পটুয়াখালী শহরের পৌরনিউমার্কেটে রহস্যজনক অগ্নিকান্ডে ভষ্মিভূত স্থাপনার জায়গায় নির্মিত কিচেন মার্কেটের স্টল বরাদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে মেয়রের বিরুদ্ধে।
মেয়রের ভাই, ভাইর ছেলে, যুবলীগ নেতা ও বিএনপি নেতার স্ত্রীর নামসহ স্টল বরাদ্দ হয়েছে মসজিদের ইমাম এবং মেয়রের উপদেষ্টাদের নামেও। অথচ প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থরা পাননি স্টল। এমন অভিযোগে আদালতের স্বরনাপন্ন হয়েও কোন কিছুই পাননি ভূক্তভোগিরা। আগামী ৯ মার্চ পটুয়াখালী পৌরসভার নির্বাচন উপলক্ষ্যে ভোটারদের আকৃষ্ট করতে প্রভাবশালীদের নামে স্টল বরাদ্দ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে।
পটুয়াখালী পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী শহর আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি মোঃ এনায়েত হোসেন এমন অভিযোগ করেন- “ভয়াবহ ওই অগ্নিকান্ডে পটুয়াখালী পৌর আওয়ামীলীগের সভাপতি মোঃ শাহ-জালাল খানের কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি, ওই স্থানে আমার ঔষধের দোকান ছিল। তবুও মেয়র মহিউদ্দিন আমাকে স্টল না দিয়ে শাহ-জালালকে দিয়েছেন, তাই আমি শাহ-জালালের স্টলে তালা মেরেছি”।
অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ একাধিক ব্যবসায়ীদের এমন অভিযোগ থাকলেও সঙ্গতকারনে মুখ বন্ধ রেখেছেন তারা। দৌড়ঝাপ করে যারা স্টল পেয়েছেন, তাদের গুনতে হয়েছে স্টল নির্মান ব্যয়ের আড়াই থেকে তিন গুন টাকা। অতিরিক্ত অর্থে স্টল নিতে গিয়ে ঋনসহ পদেপদে হয়রানী হয়েছে কর্মহীন ব্যবসায়ীরা।
অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ আলতাফ আড়তদার, রফিক গাজী, নজরুল ভুয়া, নাসির খন্দকারসহ একাধিক ভুক্তভোগীর অভিযোগ, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে মেয়র মহিউদ্দিন ও তার বন্ধু হাফিজুর রহমান লোকজন নিয়ে শহরের পৌর নিউমাকের্ট বাজারে কিচেন মার্কেট করার ঘোষনা দিয়ে সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিতে মৌখিক নির্দেশ দেন। ব্যবসায়ীরা প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিতে আপত্তি দিলে ৬ অক্টোবর রাতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটে। ওই অগ্নিকান্ডে বাজারের শতধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আংশিক ও সম্পূর্ন ভস্মিভুত হয়।
পরে মেয়র ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে দ্রুত ভবন নির্মানের প্রতিশ্রতি দেন। ওই সময় আগুনে পুড়ে সর্বশান্ত হওয়া ব্যবসায়ীদের মেয়রের কথার বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিলনা বলে দাবি তাদের। পরে টানা তিন বছর ধরে স্টল র্নিমান সম্পন্ন করে স্বজনপ্রীতি শুরু করে স্টল বরাদ্দে। বাজার দর অনুযায়ী ফিটিংস ব্যতীত স্টল নির্মানে প্রতি স্কয়ার ফুটে ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা ব্যয় হলেও বরাদ্দ দিতে নেয়া হচ্ছে তিন গুন অর্থ। এছাড়াও অগ্নিকান্ড ঘটনায় পরপর বিশাল আকারের এই বাজার থেকে অন্তত ২ লাখ ইটসহ আনুসঙ্গিক অনেক নির্মান সামগ্রী উদ্ধার হলেও তা ক্ষতিগ্রস্থদের না দিয়ে ট্রাক ভরে নিয়ে যান মেয়রের লোকজন।
স্টল নির্মান সমাপ্ত হওয়ার আগেই ২০২২ সালের ১৩ এপ্রিল মেয়র খাতে ১৫% সংরক্ষিতসহ ১০৪টি স্টল লটারি পদ্ধতিতে বরাদ্দের ঘোষনা দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। পর্যায়ক্রমে ছোট-বড় অন্তত আড়াইশ স্টল নির্মান হলেও মাত্র ৪০টি লটারি পদ্ধতিতে বরাদ্দ দেন। বাকি স্টল মেয়র তার পছন্দের ব্যক্তিদের নামে বরাদ্দ দেন। এতে বাদ পরে যান প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থরা।
অভিযোগকারীরা বলেন, মেয়র মহিউদ্দিনের বড় ভাই আবুল কালাম আজাদের ছেলে আবিদের নামে এমএস আবিদ মোবাইল জোন, মেয়রের চাচাতো ভাই জেলা বিএনপি নেতা মনির হোসেনের মেয়ে লিমার নামে তুলনা স্টোর, জেলা যুবলীগের সভাপতি শহিদুল ইসলামের স্ত্রী তাসলিমা পারভীনের নামে মেসার্স জুইন এন্টারপ্রাইজ, পৌর আওয়ামীলীগের সভাপতি শাহ-জালাল খান, মেয়রের দুই উপদেষ্টা ফরহাদ জামান বাদল ও কাজী নাসরু তালুকদার, আসলাম ব্যপারী, মজিদ শিকদার, পৌরসভার লাউকাঠি খেয়াঘাটের টোল আদায়কারী রফিকুল ইসলাম রাহাত, মুরগী ব্যবসায়ী খোকন, ডিম ব্যবসায়ী সুভাষ পাল, মনিরুজ্জামান আকন এবং মেয়রের বাসা সংলগ্ন মসজিদের ঈমাম মাওলানা আবদুল কাদেরসহ মেয়রের স্নেহধন্যরা স্টল পেয়েছেন। অথচ অগ্নিকান্ডে এদের কারো কোন প্রতিষ্ঠান বা দোকান ক্ষতিগ্রস্থতো দুরের কথা সেখানে কখনই তাদের কোন প্রতিষ্ঠান বা দোকান ছিলনা। এছাড়াও স্টলের তালিকায় মেয়রের পিএস মিজানুর রহমান এনামুল ও বাসার কাজের লোক মোস্তাফিজুর রহমান বেল্লাল এবং ঘনিষ্টজন আব্দুস সালাম আরিফের নাম শোনা যাচ্ছে।
এদিকে পৌরকর্তৃপক্ষের কাছে স্টল বরাদ্দের তালিকা চাওয়া হলে তারা মেয়রের উপদেষ্টা ফরহাদ জামান বাদলের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। পৌর নির্বাচনে ভোটের রাজনীতি মাথায় রেখে স্বচ্ছল ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের স্টল দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেন ক্ষতিগ্রস্থরা। এরমধ্য ডিম ব্যবসায়ী সুভাষ পাল স্টল নিতে মেয়রকে আনুষ্ঠিকভাকে সোনার নৌকা উপঢৌকন দিয়েছেন। এছাড়াও পটুয়াখালী পৌরপরিষদের ১২ জন কাউন্সিলরকে স্টল দেয়া হয়েছে। এরমধ্য কাউন্সিলর এসএম ফারুক হোসাইন ও কাজল বরন দাসের স্টল চড়াদামে বিক্রি হয়েছে। বাকি কাউন্সিলর ও বিশেষ পদ্ধতিতে পাওয়া স্টল গুলো বিক্রির পায়তারা চালাচ্ছেন তারা।
মামলার বরাদ দিয়ে রফিক গাজী বলেন-স্টল বরাদ্দ নিয়ে উচ্চ আদালতে রীট করলে মেয়র মহিউদ্দিন আহম্মেদকে আদালত নোটিশ করেন। পরে আদালতে হাঝির হয়ে ব্যবসায়ীদের স্টল দেয়ার প্রতিশ্রতি দিয়ে আদালতে মুসলেকা দেন। ওই মুসলেকায় মেয়র বলেন, দোকান বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থদের অগ্রাধিকার এবং জমাকৃত অগ্রীম জামানত নতুন সালামীর সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। অথচ মেয়রের কাছে স্টল চাইতে গেলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে হাইকোর্টে গেছো এখন হাইকোর্ট ঘর দেবেন, আমার কাছে কোন ঘর নাই বলে ফিরিয়ে দেন। রফিক গাজী আরও বলেন-অগ্নিকান্ডের পর মেয়রের ডাকে ব্যবসায়ীরা পৌরসভায় গেলে উপস্থিত লোকজনদের উপস্থিতিতে স্বাক্ষর নেন মেয়র। পরবর্তীতে ওই স্বাক্ষর জাল-জালিয়াতির করে আদালতে উপস্থাপন করেন।
এসব বিষয়ে মেয়র মহিউদ্দিন আহম্মেদ জানান, পটুয়াখালী পৌরসভা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নিউমার্কেটের কিচেন মার্কেট নির্মান করা হয়েছে। তবে এখনও শেষ হয়নি। ভাইর ছেলে আবিদের নামে কোন স্টল বরাদ্ধ নাই। তাছাড়া আবিদ মানষিক প্রতিবন্দি তার কথা কতটুকু কাউন্টাবল? পাল্টা প্রশ্ন করেন তিনি। এছাড়া কাউন্সিলর ও যুবলীগ সভাপতির স্ত্রীর ব্যপারে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।