মঙ্গলবার ১ জুলাই ২০২৫ ১৭ আষাঢ় ১৪৩২
মঙ্গলবার ১ জুলাই ২০২৫
চিনি কলের বিষাক্ত কেমিক্যালে মরছে নদীর মাছ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: বুধবার, ৬ মার্চ, ২০২৪, ১:২৪ PM আপডেট: ০৬.০৩.২০২৪ ৬:১১ PM
চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে এস আলম সুগার মিলের ভেতরে এখনো আগুন জ্বলছে পুরোদমে। ধোঁয়া ছড়াচ্ছে আশপাশে। সুগার মিলের চিনির কাঁচা রাসায়নিকের পোড়া গলিত বর্জ্য কারখানার ড্রেন দিয়ে সোজা কর্ণফুলীতে পড়ছে। এতে নদীর পানিতে বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশে মরে ভেসে উঠছে মাছ।

বুধবার (৬ মার্চ) সকাল ১১টা পর্যন্ত ৪২ ঘণ্টাতেও এস আলম সুগার মিলের ভেতরে আগুনের দাপট কমেনি। এতে আগুন বাইরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা না থাকলেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে আরও লাগবে বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

এর আগে সোমবার (৪ মার্চ) বিকেল ৪টার দিকে এস আলম সুগার রিফাইনারি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পরিশোধনাগারের ১ নম্বর গুদামে আগুন লাগে। গভীর রাত পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। পরে যোগ দেয় নৌ, বিমান ও সেনাবাহিনীর দল। মঙ্গলবার (৫ মার্চ) সকাল থেকে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট আগুন নিভানোর কাজ করে।

এদিকে সকালে সরেজমিনে কর্ণফুলী নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, কেমিক্যাল মিশ্রিত অপরিশোধিত চিনি আগুনে পুড়ে গলে সোজা কর্ণফুলী নদীতে পড়ছে। এরপর নদীতে কেমিক্যাল মিশে পানি দূষিত হচ্ছে। এতে নদীর মাছ মারা যাচ্ছে। নদী থেকে স্থানীয়রা হাত দিয়েই চিংড়ি কাঁকড়াসহ আরও অন্য মাছগুলো ধরছেন। এ ছাড়া স্থানীয় আরও কয়েকজন হাত জাল ফেলেও মাছ ধরছেন।

এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা জানান,  চিনির দাহ্য পদার্থ যখন ৩৮০ ডিগ্রিতে সেলসিয়াসে থাকে তখন বিষাক্ত কেমিক্যালে রূপ নেয়। আর সেখানে পানি ছাড়া হলে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন কার্বন তৈরি হয়। যার কারণে কারখানায় আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। সেই আগুনে অপরিশধিত চিনি গলে লাভা নদীতে এসে পড়ে। এতেই পানি দূষিত হয়ে মাছ মরছে। চিনির কেমিক্যালে নদী দূষণতো হয়েছেই; এ ছাড়া নদী দূষণের অন্যতম কারণ হলো ১৭টি খালের বর্জ্য ওই নদীতে এসে পড়ছে। 
 
স্থানীয়রা জানান, সুগার মিলের চিনির কালো পানি নদীতে পড়ছে। এ থেকে মঙ্গলবার থেকেই মাছ মরে ভেসে উঠছে নদীতে। এতে হাত দিয়েই নদীতে মাছ ধরা যাচ্ছে। নদী দূষণের কারণে নদীর মাছ প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ৩৩ প্রজাতির মাছ প্রায় হারিয়ে গেছে।

কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুমা জান্নাত জানান, এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজের আগুন নির্বাপণকাজে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর ১০০ সদস্য, নৌবাহিনীর ১২ সদস্যের দুটি টিম, বিমানবাহিনী, কোস্টগার্ড, র‌্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য সহযোগিতা করছেন।

এস আলম সুগার মিলের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার হাসমত আলী জানান, কারখানার পুরো প্রসেস এবং কারখানা নিরাপদ রয়েছে। আগুন যাতে ছড়াতে না পারে, সেজন্য গোডাউন থেকে কারখানার মূল প্ল্যান্টে আসার বেল্ট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে।

