বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫ ১ শ্রাবণ ১৪৩২
বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫
নীরব দর্শকের ভূমিকায় চসিক
চট্টগ্রামে খাল ভরাট করে পশুর হাটের রাস্তা, যত্রতত্র এগ্রো ফার্ম
কামরুজ্জামান রনি, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: সোমবার, ১০ জুন, ২০২৪, ৬:১৭ PM
চট্টগ্রাম নগরীতে কোরবানির পশুর হাটে কেনা বেচা এখনো জমে না উঠলেও নগরীতে অবৈধ ভাবে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে অস্থায়ী পশুর হাট। নিয়ম নীতি না মানার দৌড়ে পিছিয়ে নেই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ইজারা দেয়া পশুর হাট গুলো। খালের ওপর মাটি ভরাট করে যাতায়াতের সড়ক নির্মাণ, নির্ধারিত স্থানের বাইরে, এমনকি সড়কে পশুর হাট বসানো থেকে স্থায়ী গরুর বাজারের এক কিলোমিটারের মধ্যে অবৈধ পশুর বাজার বসাচ্ছেন ইজারাদারেরা। আর এসব দেখেও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে চসিকের স্টেট ও রাজস্ব শাখা। অভিযোগ উঠেছে চসিকের এই দুটি শাখার কতিপয় কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই চলছে এসব অনিয়ম। 

এবার নগরীতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ৭টি অস্থায়ী পশুর হাট বসিয়েছে। এগুলো হলো কর্ণফুলী পশুর বাজার (নুর নগর হাউজিং এস্টেট), ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের বাটারফ্লাই পার্কের দক্ষিণে টিকে গ্রুপের খালি মাঠ, ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের পূর্ব হোসেন আহম্মদ পাড়া সাইলো রোডের পাশে টিএসপি মাঠ, একই ওয়ার্ডের মুসলিমাবাদ রোডের সিআইপি জসিমের খালি মাঠ, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের বড়পোল সংলগ্ন গোডাউনের পরিত্যক্ত মাঠ, ৩ নম্বর পাঁচলাইশ ওয়ার্ডের ওয়াজেদিয়া মোড় ও ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের আউটার রিং রোডের সিডিএ বালুর মাঠ। এ ছাড়া রয়েছে তিনটি স্থায়ী পশুর হাট। এর মধ্যে রয়েছে- বিবির হাট গরুর বাজার, সাগরিকা গরুর বাজার ও পোস্তার পাড় ছাগলের বাজার।

৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের আউটার রিং রোডের সিডিএ বালুর মাঠের ইজারাদার সংযোগ সড়কের খালে মাটি ভরাট করে সড়ক নির্মাণ করেছে। ইজারাদারের নিজস্ব স্কেবেটর দিয়ে খালে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সড়কটি নির্মাণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। অথচ সেই এলাকায় এখন জলাবদ্ধতা নিরসনের মেগা প্রকল্প চলমান রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, প্রথমে এই ইজারাদার আউটার রিং রোড়ের সংযোগ সড়কে গর্ত খুড়ে বাঁশ গেড়ে গরুর হাট বসাতে চেয়েছিল। পরে সর্বোচ্চ দরে সিডিএ বালুর মাঠটি ইজারা নেয়। এই মাঠে আসতে হলে আউটার রিং রোড় এবং র‍্যাব-৭ এর পাশের সড়কটি ব্যবহার করতে হবে। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় পূর্বদিক থেকে আসা (র‍্যাব-৭ এর গলি) সড়কটির সাথে সিডিএ রিং রোড়ের সংযোগ সড়কটির মাঝে থাকা খালের ওপর ব্রিজ নির্মাণ এখনো সম্পন্ন হয়নি। বালুর মাঠ গরুর বাজারটি ইজারা নেয়ার পর রাতারাতি খালে মাটি ফেলে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা আরো বাড়ার আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা। 
এই বিষয়ে সিডিএ বালুর মাঠটির ইজারাদার সাবেক কাউন্সিলর মোঃ আসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি খালের ওপর নিজস্ব স্কেবেটর দিয়ে সড়ক নির্মাণের কথাটি স্বীকার করে বলেন, এখানে এখনো জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি। আমরা খালের ওপরে থাকা একটি টিলাকে সমান করে দিয়েছি। এতে করে জনগণের উপকার হয়েছে।" সড়কে গর্ত করে বাঁশ গাড়া প্রসঙ্গে প্রশ্ন করতেই তিনি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলেন, "আমাদেরকে প্রথমে রিং রোডের পশ্চিম পাশে বাজার করার অনুমতি দিয়েছিল। সেই কারণে আমরা সেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। এখন যেহেতু আমরা মাঠ ইজারা পেয়েছি সেহেতু আমাদের আর সড়কে বাজার করার প্রয়োজন নেই৷"

এদিকে সাগরিকা স্থায়ী পশুর হাট ইজারা নিয়ে ইজারাদার বাজারটির এক কিলোমিটার এলাকার মধ্যে অস্থায়ী বাজার বসানোর মৌখিক অনুমতি দিয়ে গড়ে তুলেছেন একাধিক অবৈধ গরুর হাট। সাগরিকা রোডের মুখে পোর্ট কানেকটিং সড়কে কোরবান আলী এগ্রো নামে গড়ে তোলা হয়েছে গরুর বাজার। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটির পাশে গড়ে ওঠা বাজারটিতে দুইশতাধিক গরু-মহিষ রাখা হয়েছে। সড়কের পাশে গরুর বর্জ্যের বিশাল স্তূপ করে রেখেছে কোরবান আলী এগ্রো। এই কোরবান আলী আগ্রোটির ঠিকানা রাজধানী ঢাকার দোহারে দাবি করে এগ্রোর মালিক পরিচয়ে এরশাদ নামের এক ব্যক্তি বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, "আমরা সাগরিকা গরুর বাজার থেকে অনুমতি নিয়ে আমাদের নিজস্ব জায়গাতে এই বাজার বসিয়েছি আর এখান থেকে সাগরিকা বাজার কর্তৃপক্ষ ইজারা তুলবে সুতরাং চসিকের অনুমতি নেইনি। প্রধান সড়কের পাশে স্তূপ করে রাখা পশু বর্জ্যের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "আমরা নিজ উদ্যোগে ড্রেন পরিষ্কার করেছি।"

এখান থেকে মাত্র কয়েকশত ফুট দূরত্বে সাগরিকা রোডের মুখে বিশাল আকারে গড়ে তোলা হয়েছে আরেকটি অস্থায়ী গরুর বাজার। জনৈক ইউনুস নামের ব্যক্তি পাশাপাশি দুটি প্লট ভাড়ায় নিয়ে এই অস্থায়ী গরুর বাজার পরিচালনা করছেন। এই বাজারের বেশির ভাগ গরু বিক্রেতা কুষ্টিয়া, দিনাজপুর তথা উত্তর বঙ্গ থেকে গরু এনে এখানে খাইন (গরু রাখার স্থান) ভাড়া নিয়ে গরু বিক্রি করছেন। বাজারের উদ্যোক্তা ইউনুসের ছেলে সাজ্জাদ বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, আমরা সাগরিকা গরুর বাজারের আন্ডারে এখানে বাজার করেছি। সাগরিকা বাজার ইজারাদার বলেছে বাজারের এক কিলোমিটার এলাকার মধ্যে বাজার বসাতে পারবো। " সিটি কর্পোরেশন থেকে কোন প্রকার অনুমতি নেননি স্বীকার করে সাজ্জাদ বলেন, "আমাদের বাজার থেকে সাগরিকা বাজারের ইজারাদার ইজারা আদায় করছে। তাই কারো অনুমতি কখনো নিতে হয়নি।"

এই বিষয়ে সাগরিকা গরু বাজারের ইজারাদার আরিফুল ইসলামের সাথে কথা বললে তিনি সাগরিকার গরু বাজারের চার দিকে এক কিলোমিটার করে এলাকার মধ্যে সব গরু বাজার তাদের আওতায় রাখা যাবে বলে জানান। চসিক থেকে এই ছক একে তাদের দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেহেতু চসিক আমাদের লিখত ভাবে এই এলাকার দ্বায়িত্ব আমাদের দিয়েছেন তাই নতুন করে কোন বাজারের অনুমতি নিতে হবে না। নগরীর যত্রতত্র এগ্রোর নাম করে অস্থায়ী গরুর হাটের বিষয়ে তিনি ঘোর আপত্তি জানিয়ে বলেন, "ওরা সরকারকে একটা টাকাও রাজস্ব না দিয়ে এগ্রোর নামে মৌসুমি গরুর বাজার পরিচালনা করছে। এসব কথিত এগ্রোর কারণে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে আমরাও হাসিল আদায় থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।"

সোমবার নগরীর আরো কয়েকটি পশুর হাট ঘুরে দেখা যায়, সারি সারি খুঁটি বানানো হয়েছে। তবে কোন হাটেই কোরবানির পশু পূর্ণ হয়নি। হাট কর্তৃপক্ষ বলছে বাজারে পর্যাপ্ত গরু সরবরাহ হচ্ছে। অনেক পশুবাহী গাড়ি পথে আছে। তবে এখন পর্যন্ত হাটগুলোতে সেভাবে শুরু হয়নি কোরবানি পশুর কেনা বেচা। এবার নগরীর প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই দেখা মিলছে রেকর্ড সংখ্যক অস্থায়ী গরুর বাজার৷ বিশেষ করে বিভিন্ন এগ্রো ফার্মের নামের ব্যানার ঝুলিয়ে এসব অননুমোদিত ছোট ছোট পশুর হাটের সংখ্যাই বেশী। তবে বেশ কিছু বড় বড় শিল্প গ্রুপের মালিকানায় গড়ে উঠেছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত এগ্রো ফার্ম। এসব এগ্রো ফার্মগুলোতে তুলনামূলক উচ্চবিত্ত শ্রেণীর ক্রেতা সমাগমই বেশী। চট্টগ্রামে কয়েকটি অনুমোদিত এগ্রো ফার্ম ছাড়া বেশির ভাগই নামসর্বস্ব এগ্রো। যেসবের নুন্যতম কোন ট্রেড লাইসেন্স পর্যন্ত নেই। জানা গেছে পুলিশ, সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব শাখা ও স্টেট শাখাকে ম্যানেজ করেই এসব অস্থায়ী অবৈধ গরুর বাজার পরিচালিত হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক এমন মৌসুমি গরু ব্যবসায়ী বাংলাদেশ বুলেটিনকে জানান, "বাজার বসানোর আগেই সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে গরু বিক্রির প্যান্ডেল নির্মাণ করা হয়। পরে এসব প্যান্ডেল দেখে চসিকের রাজস্ব ও স্টেট শাখার লোকজন এসে আমাদের কোন প্রকার সমস্যা ফেইস করতে হবে না বলে টাকা নিয়ে গেছে।"

এসব বিষয়ে চসিক নগর ভবনের রাজস্ব ও স্টেট শাখায় সরাসরি যোগাযোগ করেও কোন দায়িত্বশীলদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা নিজ অফিসে থাকলেও তিনি সাংবাদিক পরিচয় জানার পর নাস্তা করছেন বলে সাক্ষাৎ দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম নিজ কক্ষে নাস্তা করছেন বললেও তখন ঘড়িতে দুপুর সাড়ে তিনটা, সচরাচর এই সময়টি কেউ নাস্তা করার কথা নয়। এছাড়া চসিক ভবনের ৬ষ্ঠ তলায় স্টেট বিভাগে প্রধান স্টেট অফিসারের কক্ষে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি৷ এই দুজন কর্মকর্তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি। চসিকের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিবেদককে বলেন, কোরবানির ঈদ পর্যন্ত উনারা সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলবে। ঈদ পার হয়ে গেলে উনাদের দেখা পাবেন।
« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত