মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫ ১০ আষাঢ় ১৪৩২
মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫
আগামী বাজেট: সমস্যাসংকুল অর্থনীতি ও করণীয়
এমএম আকাশ
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২১ মে, ২০২৪, ১১:৪৫ AM
বাজেট যেহেতু সরকারের সামষ্টিক আয়-ব্যয়ের হিসাব, সেজন্য বাজেটে অর্থনৈতিক বাস্তবতা, সরকারের শ্রেণিগত পক্ষপাতিত্ব ও উন্নয়ন দর্শনের গতিমুখের একটি প্রতিফলন অনিবার্যভাবে প্রতিফলিত হয়। 

সামাজিক বিজ্ঞানীদের তাই দায়িত্ব হচ্ছে এই বিষয়ে জনগণকে কিছু অগ্রিম ধারণা প্রদান। যাতে তারা বুঝতে পারেন এবারের বাজেট কোনদিকে ধাবিত হতে যাচ্ছে- জনকল্যাণের দিকে নাকি অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক সংকটকে আরও ঘনীভূত করার দিকে? এবারের বাজেট অনেক ঘনায়মান অর্থনৈতিক সংকটের মুখে প্রণীত হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে দুটি সংকট প্রধান ও উল্লেখযোগ্য-এক. বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিকভাবে উঁচু। 

শতকরা দশ থেকে বারো ভাগ হারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম দু-তিন বছর ধরে ক্রমাগত বাড়ছে বলে সরকারি হিসাবপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। চাল-ডাল-ভোজ্যতেল-পেঁয়াজ-মসলা-সবজি-মাছ-মাংস-মুরগি-ডিম ইত্যাদি খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির এই ঝাঁজ নিশ্চয়ই সাধারণ দরিদ্র মানুষকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। কারণ তাদের আয়ের সিংহভাগ এসব পণ্য কিনতেই ব্যয় হয়। ফলে সাধারণ মানুষ এ বছর আয় দিয়ে ব্যয় সংকুলান করতে পারছেন না।

একজন মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক কারওয়ানবাজারে ঘুরছিলেন এবং রিপোর্টারকে জানিয়েছেন, তিনি বিকালে পরিবারের সদস্যদের আগে যেসব খাবার দিয়ে নাশতার ব্যবস্থা করতেন এখন আর তা পারছেন না। তাই খোঁজ করতে এসেছেন ‘সস্তায় মিষ্টি আলু’ পাওয়া যায় কি না পেলে সেটাই কিনে নিয়ে যাবেন নাশতার জন্য। ম্লান হেসে জানিয়েছেন ‘সেটা সস্তাও হবে পুষ্টিকরও হবে।’

দুই. বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যদি ‘মূল্যস্ফীতি’ হয় বর্তমানে এক নম্বর সমস্যা তা হলে দুই নম্বর সমস্যাটি হচ্ছে ‘ডলারের ক্রমবর্ধমান মূল্যের’ সমস্যা। সবারই জানা আছে যে, ডলার হচ্ছে আমেরিকান মুদ্রা। তিন বছর ধরে আমেরিকান অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৪.১% (২০২৩), ৮% (২০২২) এবং ৪.৭ (২০২১)। কিন্তু বাংলাদেশে এ সময় মুদ্রাস্ফীতি বা মূল্যস্ফীতির হার সর্বদাই ছিল ৫ শতাংশের চেয়ে বেশি, কোনো কোনো বছর এমনকি ১২ শতাংশ।

তাই বাংলাদেশের তুলনায় ডলারের ক্রয়ক্ষমতা যে বাড়ছে তা সহজেই বোঝা যায়। ফলে টাকার অবমূল্যায়ন কিছুটা অনিবার্য ছিল। ড. নজরুল ইসলামের প্রবন্ধ ‘Buying versus selling Dollar : What should we do’ থেকে আমরা এ-ও জানতে পেরেছি যে, বাজারের নিয়ম মেনে না চললে পরে কী অসুবিধা হতে পারে। দীর্ঘদিন আমরা কৃত্রিমভাবে টাকাকে শক্তিশালী করে রেখেছিলাম এবং আমদানিকে উৎসাহিত করেছি। ধনী রপ্তানিকারকদের ডলারের সরকারি দাম কম দিলেও সরকারি রপ্তানি বাবদ নগদ প্রণোদনা দিয়ে পুষিয়ে দেওয়ার নীতি অনুসরণ করেছি। আবার রেমিট্যান্স প্রেরকদের তা কখনো কিছু কিছু পুষিয়ে দিলেও পুরোটা সম্ভব হয়নি। ফলে পোশাক রপ্তানিকারক তাদের অর্জিত ডলার ব্যাংকে আনলেও রেমিট্যান্স উপার্জনকারীরা হুন্ডির দিকে আকৃষ্ট হয়েছেন। ফলে আমাদের ‘ডলার’ ব্যাংকের মাধ্যমে আগের মতো আর সরকারি রিজার্ভে এসে জমা হয়নি। এখন দেখা যাচ্ছে আমাদের রিজার্ভের পরিমাণ খুবই কমে গেছে।