এস আলম গ্রুপের এইচ আর ম্যানেজার মোহাম্মদ হোসেন জানান, প্রাথমিকভাবে কনভেয়ার বেল্টের ঘর্ষণজনিত তাপ কিংবা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে গুদামে যে ধরনের আগুন নেভানোর ব্যবস্থাপনা দরকার ছিল, তা ছিল না বলেই জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
 
ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের উপসহকারী পরিচালক আবদুর রাজ্জাক জানান, প্রাথমিকভাবে গুদামটিতে আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এলেও ওপর থেকে পানি ছিটানোর সুযোগ পায়নি। চারদিক থেকে বদ্ধ থাকা গুদামে উত্তপ্ত টিনের ছাদ কেটে ভেতরে ঢোকারও সুযোগ ছিল না। অল্প কিছু ফায়ার এক্সটিংগুইসার থাকলেও সেগুলো ব্যবহার করা যায়নি। 

তিনি বলেন, কারখানার আশপাশে ফায়ার হাইড্রেন্ট দরকার। ফায়ার হাইড্রেন্টগুলো থাকলে এতো বেগ পেতে হতো না। আগুন নেভানো আরও সহজ হতো। এখানে ফায়ার সেফটি ইনসিকিউরড। কেননা, গোডাউনের ভেতরে ১২০০ থেকে ১৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আগুন জ্বলছে। সেখানে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঢুকতে পারছেন না। কারণ আগুনের তাপমাত্রা বেশি।

দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা সহকারী পরিচালক এম ডি আবদুল মালেক বলেন, চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে এস আলম রিফাইন্ড সুগার মিলের আগুন ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে ব্যবহার হচ্ছে অগ্নিনির্বাপক রোবট ‘লুফ-৬০’। এ রোবট দিয়ে মিনিটে এক হাজার লিটার স্পিডে পানি ছিটানো হচ্ছে। চিনির কাঁচামালে দাহ্য পদার্থ থাকায় গুদামের ভেতরের আগুন নেভাতে বেগ পেতে হচ্ছে। যা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লেগে যেতে পারে আরও ৭২ ঘণ্টা।

এস আলম গ্রুপের মানবসম্পদ কর্মকর্তা মো. হোসেন বলেন, একই স্থানে আমাদের মোট ছয়টি গুদাম আছে। সোমবার ১ নম্বর গুদামে আগুন লাগে। এ গুদামটিতে এক লাখ মেট্রিক টনের বেশি অপরিশোধিত চিনি ছিল। সবই পুড়ে গেছে। যার বাজার মূল্য হাজার কোটি টাকার বেশি। গুদামটিতে এখনও আগুন জ্বলছে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের ছয়টি গুদামের মধ্যে চারটিতে অপরিশোধিত চিনি রাখা হয়। বাকি দুটিতে পরিশোধনের পর বিক্রি উপযোগী চিনি রাখা হয়। এক লাখ টন চিনি পুড়লেও, এখনও দুটি গুদামে বিক্রি উপযোগী ২৫ থেকে ৩০ হাজার মেট্রিক টন চিনি মজুত আছে। এছাড়াও বাকি তিনটি গুদামে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত চিনি মজুত আছে। আরও চিনি আমদানি পর্যায়ে আছে। সব মিলিয়ে ৪ লাখ মেট্রিক টনের মতো অপরিশোধিত চিনি আমাদের আছে।

উল্লেখ্য, এস আলম সুপার রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান কর্ণফুলী নদীর পাড়ের ইছানগর এলাকায়। প্রায় দশ হাজার বর্গফুটের এই গুদামটি পাঁচ তলা ভবনের সমান উঁচু। সোমবার বিকেল ৪টার দিকে কারখানার ওই গুদামের ছাদের দিকেই প্রথম আগুন দেখা যায়। পরে তা পুরো গুদামে ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লাগার সময় কারখানাটি চালু ছিল। সেখানে প্রায় সাড়ে ৫০০ শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন। আগুন লাগার পর কারখানাটি বন্ধ করে দেয়া হয়।

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত