সাধারণত সরকারি দলের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ থাকে। অনেক মানুষ সেটি বিশ্বাসও করে থাকে। রাজনীতিতে সরকারি ও বিরোধী পক্ষ থাকে। বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আমরা দেখেছি বিরোধী পক্ষ নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করেছে। তাদের ভাষায় সেটি ছিল আন্দোলন। তাদের সেই আন্দোলন নিয়ে সম্প্রতি আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
এখনকার দিনে রাজনৈতিক আন্দোলন করার জন্য টাকার যথেষ্ট প্রয়োজন পড়ে। এটি নতুন কোনো বিষয় নয়। অতীতেও বিভিন্ন আন্দোলনে অর্থকড়ির যে একেবারেই প্রয়োজন পড়েনি, তা নয়। তখনো অর্থের প্রয়োজন হতো। এখনো হয়। বঙ্গবন্ধু নিজেও পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের আন্দোলনে কর্মীদের যৎসামান্য অর্থ দিয়ে কাজ করাতেন, সে বিষয়ে তিনিও লিখেছেন।
বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবও কর্মীদের প্রয়োজনীয় অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন। বড় ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের শুভানুধ্যায়ী কেউ কেউ যে অর্থ দিতেন, তা লোপাটের কোনো অভিযোগ নেই। ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের ঐতিহাসিক হরতাল পালনের দায়িত্ব পড়েছিল আওয়ামী লীগের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরীর ঘাড়ে। মিজানুর রহমান চৌধুরীর লেখা বই ‘রাজনীতির তিনকালে’ এর বর্ণনা রয়েছে। তৎকালীন আমলা রুহুল কুদ্দুসের বাসায় গিয়ে অর্থ সহায়তার কথা বলতেই তিনি চার হাজার টাকা তাঁর হাতে এনে তুলে দেন।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আগে থেকেই রুহুল কুদ্দুসের গোপন রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল। মিজান চৌধুরী ৭ জুনের হরতাল সফল করার জন্য ১৫ হাজার টাকা বাজেট নিয়ে নেমেছিলেন এবং এর যথাযথ ব্যবহারও তিনি করেছিলেন। আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র, শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পিকেটিং, যাতায়াত, পোস্টার, সভা-সমাবেশ করার কাজে ব্যয় করেছিলেন। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে সভা, সমাবেশ ইত্যাদিতে মাইক, প্যান্ডেল, চেয়ার, টেবিল ইত্যাদির জন্য যে খরচ হতো, তা আমরা যাঁদের কাছেই চাইতাম, বিনা দ্বিধায় তা তাঁরা দিতেন। মানুষের দেওয়া অর্থ শুধু আন্দোলনের কাজে ব্যয় হতো, দোকানে দল বেঁধে চা খাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারিনি।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে এ ধারা কিছুদিন কোনো কোনো দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ছিল। তখন টাকা লোপাটের কোনো কথা শোনা যায়নি। যেমনটি এবার অভিযোগ উঠেছে। সে অভিযোগ আবার রাজপথের বড় দল বিএনপির অনেক নেতার বিরুদ্ধে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জনসভায় শ্রোতা ধরে আনার প্রকল্প চালু হয়েছে। যানবাহন, হাতখরচ, কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়ার কথা প্রচলিত রয়েছে। ফলে সরকারি দলের কিংবা বিরোধীদের আন্দোলনের পেছনে বিপুল অর্থের বিনিয়োগ এখন একটি স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। এমনকি নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলোরও খরচ কেউ না কেউ জোগান দিয়ে থাকেন। এর ওপর নির্ভর করে অনেক রাজনৈতিক দল অফিস, যানবাহন, নেতাকর্মী ধরে রাখে বলেও শোনা যায়। টাকা ছাড়া এখন যেন কিছুই হয় না।
রাজনৈতিক দলগুলো যখন আন্দোলন দীর্ঘায়িত করে, তখন বিপুল অর্থ প্রয়োজন হয়। অবশ্য দলের অনেক সাধারণ কর্মী, সমর্থক থাকেন, যাঁরা এসব অর্থের ছিটাফোঁটাও পান বলে মনে হয় না। কিন্তু বড় বড় নেতার হাত অনেক লম্বা। তাঁরা বিভিন্ন উৎস থেকে আন্দোলন পরিচালনার নামে যে টাকা পান তার প্রকৃত তথ্য অনেক সময় কেউই জানতে পারে না। আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষস্থানীয় নেতারা খুব ভালো করেই জানেন দলের সভা, সমাবেশ, পদযাত্রা ইত্যাদির কোনোটিই বিনা পয়সায় হয় না। এ জন্য এখন বড় দলগুলোর মোটা অঙ্কের একটা বাজেট থাকে। এই বাজেটের অর্থ অবশ্য তারা কখনো দলের বাজেটে দেখায় না। এই অর্থের পুরোটাই আসে দলের কোনো না কোনো অর্থদাতার কাছ থেকে, যাঁরা দল ক্ষমতায় এলে ঠিকাদারি, ব্যবসা-বাণিজ্য, নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার লাভ করে থাকেন। কিন্তু সেটি কেউ স্বীকারও করেন না। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি একটি সর্বজনীন সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গতবছর বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনকারীরা দেশে সরকারবিরোধী একটি আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়েছে, ওই আন্দোলনে দল থেকে দেশব্যাপী বিভাগওয়ারি মোটা অঙ্কের যে অর্থ স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীদের জন্য বিশেষ কোনো নেতা বা নেত্রীর হাতে দেওয়া হয়েছিল, তার প্রায় পুরোটাই লোপাট হওয়ার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রতিবেদনে লন্ডন থেকে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দলীয় বিশেষ কোনো নেতা বা নেত্রীর কাছে পাঠানো হলেও তার সঠিক হিসাব তাঁরা দলকেও না দিয়ে বাড়তি খরচ নিজেদের পকেট থেকে মেটানোর দাবি করেছেন।
পত্রিকার প্রতিবেদক যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে গত বছরের আড়াই মাসের আন্দোলনের জন্য যাঁরা লাখ লাখ টাকা পাঠিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যেসব তথ্য জানতে পেরেছেন, তাতে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে বিশাল পার্থক্য তুলে ধরেছেন। ওই প্রতিবেদক জেলা পর্যায়ের আন্দোলনের জন্য একজন কেন্দ্রীয় নেতা ৬০ লাখ টাকা প্রদানের যে তথ্য দিয়েছেন, তা প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছেন।
আন্দোলন শেষে কেন্দ্রীয় নেতাকে ৩০ লাখ টাকা ফেরত দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম বিভাগের আন্দোলনের সমন্বয়কারীর স্ত্রী এবং আরো কয়েকজন মিলে খুলশী জালালাবাদে ১৪ কাঠা জমির ওপর ১২ তলা টাওয়ার নির্মাণ করছেন। এরই মধ্যে ৯ তলা পর্যন্ত নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।
একই রকম অভিযোগ রয়েছে বরিশাল এবং রাজশাহী বিভাগেও। কথা ছিল তৃণমূলের যেসব নেতাকর্মী গ্রেপ্তার কিংবা জেলহাজতে গিয়েছিলেন, তাঁদের মামলা পরিচালনার খরচ এর থেকে মেটানো হবে, কিন্তু সেটি হয়নি। আন্দোলনের নামে যেসব অর্থ বিতরণ ও লোপাট হয়েছে, সেসব নিয়ে কি বিএনপি লোপাটকারীদের দল থেকে বহিষ্কার করবে, নাকি তাঁদের সমহিমায় দলে রেখে দেবে? অথচ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়া নেতাদের বিএনপি বহিষ্কার করেই চলেছে! এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর স্পষ্ট হয়ে গেছে, ভবিষ্যতের আন্দোলনও এভাবে কারো না কারো অর্থ দ্বারা পরিচালিত হবে এবং কেউ কেউ সেসব অর্থের ওপর ভর করে নিজের জীবন সুখ ও শান্তিতে ভরপুর করে নেবেন। আসলে আদর্শের রাজনীতির অতীতটাকে ফেলে দিয়ে যখন থেকে দেশের রাজনীতি অজানা উৎসর অর্থে পরিচালিত হতে শুরু করেছে, তখন থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি আর আদর্শের জায়গায় নেই।
লেখক : ইউজিসি বঙ্গবন্ধু ফেলো এবং সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়