এত কমে গেছে যে, রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে খোলাবাজারে ডলারের দাম কৃত্রিমভাবে কমিয়ে রাখার ক্ষমতা আজ আর আমাদের অবশিষ্ট নেই। এ অবস্থায় সরকারকে দ্রুত ডলারের দাম বাড়াতে আমদানির রাশ টেনে ধরতে হয়েছে।

অন্যদিকে আমদানির কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দাম ডলারের অবমূল্যায়নের ফলে বেড়ে যাওয়ায় তার কিউমেলিটিভ প্রতিক্রিয়া হিসেবে দ্রব্যমূল্য আরও বেড়ে গেছে। 

অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংক সময়ের কাজ সময়ে সম্পাদন না করার ফলে এখন উভয় সংকটের মুখোমুখি হয়েছেন তারা। যদি তিনি বা তারা আগামী বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি অনুসরণ করতে যান অর্থাৎ যদি সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়া, মুদ্রা সরবরাহ কমানো, করহার বৃদ্ধি করা, সরকার ও ব্যক্তিগত খাতে ব্যয় হ্রাস, ভর্তুকি প্রত্যাহারে কৃচ্ছ্রতাসাধন ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা হলে তা উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির যে জয়গান এতদিন তারা গেয়ে এসেছেন- সেটা আর এবার তাদের পক্ষে আদৌ গাওয়া সম্ভব হবে না। তা হলে মুদ্রাস্ফীতি ঠেকাতে গিয়ে আমরা অর্থনীতিতে আরও বেশি করে মন্দা ডেকে আনব বা আনতে যাচ্ছি তাই নয় কি? স্বল্পমেয়াদে এসব অপ্রিয় পদক্ষেপ জনগণের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র মতো বোধ হতে পারে। 

তাই সংকোচনশীল অর্থনীতিতে পাশাপাশি পরিপূরক ‘সুরক্ষার’ ব্যবস্থা না থাকলে, খাদ্য ও জ্বালানির দাম যদি নাগালের মধ্যে রাখার ব্যবস্থা না থাকে এবং তা হলে যারা নিচে নেমে যাবেন বা যাচ্ছেন, চাকরি হারাচ্ছেন, আয় বা প্রবৃদ্ধি যাদের ঋণাত্মক হচ্ছে, তাদের জন্য ভর্তুকি বা সুরক্ষামূলক রেশনের ব্যবস্থা না করলে আগামীতে গণঅসন্তোষ ঠেকানো যাবে না।

সম্ভাব্য আশঙ্কাসমূহ : বর্তমানে ঋণখেলাপি ও টাকা পাচারকারীরা ক্ষমতা কাঠামোয় যে রকম শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে গেছেন, তাতে তাদের ট্যাক্সের আওতায় আনা না গেলে সরকারি বাজেটের আয় দিয়ে ব্যয় সংকুলান করা যাবে কি? বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভও কি পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে? সম্প্রতি ক্ষমতাসীন সরকারের ঘনিষ্ঠজনই বলতে শুরু করেছেন, ‘বিদেশে অর্থপাচারের সিংহভাগই (শতকরা ৯০ ভাগ) ঘটছে ব্যাংকিং চ্যানেলে। 

শুধু ২০২২-২৩ অর্থবছরেই ১৪১০৬টি সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য মিলেছে যা আগের বছরের তুলনায় শতকরা ৬৫ ভাগ বেশি (বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, বিআইএফ, ইউ)। তাই মানি লন্ডারিং ব্যাপকভাবে হ্রাস করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা যেমন প্রয়োজন, তেমনই দরকার ব্যাংকিং খাতে সহযোগিতা। দশ হাজার টাকার বেশি মানের লেনদেন অ্যাকাউন্ট পেয়িং চেকের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক করা হলে কারচুপি কমবে এবং কর বা মূসক রাজস্ব বাড়বে।’ [দেখুন, মো. ফরাসউদ্দিন, ‘বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় আগামীর করণীয়’, ইউপিএল, মার্চ, ২০২৪, পৃ. ৫৮] একই গ্রন্থের ‘বিনিময় হার, মুদ্রানীতি ও রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক অধ্যায়ে লেখক সরকারকে দুর্বলতা পরিহার করে কঠোর হওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে মুদ্রা পাচার বছরে গড়ে ৭০০ কোটি ডলার বলে ওয়াশিংটনের গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টগ্রিটি প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘও এতে একমত।

সরকার কেন নীরব ও নিষ্ক্রিয় তা বোধগম্য নয়। কয়েক বছর আগে স্বল্প শুল্কের মূলধনী মালামাল আমদানির নামে শতকোটি টাকার অতি উচ্চমূল্যের মূলধন মালের চালান ধরতে গিয়ে কর্মকর্তাদের চাকরি যায়যায় আর কী! গত দুবছরে (২০২২-২০২৩) লোমহর্ষক কয়েকটি মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা খবরের কাগজে এলে সরকারি কর্মকাণ্ড কেন ‘পুতিয়ে’ যাচ্ছে। বেগমপাড়া, সেকেন্ড হোম ইত্যাকার বিষয়ে দুর্বলকণ্ঠ বক্তৃতা-বিবৃতির বদলে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮) এ কথা ঠিক যে, সরকারের জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো দুর্লংঘ্য আইন গৎবাঁধা নেই। কারণ আমরা জানি যে, সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংক থেকে এ ধরনের পাচার করা ‘এক প্রভাবশালী ব্যক্তির’ সম্পদ আংশিকভাবে হলেও ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে!

বস্তুত ‘খেলাপি ঋণ’ আদায় করা মোটেও অসম্ভব ব্যাপার নয়। যদিও একবারে জমে থাকা প্রকৃত খেলাপি ঋণ (প্রায় পৌনে ৪ লাখ কোটি টাকা- যদি পুনঃতফসিলীকরণ ও মাফ করা পাওনাসহ আইএমএফ পদ্ধতিতে হিসাব করা হয়।) এক ধাপে উঠানো যাবে না। কিন্তু এই বাজেটে তার প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। শীর্ষ খেলাপিদের নাম প্রকাশ ও তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হতে পারে। তা একটি অতিনগণ্য হলেও প্রথম পদক্ষেপ।

১৯৯৯-২০০০ সালে শীর্ষ দশ খেলাপির তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল। তখন খেলাপিরা মামলা করে তাদের ঋণখেলাপিত্বের অসুবিধা উঠিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তবে তারা হেরে যান। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন ঋণ খেলাপকে ‘সামাজিক’ সন্ত্রাস হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। সেই বছর হাইকোর্টের আপিল বিভাগ ৫৭ জন খেলাপির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংককে জয়ী ঘোষণা করেছিল। এখনো সেটা সম্ভব নয় কি?

যদি খেলাপি ঋণও উদ্ধার করা না যায়, পাচারকৃত টাকাও উদ্ধার করা না যায়, সরকারি রাজস্বও বাড়ানো না যায়, সরকারের ব্যয়ে অপচয় ও দুর্নীতিও কমানো না যায়, ব্যক্তিগত স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগও স্থবির থাকে, কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী উৎপাদনশীল পণ্য আমদানিও হ্রাস পায়, তা হলে কি অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হ্রাস ও দারিদ্র্যের বৃদ্ধি অনিবার্য হয়ে উঠবে না। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৪ কোটি লোকের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখোমুখি রয়েছে। সেই কথাটি কি নীতি প্রণেতারা ভেবেছেন? তাই ইতস্তত করা বা ‘Business As usual Mood’-এ চলার দিন শেষ।

আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত যেটুকু প্রবৃদ্ধির সূচক ও মানব উন্নয়ন সূচকের উন্নতি এযাবৎ পরিদৃশ্যমান হয়েছে তার মূলে রয়েছে আমাদের পরিশ্রমী কৃষক, পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিক, শ্রমঘন মাঝারি ও ক্ষুদ্রশিল্পের অসংখ্য উদ্যোক্তা এবং বিদেশি প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান। এসব উৎপাদনশীল জনগোষ্ঠীকে আরও বিকাশের সুযোগ প্রদান ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈষম্য নিরসক উন্নয়ন প্রক্রিয়া চালু করার মধ্যেই নিহিত আছে বর্তমান সংকট নিরসনের প্রকৃত ইতিবাচক চাবিকাঠি।

সেই পথে সরকার অগ্রসর হোক কী না হোক, বর্তমানে বিভিন্ন শ্রেণির নাগরিক কী ভাবছেন সেটা আপাতত আমরা মনোযোগ দিয়ে শুনি। অন্তত তাদের আশঙ্কা ও প্রত্যাশাগুলো তো সংবাদপত্রের মাধ্যমে তাদের কর্ণকুহরে কিছুটা হলেও প্রবেশ করবে।

 লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্বাস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত