রুমি আক্তার (ছদ্মনাম) দুই সন্তানের জননী। ছেলে শুভ ও মেয়ে খুকি। তার স্বামী সোহেল রানা মাদকাসক্ত। পারিবারিক কলহের জের ধরে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয় তাদের সুখের সংসারে। স্বামী সোহেল স্ত্রী রুমি আক্তারকে মারধর করে ছেলেমেয়েসহ বৃদ্ধ বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।
সন্তানদের কোনো খোঁজ-খবর রাখে না। রুমি আক্তারের অসহায় পরিবার স্থানীয়ভাবে মীমাংসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। নিরুপায় হয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ করেন রুমি আক্তার। পারিবারিক দূরত্ব বাড়তে থাকে। শিশু শুভ ও খুকি না বুঝলেও, পড়তে যাচ্ছিল অভিভাবকহীন অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে।
ফাতেমা খাতুন (ছদ্মনাম)। স্বামী আবুল খায়ের। ইসলামী শরিয়া মোতাবেক দুই বছর পূর্বে তাদের বিয়ে হয়। একমাত্র শিশুসন্তান ওমর ফারুককে নিয়ে সুখেই ছিল তাদের সংসার। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের যৌতুকের দাবিতে স্বামী আবুল খায়ের স্ত্রী ফাতেমা খাতুনকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। ফাতেমা খাতুন পারিবারিকভাবে মীমাংসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তাদের দাম্পত্য কলহের জের ধরে মামলা হয়। এ পরিবারটিও বিচ্ছেদের পর্যায়ে চলে যায়। ঠিক একইভাবে আনোয়ারা বেগমের সুখের সংসারও বিচ্ছেদের উপক্রম। নিতে যাচ্ছিল অমানবিক সিদ্ধান্ত।
ময়মুনা (ছদ্মনাম) একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। নবীনবরণ উৎসবের মধ্য দিয়ে পরিচয় হয়েছে সৈকতের সঙ্গে। নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান হয়েছে বেশ কিছু দিন। ভালোলাগা ও ভালোবাসার অভিনয়ে সরল ময়মুনা হেরে গিয়েছে সৈকতের প্রবঞ্চনার কাছে। ঘনিষ্ঠতার ছবি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল শুরু করলে ময়মুনা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। বাবা-মায়ের স্বপ্ন বিলীনের পথে।
দেখতে সুশ্রী কাকলি (ছদ্মনাম) নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাবা গরিব কৃষক। স্কুলের পথিমধ্যে ইভ টিজিংয়ের শিকার বখাটে দোলনের। বান্ধবীদের সঙ্গে একত্রে বিদ্যালয়ে গেলেও প্রতিনিয়ত শংকায় থাকে কাকলির পরিবার। স্থানীয়ভাবে অভিযোগ দিয়েও থামানো যায় না বখাটে দোলনকে। নিরুপায় কাকলির পরিবার। লেখাপড়া প্রায় বন্ধের পথে। বাবা-মা চিন্তা করছেন অন্যত্র পাঠিয়ে দেবে, নয়তো বিয়ে দেবে। কাকলির বড় হওয়ার স্বপ্ন বাধাগ্রস্ত!
রুমি, ফাতেমা ও আনোয়ারার মতো অনেক পরিবার বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে এসেছে। ঘর বেঁধেছে নতুন স্বপ্নে। ময়মুনা আর কাকলির মতো অনেক শিক্ষার্থী আইনি সহযোগিতার মাধ্যমে পাশে থেকে সাহস যোগানের জন্য লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পেরেছে নতুন উদ্যমে। যা সম্ভব হয়েছে জেলা পুলিশের নারী ও শিশু সহায়তা সেলের সরব ভূমিকায়। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অবস্থিত এ সেলের মাধ্যমে অনেক শিশু ফিরে পেয়েছে তাদের অভিভাবকের পরিচয়, বাবা-মায়ের অধিকার। মিটেছে অনেক পরিবারের কলহ, বইছে খুশির জোয়ার। নতুন করে স্বপ্ন বেঁধেছে পরিবারগুলোতে। অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে পড়তে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যালয়বিমুখ অনেক শিক্ষার্থী সমুজ্জ্বল হয়েছে স্বমহিমায়। কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে বিদ্যাপীঠে। সচেতনতা বেড়েছে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
‘এই সেলে কাজ করতে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। আমি পরম সহিষ্ণুতায় উভয়পক্ষকে যথেষ্ট সময় নিয়ে বুঝাই। আমাদের স্যারেরাও তাদের বোঝান। এই সেলের মাধ্যমে অনেক পরিবার নিজেদের মধ্যে সৃষ্ট ভুল বোঝাবুঝি ও দাম্পত্য কলহ নিরসন করে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে একত্রে সুখে-শান্তিতে মিলে-মিশে সংসার করছেন। নিষ্পাপ অনেক শিশু তাদের বাবা-মায়ের অধিকার ফিরে পেয়েছে। অনেক শিশু ও পরিবারের মুখে হাসি ফুটেছে। অনেক মেয়ে সচেতন হয়েছে।’ চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে তৃপ্ত চিত্তে এসব কথা বলছিলেন নারী ও শিশু সহায়তা সেলের দায়িত্বে থাকা এএসআই (নি.) মিতা রানী বিশ্বাস।
উদাহরণ হিসেবে চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশের নারী ও শিশু সহায়তা সেলের তথ্যানুযায়ী জানা যায়, ২২.০৮.২০২২ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১৭.১১.২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মোট ৪৫০টি অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে যৌতুকের জন্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, স্ত্রীর ক্ষেত্রে স্বামী ও পিতা-মাতার ক্ষেত্রে সন্তানের নেশাগ্রস্ততা, পরিচয়ের সূত্র ধরে ধর্ষণ ও ধর্ষণের চেষ্টা, ফুসলিয়ে অপহরণ, শ্লীলতাহানি, ইভ টিজিং, মোবাইলে ধারণকৃত আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ছাড়ার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল, অনলাইনে চিকিৎসাসেবা প্রদানের নামে প্রতারণাসহ অন্যান্য অভিযোগ। নারী ও শিশু সহায়তা সেলে কর্মরত নারী পুলিশ সদস্যদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও নিরলস পরিশ্রম এবং সংশ্লিষ্ট সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাদের নিবিড় তদারকিতে প্রাপ্ত অভিযোগের মধ্যে পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি ও দাম্পত্য কলহ মিটিয়ে স্বামী-সন্তানসহ একত্রে বসবাস করছেন ১৫২টি পরিবার; অভিযোগের ধরন ও প্রকৃতি অনুযায়ী আপস-মীমাংসা, আপসে বিবাহবিচ্ছেদ এবং স্বামী ও সন্তান সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে ২১০টি; প্রচলিত আইন ও বিধি-বিধান অনুসরণ করে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা আদায় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে থানায় নিয়মিত মামলা দায়ের ও বিজ্ঞ আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ৬৬টি। আর প্রয়োজনীয় সময় হাতে নিয়ে উভয়পক্ষের উপস্থিতিতে বসার অপেক্ষায় মূলতবি রয়েছে ২২টি অভিযোগ।
এরকম পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে বাংলাদেশ পুলিশের সব জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অবস্থিত নারী ও শিশু সহায়তা সেলগুলোয়। সাক্ষীসহ উভয়পক্ষের উপস্থিতিতে পারিবারিক আদালতের অবয়ব তৈরি হয় এখানে। পক্ষ-বিপক্ষের শুনানি, যুক্তিতর্ক ও সাক্ষীদের বক্তব্য ধৈর্যসহকারে শ্রবণান্তে সম্পর্কের টানাপড়েনে মানসিক সংযুক্তির মাধ্যমে কর্মরত নারী পুলিশ সদস্যরা আইনি সেবা নিশ্চিত করেন। কখনো পুলিশের ভূমিকায়, কখনো মমতাময়ী মায়ের ভূমিকায়, কখনো বোনের ভূমিকায় আবার কখনো নারীর স্বমহিমায় আবির্ভূত হয়ে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেন সেলের নারী পুলিশ কর্মকর্তা ও নারী পুলিশ সদস্যরা। মাঝেমধ্যেই ভুক্তভোগী অসহায় ও নিরুপায় পরিবারগুলোর সদস্যদের কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা, স্নেহ ও ভালোবাসায় আবদ্ধ হন তারা। পেশাগত জীবনে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে!
অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশের নারী ও শিশু সহায়তা সেলে কর্মরত নারী কনস্টেবল সুমা পারভীন বলেন, ‘নারী ও শিশু সহায়তা সেলে যেসব অভিযোগ জমা পড়ে এদের মধ্যে বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের। অনেক সময় অভিযোগকারী বিবাহবিচ্ছেদ চান। আমরা সব অভিযোগ সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে নিজ নিজ সাক্ষীদের উপস্থিতিতে বাদী ও বিবাদীদের কাউন্সেলিং করি। আমাদের চেষ্টা থাকে বিবাহবিচ্ছেদের মতো অমানবিক সিদ্ধান্ত থেকে ফিরিয়ে আনা।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের আদলে বাংলাদেশের পুলিশের উদ্যোগে সব জেলায় আদালতে মামলার জট ও পারিবারিক বিচ্ছেদ কমাতে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ‘নারী ও শিশু সহায়তা সেল’ গঠন করা হয়। পরিবারে যৌতুক, মাদকাসক্ত, ছোট-খাটো বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝি ও দাম্পত্য কলহের জের ধরে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারী নির্যাতন মামলা হয়ে থাকে। মামলার ফলে বাড়তে থাকে পারিবারিক দূরত্ব। সন্তানকে পড়তে হয় অভিভাবকহীন অনিশ্চিত জীবনের মুখে। আধুনিক পুলিশ জনবান্ধব পুলিশ, নারী ও শিশুবান্ধব পুলিশ। বাংলাদেশ পুলিশের সিটিজেন চার্টার অনুযায়ী কমিউনিটি পুলিশিং দর্শনের মাধ্যমে পুলিশ দাম্পত্য কলহ নিরসন করে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করার প্রচেষ্টা চালায়। এর ফলে পারিবারিক বিচ্ছেদ অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।
পুলিশের সেবাকে আরও গণমুখী করে মানুষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে মুজিববর্ষে নিপীড়িত মানুষের মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বাংলাদেশ পুলিশ দেশের প্রতিটি থানায় একটি করে ‘নারী, শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী সার্ভিস ডেস্ক’স্থাপন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ এপ্রিল ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ পুলিশের এই মানবিক উদ্যোগ শুভ উদ্বোধন করেন। দেশের অনেক নারী বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে অভিযোগ করতে থানায় যান। কিন্তু সেখানে অনেক সময় পুরুষ পুলিশ কর্মকর্তারা অভিযোগ নেওয়ার দায়িত্বে থাকায় নারীরা তাদের নির্যাতনের বিষয়টি খুলে বলতে অনেক ক্ষেত্রেই লজ্জা পান। ফলে অভিযোগ নেওয়ার ক্ষেত্রেও অনেক প্রাসঙ্গিক তথ্য বাদ পড়ে যায়। এ কারণে দেশের প্রতিটি থানায় স্থাপিত এই বিশেষ হেল্প ডেস্কে দায়িত্ব পালন করছেন নারী পুলিশ কর্মকর্তা। যেখানে অভিযোগকারী নারীরা তাদের সব কথা অবলীলায় বিস্তারিত জানাতে পারছেন।
মূলত জেলা পুলিশের ‘নারী ও শিশু সহায়তা সেল’ স্বামী বা স্বামীর পরিবারের লোকজন কর্তৃক যৌতুকের জন্য নির্যাতন, স্বামী কর্তৃক শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন, নারী ও শিশুদের পারিবারিক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, মেয়েদের ইভ টিজিং ও সম্পর্কের নাটকীয়তায় প্রতারণা/ব্ল্যাকমেইল করা, পারিবারিক কলহ, বিরোধ ও ভুল বোঝাবুঝির প্রেক্ষিতে সৃষ্ট দাম্পত্য সমস্যা, স্ত্রী ও সন্তানদের ভরণ-পোষণ/খোরপোশ না দেওয়া বা খোঁজ-খবর না রাখাসহ বিবিধ সমস্যা সমাধানে আইনি সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশের জনগণ ছিল বঙ্গবন্ধুর আত্মার আপনজন। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল তার জীবনের একমাত্র ব্রত। তাই তো, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম পুলিশ সপ্তাহে ১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুলিশ বাহিনীর উদ্দেশ্যে ভাষণে মানুষকে ভালোবাসতে ও সেবা দিতে বলেছেন, সৎ থাকতে বলেছেন। পুলিশকে যেন মানুষ ভয় না করে ও ভালোবাসে, সেভাবে কাজ করে সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করতে বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন, স্বাধীন দেশের পুলিশ শোষকদের নয়, জনগণের সেবক। তাই পুলিশের কাজ জনগণকে ভালোবাসা ও দুর্দিনে সাহায্য করা। যেন মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারে। সেই প্রত্যয় নিয়ে প্রথম প্রতিরোধ যোদ্ধা বাংলাদেশ পুলিশের নারী সদস্যরাও শামিল হয়েছেন বাংলার অসহায়, নির্যাতিত, নিপীড়িত কন্যা, জায়া ও জননীর নতুন করে স্বপ্ন বুননে।
লেখক : পুলিশ সুপার, নৌ-পুলিশ, সিলেট অঞ্চল