শুক্রবার ১১ জুলাই ২০২৫ ২৭ আষাঢ় ১৪৩২
শুক্রবার ১১ জুলাই ২০২৫
ব্যাংক ডাকাতি ও অপহরণ: কেএনএফের শক্তির উৎস কোথায়
মোহাম্মদ আলী শিকদার
প্রকাশ: শনিবার, ৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১০:০৭ AM
আমরা জানি, বান্দরবানের সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সঙ্গে শান্তি আলোচনা চালছে। পাহাড়ের সশস্ত্র এই সংগঠন প্রায় দুই বছর ধরে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে গত ৫ মার্চ রুমা উপজেলার বেথেলপাড়ায় অনুষ্ঠিত শান্তি আলোচনায় উভয়পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।

সংবাদমাধ্যমে বলা হয় ওই সমঝোতা স্মারকের ৬ নম্বর শর্তে লেখা আছে, ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম চলাকালে কেএনএফ কোনো ধরনের সশস্ত্র ও সন্ত্রাসী তৎপরতায় লিপ্ত হবে না।’ কিন্তু সেই জায়গা থেকে তারা সরে এসেছে এবং পরপর বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে মোট তিনটি ব্যাংকে হামলা চালিয়েছে। একটি ব্যাংকের শাখা বাবস্থাপককে অপহরণ করে। তাদের এই সন্ত্রাসী হামলা অনেক বার্তা দেয়। শান্তি আলোচনা ভঙ্গ করে তারা যে পথ বেছে নিয়েছে তা অনেক প্রশ্নেরও জন্ম দেয়।

এই সন্ত্রাসী আক্রমণের পর নতুন করে ওই অঞ্চলের জননিরাপত্তা নিয়ে বাড়তি উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য এটি একটি বড় সমস্যা বইকি। কারণ পাহাড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্য আর্থিক লেনদেনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোও এখন সম্পন্ন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সর্বসাম্প্রতিক ঘটনাটি বিশ্লেষণ করলে এই ঘটনাকে হালকা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। পাহাড়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীরা এবারই প্রথম এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে বিষয়টি এমন নয়। অতীতেও তারা এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে এবার বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং তারা এবার অর্থ ডাকাতি করতে চেয়েছিল। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, সোনালী ব্যাংকের অন্যান্য কয়েকটি শাখা থেকে তারা প্রায় কয়েক কোটিরও বেশি টাকা ডাকাতির চেষ্টা করছিল। তবে এই সময় তারা কোনো ব্যাংক কর্মকর্তাকে আক্রমণ করেনি। কারণ তাদের উদ্দেশ্যই ছিল ব্যাংক ডাকাতি ও টাকা লোপাট করা।

যেহেতু একবার এমন ঘটনা ঘটেছে, তাই ভবিষ্যতেও এমনটি ঘটার আশঙ্কা থেকে যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিচ্ছিন্নতাকারী এই সংগঠনের সদস্য খুব বেশি নয়। তাদের খুব বড় জনসমর্থন রয়েছে, এমনটিও বলা যাবে না। স্থানীয় অঞ্চলে অন্তত তাদের এত বেশি জনসমর্থন খুঁজে পাওয়া যাবে না। কুকি-চিনদের একটা বিরাট অংশ প্রতিবেশী ভারতে রয়েছে। এমনকি মিয়ানমারেও তাদের রয়েছে শক্ত অবস্থান। ভারত ও মিয়ানমারে এই সশস্ত্র গোষ্ঠী ভিন্ন নামে ও পরিচয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই সংগঠনগুলো সচরাচর দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। দুর্গম অঞ্চলে কার্যক্রম পরিচালনা করায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারির আওতায় এদের আনা বেশ কঠিন। আমরা জানি, কুকি-চিন গোষ্ঠীর সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন ও দুর্গম অঞ্চলে আস্তা গেড়েছে এবং এক্ষেত্রে তারা প্রায়ই আত্মগোপন করে থাকে। তবে সাম্প্রতিক ঘটনায় সমতল ভূমিতে নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়েও সঙ্গত কারণেই গভীরভাবে ভাবতে হচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলে যে ধরনের কঠোর নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনপদ ও সমতল এলাকাতেও তেমন জোরদার নজরদারি রাখা জরুরি। যেহেতু কুকি-চিনদের অপতৎপরতা শুধু বাংলাদেশের একার সমস্যা নয় এবং পার্শ্ববর্তী দেশেও তাদের কার্যক্রম রয়েছে, তাই আমাদের একার পক্ষে এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। সীমান্তবর্তী এলাকায় সুরক্ষাবলয় গড়ে তোলার মাধ্যমে মূল সংকট নিরসনের পথে হাঁটতে হবে। সমন্বিতভাবে কুকি-চিনদের ঠেকানো কঠিন কিছু হবে না বলেই মনে করি। কারণ এ ধরনের সংগঠনের পুষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে যে ধরনের সহযোগিতা বাইর থেকে আসা প্রয়োজন তা নেই। কুকি-চিনদের ভারত কিংবা মিয়ানমার কোনো দেশই সমর্থন দেবে না। যেহেতু কুকি-চিনদের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া কঠিন, তাই তাদের দমন করা কঠিন কিছু নয়।

