাদী।
জিজ্ঞেস করলাম- আপনাকে ভাঙি কী দিয়ে? বিনয়ের সুরে জানালেন- ভাঙা জিনিসকে কীভাবে ভাঙবেন? বললাম- সব কবিতার স্রোতই তো মহাকালের দিকে বয়ে যাচ্ছে? আবারো স্বতস্ফূর্ত জবাব- যাক সেদিকে খুশি। কবিতার ভেতরটা নরম, অন্তর্দহন আছে, জীবনের অনিশ্চিতার বাঁকে হারিয়ে যাওয়া শত শত সত্তা তিনি একাই বুকে ধারণ করেন এবং নিজেও প্রস্তুতির প্রহর গুনছেন। তার প্রতিটি কবিতা কাল, কালযাপন, মহাকালের মহাগর্তে মহানাশ- এমন এক মহাবার্তা দিচ্ছে।
কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘তুমি আসবে নিশ্চয়ই’; এখানে রয়েছে অনুভূতির তীব্রতার ঘোড়দৌড়, আছে সুখ-দুখের দোলাচল, তবুও কেন তার আসার নিশ্চয়তার মধ্যে অনিশ্চয়তা কেন বড় হয়ে উঠল; কিংবা এসেও হারিয়ে যাওয়ার দিকটিও বাতলে দিলে- ‘আলিঙ্গন করে নিবে একমুঠো তপ্ত অন্নের ধোঁয়া।’ নাই কেন নিশ্চয়তা, নাই স্থায়িত্ব, ক্ষণিকের যাপন নিয়ে ভেতরের কোমলতা ও হাহাকারের দিকটিই তার নিরাশাবাদী নয়নযুগলে ধরা পড়েছে।
দ্বিতীয় কবিতা ‘শুকনো মরুর বুকে সিন্ধুর শতদল’। শিরোনামটিতে আশাবাদী চাহনি থাকলেও কোথাও ক্ষুব্দ ব্যথা টগবগ করে ফুটছে- ‘বিশ্বচেতনার এলবামে ধুলো জমে উঠেছে,/ নিগৃহীত অতিথি দাঁড়িয়ে আছে সীমান্ত ঘেঁষে।’
‘ঈশ্বরের প্রতিরূপ’ কবিতাটিতে প্রচলিত পাপে পুণ্য খুঁজেন কবি এবং প্রচলিত পুণ্যে পাপ- এমন এক মননশীল সত্তা আছে এ কবিতাটিতে। তাই তো কবি অকপটে বলেন- ‘বিকলাঙ্গ শাস্ত্রের ওয়াইনে/একসময় শুনিয়ে যায় অনুদারতার কথা।’ নারীর নতজানু সত্তার বীজ প্রচলিত পললে কে বুনেছে- সেখানেই আঘাত করেছেন কবি অবলীলায়, দুর্দান্ত সাহসিকতায়।
‘ঠিক যখন সন্ধ্যা নামে’ কবিতায় সন্ধ্যা মানে অন্ধকারের হাতছানি, তবুও অন্ধকারে আলো খুঁজেন কবি, হয় তো সে আলো দূরবর্তী কোনো নক্ষত্রের কিংবা এর থেকে আরও কাছের- চাঁদের জোছনার আলো। কিন্তু সব আলোতেই আলতো ছোঁয়া দেয়- জীবনকে ‘নিজভূমে পরবাসীর মতো’ তৈবি করে ‘অন্য মুলুকে অভিবাসন’ কিনতে বাধ্য করে। তবুও জীবন ‘অন্ধগলির অভিশপ্ত পথের বাঁকে’ হারিয়ে যায়। বহমান সময় স্রোতে সাঁতার কাটতে কাটতে ‘বিশ্রামের’ ছলে চিরন্তন ‘পরাজয়’ নিয়ে হারিয়ে যাচ্ছি মহাকালের বুকে।
‘বিশ্বাসের মৃত্যু’ কবিতায় মহামারি ও মানবজীবন এমন এক মহাসংকটের মাঝে ভেতরের বেদনার্ত চাপা আর্তনাদ কুড়ে কুড়ে দংশন করছে, এখানে সংকটকালে বিশ্বমানবতার ইহলৌকিকতা নিয়ে কবি তার ভেতরের অবয়ব বিবর্ণ বর্ণমালায় প্রকাশ করেছেন।
‘নিঝুম রাতের অভিশপ্ত রেলনাইন’ কবিতাটির শব্দচয়নেও অন্ধকার ও মৃত্যুর দেবদূত ‘অভিশপ্ত রেললাইন’ একটা অনিরাপদ জীবনের দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে। অভিশপ্ত রেললাইনে কেউ কাটা পড়ে স্বেচ্ছায়, কেউ বা কাটা পড়ে অবচেতনে। কবিতার শেষে- ‘নবজাতকের ক্রন্দন নতুন সুরে বাজে।’ এখানে মানবজীবনে প্রজন্ম প্রজননের দিকটি উঠে এসেছে। কান্নায়ও সুর আছে, জীবনে সুর আছে- এ দ্বৈত সুর ইহজাগতিকতায় নিরবধি বেজে চলবে প্রজন্ম পরম্পরায়। হয়তো বা এমন আকাক্সক্ষার প্রকাশই পেয়েছে কবিতাটিতে।
‘ঈশ্বরের বরপুত্রদের আস্ফালন’ শিরোনামেই শয়তানের মুখোশ উন্মোচন হয়েছে। যদিও ‘প্যারাডাইস লস্ট’-এর স্যাটার্ন চরিত্রটি আমার প্রিয়। কারণ মহাশক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে চ্যালেঞ্জ করা, মহাশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, আনুগত্য-দাসত্বকে মেনে না নিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জানান দেওয়াসহ দৃঢ়চেতা দিক ফুটে উঠেছে এ চরিত্রটিতে। কিন্তু এ কবিতাটিতে কবি অলীক সত্তার সংখ্যাগুরু পূজারিদের পোংটামি তুলে ধরেছেন- অসীম সাহসিকতায়; একই সঙ্গে কবির নিজস্ব দর্শন ও জীবনবোধের দিকটিও ফুটে উঠেছে।
‘যখন প্রেমিক ছিলে’ কবিতাটিতে প্রেমের পানসে লবণাক্ততা ঠোঁটের কোণে এখনো ঘাম হয়ে ঝরে পড়ে; হয়তো বা এ ঘামই ক্ষণে-বেক্ষণে ‘আরাধ্য’ প্রেমিকের কথা মনে করিয়ে দেয় কবিকে, ‘কোন এক অজানা লালসা’র জলসায় হারিয়ে যায় প্রেমিক, রেখে যায় ক্ষণে-বেক্ষণে বেজে ওঠা হৃদকম্পন, এগুলো শব্দে শব্দে এলিজি হয়ে নীরবে বাজে, এ কম্পিত সুর ও ছন্দ মনে হয় কবির একান্ত নিজের। তবুও কবির প্রেমের পললমন সিক্ত হয়- ঝরেপড়া প্রেমিকের নস্টালজিক অবয়ব মনের কোণে পুষে।
‘প্রত্যাবর্তন’ কবিতায় জীবনের বাঁকবদলে আশা-নিরাশার ঢেউতোলা জাহাজে নিসঙ্গতায়ও ঘিরে ধরে জীবন্ত ঘাতকের মতো; শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে বন্দি সত্তাও ‘অদৃশ্য লোহার শিকলে’ বাঁধা, মুক্তির অহর্নিশ আকুতি নিয়ে ঘুরে-ফিরে ‘শূন্য বালুচরে’, তবুও কাঙ্ক্ষিত মুক্তি মেলে না। নিসঙ্গ সত্তায় বন্দি অতৃপ্ত আত্মা ‘অসীমের পানেই প্রতাবর্তন’ করে।
‘মরা বণ্টনে নগদ হিসাব’ কবিতাটির সার ফুটে উঠেছে মাঝপথে, শকুন-চিলের আত্মায় মোচড়ানো আমাদের সত্তা, তা কবি উল্লেখ করতে ভুল করেননি-
‘মরা বণ্টনের হিসাব চেয়ে-
সন্ধি করেছে শকুন-চিলে;
বাণিজ্যের সওদা লুটপাট করতে-
পাহারাদার আজ গভীর ঘুমে।’
এ সন্ধি হয়তো বা অশুভশক্তির সিন্ডিকেট- আমার চেতন পাঠে তা-ই মনে হয়।
‘বিষাক্ত অণুজীবের সীমাহীন পরাগায়ন’ কবিতাটিতে হয় তো মহামারি করোনাভাইরাসের মতো কোনো অণুজীব চালচিত্র ফুটে উঠেছে। প্রকৃতির সৌন্দর্যে নিজের অবয়বের অবগাহনের ইচ্ছার কথাও রয়েছে এ কাব্যগ্রন্থটিতে। ‘দূর্বাঘাসের ডগায়/ একফোঁটা শিশিরজলে যদি/ পদযুগল ভেজে!’ শিশিরবিন্দুতেই কবিমন কেন আটকে যায়- হয়তো বা কোনো এক অজানা মায়ায়, যাপিত জীবনের নান্দনিক এ মায়া। তবুও আমাদের হারিয়ে যেতে হয় ‘শুকনো পাতার মর্মবাণী’র মতো ‘সীমাহীন গন্তব্যে’। ‘সীমাবদ্ধ বালুচরের নিমন্ত্রিত অতিথি’ হয়ে আশা-নিরাশার ঘূর্ণিপাকে ঘুরছি আর এভাবেই আমরা প্রতিটি সত্তা ‘গন্তব্যহীন পথের বাঁকে একসময় গা এলিয়ে দেই’; এ গন্তব্যহীন যাত্রায় আমরা বাঁধা, শুধু প্রতীক্ষার জীবন নিয়ে বাঁচি আর অপেক্ষা করতে থাকি এ গন্তব্যহীন যাত্রাপথে চলে যাওয়ার।
‘দোদুল্যমান নীল খামের চিঠি‘তে প্রেয়সীর বক্ষজুড়ে শুধু দীর্ঘশ্বাসের করুণ সুর, ‘নিয়মের জালে’ জটলা পাকায় যাপিত জীবনের খণ্ড খণ্ড মুহূর্তগুলোকে। তবুও কেন যেন কবিসত্তায় ‘বাউলের বেশ সারা মনন জুড়ে’- ‘বিপন্ন মায়াবী বিস্ময়’ কবিতায় কবির বাউলা দিকটি আরো বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
কবিমননে সবসময় একটা অতৃপ্ত আত্মার বেপরোয়া ছটফটানি রয়েছে; একজীবনে না মেলে যাপিত জীবনের তৃপ্তি, না মেলে অমরত্বের খোঁদাইকৃত সত্তা বুননের পর্যাপ্ত কালযাপন। কোথায় আটকে আছে ‘বহমান জীবন কালের স্বাক্ষর’; তা অনুসন্ধানে কবি তার আত্মসাধনা ও আত্মানুসন্ধান অব্যাহত রেখেছেন জীবনাচরণের অন্তর্নিহিত দ্যোতনায়। এ আত্মানুসন্ধান ও আত্মাসাধনার অহর্নিশ চেষ্টা প্রতিটি কবিতায় নিরেট পাথুরে অবয়বে দণ্ডায়মান। তার কবিতায় স্থায়িত্ব আছে, জীবনাচরণের অনাহত হাহাকার আছে, জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি সময়ের ডুব-সাঁতারের দ্বান্দ্বিকতা আছে।
সর্বপোরি সত্তার চিরন্তন ডুবে কোথায় হারিয়ে যাব, কী রেখে যাব- এমনই ভাবসাধনার দিকটি রয়েছে কবিমননে। মানবসত্তা ও মানবসভ্যতার ‘বিহ্বল আর্তি’ ‘নিরবধি দেখে যাবে মহাকাল’- এমনই হাহাকার চিত্রিত হয়েছে ‘ঈশ্বরের প্রতিরূপ’ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায়। আমার মনে হচ্ছে, এ কাব্যগ্রন্থটি পাথরের মতো শক্ত ও অক্ষয়।