শুধু ভূমিবিন্যাসের কারণেই কুকি-চিনরা অপতৎপর হয়ে উঠতে পেরেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন জঙ্গল, দুর্গম পাহাড় ইত্যাদির কারণে কুকি-চিনের সদস্যরা বিভিন্ন সময় আত্মগোপন করতে পারে। এই গহিন অঞ্চলে প্রযুক্তির ব্যবহারেও অনেক সময় তৎপরতাকারীদের চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। কুকি-চিনের সদস্যরা মূলত নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে আত্মগোপন করে আছে। তাদের এই আত্মগোপনের সময় পর্যাপ্ত অর্থের প্রয়োজনেই তারা বেপরোয়া হয়ে ব্যাংকে ডাকাতি করেছে। ২০২২ সাল থেকেই কুকি-চিনের সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সংগঠনটি চাঁদাবাজি ও লুটপাটই করে থাকে।

চাঁদাবাজি ও লুটপাটের মাধ্যমে তারা জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে। বৃহত্তর অর্থে জঙ্গি কার্যক্রম তাদের এখনও পরিচালনা করতে দেখা যায়নি। কিন্তু ব্যাংক লুটপাট কিংবা ডাকাতির মতো কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা জনজীবনে শঙ্কার গাঢ় ছায়া ফেলছে। তবে কুকি-চিন, কেএনএফ কিংবা ইউপিডিএফের মতো সংগঠনগুলোর কোনো আঞ্চলিক সমর্থন নেই। তাদের বড় পৃষ্ঠপোষকও নেই। তবে এই ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর সদস্যদের বিভিন্ন সময় একটি অশুভ মহল ব্যবহার করে এ অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ার নয়। স্মরণে আছে, কুকি-চিনের সঙ্গে নিকট অতীতে আনসার আল হিন্দাল বাহিনী এক ধরনের সংযোগ স্থাপন করেছিল। সমতলের এই জঙ্গি সংগঠন পার্বত্য জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সমঝোতা করে। আনসার আল হিন্দাল বাহিনীর সম্ভাব্য কর্মীদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয় এই পার্বত্য জঙ্গি সংগঠনদের। এই পার্বত্য বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তারা প্রশিক্ষণ নিত এবং এর বিনিময়ে তারা অর্থের জোগান দিত। এটিও এক ধরনের বড় শঙ্কা। দেশের অভ্যন্তরে কোনো একটি অশুভ মহল এই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনকে কোনোভাবে আশ্রয় দিচ্ছে কি না সেটিও খতিয়ে দেখা জরুরি।

মিয়ানমারের গৃহদাহ ক্রমেই প্রকট আকার ধারণ করছে। দেশটির সীমান্তবর্তী অঞ্চলে উত্তাপের আঁচ এসে পৌঁছুচ্ছে আমাদের এখানেও। মিয়ানমারে বিভিন্ন সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী জান্তা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করছে। এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের যোগাযোগ রয়েছে, এমন সন্দেহ উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই। আর এই যোগাযোগের ভিত্তিতেই অবৈধ অস্ত্রের সরবরাহ ও মজুত বাড়ছে বলে সন্দেহ করি। মিয়ানমারের সঙ্গে আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগের মাধ্যমে যদি এ বিষয়ে একটি সমাধানে আসা যায় তাহলে সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশ ও অবৈধ অস্ত্রের সরবরাহ থামানো সহজ হবে। পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি স্থাপনের জন্য একাধিক কমিটি গড়ে তোলা হয়েছিল। ধারণা করা হয়েছিল পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি বিঘ্নিত হবে না এমন একটি সমাধানে পৌঁছুনো যাবে। কিন্তু কমিটি গঠনের পর অনেকেই এ নিয়ে আগ্রহ দেখাননি। সম্প্রতি এ কমিটিগুলোকে আবার নবরূপে গঠনের আলোচনা চলছে। পার্বত্য অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রচেষ্টা গড়ে তোলার স্বার্থে এসব কমিটির মধ্যে সমঝোতা প্রয়োজন ছিল।

বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোও কোনো অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়বে না এমন একটি আশ্বাস দিলেও সর্বসম্প্রতি দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে গোয়েন্দা নজরদারির গাফিলতি রয়েছে। শান্তিবাহিনী বিভিন্ন সময় আলোচনার কথা বলে ভিন্ন পথ অবলম্বন করেছিল। আলোচনা খারাপ কিছুই নয়। তবে ‘চোরে শোনে না ধর্মের কথা’- এই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। আমাদের গোয়েন্দা নজরদারির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের সব সময় নিরাপত্তাব্যবস্থাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বান্দরবানে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ঘটেছে তা থেকে বোঝাই যায় ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত। আমার ধারণা, অনেক স্থানেই নিরাপত্তাব্যবস্থা অনেক শিথিল ছিল। তা না হলে এমনভাবে তারা হামলা চালাতে পারত না। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়িয়ে এর উৎস সন্ধান জরুরি। নিরাপত্তা সক্ষমতা বাড়াতেই হবে। পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা কীভাবে ডালপালা এত নজরদারির পরও ছড়ায় এর পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান জরুরি। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থার এই ঘাটতিও পুরোপুরি মেনে নেওয়ার নয়। দুর্গম ওই অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের সব সময় প্রস্তুতি রাখতে হবে। দুর্গম এই অঞ্চলের নিরাপত্তা কখনই শিথিল করা চলবে না। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা তিক্ত। কেএনএফ কীভাবে শক্তি সঞ্চয় করল, এর গভীরে নজর দেওয়া প্রয়োজন।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত