তিন বছর আগেও নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর মতো অবস্থা ছিল রতনের। সহায়-সম্বল বলতে কিছুই ছিল না। ছিল না মাথা গোঁজার ঠাঁই। রতন অটোরিকশা চালাতেন। পরে তিনি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে চাকরি নেন।
মাত্র তিন বছরে এখন তিনি স্বাবলম্বী। নিজেদের উপার্জনে বানিয়েছেন পাকা বাড়ি, কিনেছেন মোটরসাইকেল। জমি বন্ধক নিয়ে ধান ছাড়াও বিভিন্ন ফসল আবাদ করছেন।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে চাকরি করেই ভাগ্য বদলেছে ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নের যুক্তিতলা গ্রামের বাসিন্দা রতন। তাঁর আয়ে এখন গ্রামে তাঁদের পরিবারটি সচ্ছল ও স্বাবলম্বী।
রতন বলেন, আমি বর্তমানে প্রকল্পের বিদেশি ঠিকাদার নিকিম কোম্পানিতে কাজ করছি। আগের অবস্থা এখন নেই। আমি সাবলম্বী হয়েছি। নিজের আয়ে বাড়ি-মোটরসাইকেল কিনেছি। এখন আমি চাই আমাদের সন্তান যেন পড়ালেখা শেষ করে বড় অফিসার হয়। তাঁকে যেন আমার মতো শ্রম দিতে না হয়।
রতনের মতো হাজার হাজার মানুষ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে চাকরি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। বেকারত্বের অভিশাপের অন্ধকার থেকে জীবনকে করেছেন আলোকিত।
ঈশ্বরদী শহরের পিয়ারখালি এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম। কাজ করেন প্রকল্পের রোসেম নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। তিনি বলেন, আমার সংসার অনেক ভালো চলছে। এখন কাজের জন্য ঢাকা যেতে হয় না। বাড়ির কাছেই আমাদের কর্মস্থল।
সাহাপুর ইউনিয়নের কদিমপাড়া এলাকার সামসুল ইসলামের ছেলে হাফিজুল হক। কাজ করছেন ম্যাক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। তিনি বলেন, আমি প্রতি মাসে যা বেতন পাই তা দিয়ে আমার সংসারে অনেক সাহায্য হয়। সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়তে তা অনেক সাহায্য করবে।
গাঁওগোয়াইল গ্রামের বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব সিরাজুল ইসলাম বলেন, ১০ বছর আগেও কদিমপাড়া, দীঘা, গড়গড়ীসহ আশপাশের কয়েকটা গ্রামে টিনের বাড়িও খুঁজে পাওয়া যেত না। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রায় সকল পরিবারেরই দুই-একজন করে চাকরি করে। সকলেই এখন অর্থিকভাবে সচ্ছল। অনেকেই পাকা বাড়ি বানিয়েছেন, টিনের বাড়ি করেছেন।
প্রকল্পে কর্মরত পশ্চিম টেংরি এলাকার রিপন আলী বলেন, রূপপুর প্রকল্প আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়েছে। আমার মতো বহু যুবক বেকারত্ব থেকে জীবিকার সন্ধান পেয়েছে।
সাহাপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য আরিফুল ইসলামের মতে, ব্রিটিশরা রেললাইন তৈরির পর ঈশ্বরদীতে আর তেমন কোনো উন্নয়ন ছিল না। রূপপুর প্রকল্প সেই উন্নয়নের দ্বার উন্মোচন করেছে।
পাকশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিন্টু বলেন, পাকশী ইউনিয়নে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে স্থাপন হওয়ায় এখানকার বেকার জনগোষ্ঠীর কাজের ব্যবস্থা হওয়ায় তাঁদের পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। আগের তুলনায় তাদের চলাফেরা, পোশাক-পরিচ্ছদসহ জীবনমানের উন্নয়ন হয়েছে। সবমিলিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে চাকরি করে প্রায় প্রতিটি পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে শুধু ঈশ্বরদী নয়, আটঘরিয়া, পাবনা সদর, ফরিদপুর, বেড়া, ভাঙ্গুড়া, সাঁথিয়া, কুষ্টিয়ার মধ্যে অন্যতম এবং গুরুত্বপূর্ণ ভেড়ামারা, মিরপুর, লালপুর উপজেলা, নাটোর জেলা, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, গোলাপগঞ্জ, রাজবাড়ী এবং রংপুর ও কুড়িগ্রামের মানুষেরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। বদলেও গেছে এ অঞ্চলের অর্থনীতি।
ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুবীর কুমার দাশ বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কারণে জেলার মধ্যে সবচেয়ে উদীয়মান একটি উপজেলা। প্রায় ২০ হাজার মানুষ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ করে। এখানকার মানুষেরা কর্মব্যস্ত বেশি। ফলে পারিবারিক কলহ কমেছে। সবদিক বিবেচনা করলে এ অঞ্চলের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে।
তিনি আরও জানান, ঈশ্বরদীতে শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন প্রক্রিয়াধীন আছে। এটি স্থাপন হলে ঈশ্বরদী শিক্ষিত তরুণ সমাজ সেখানে কাজের সুযোগ পাবে। এছাড়াও একটি ইকোনোমিক জোন প্রস্তুত করা হচ্ছে।
পাবনা-৪ আসনের সংসদ গালিবুর রহমান শরীফ এমপি বলেন, পারমাণবিক যুগে বাংলাদেশে প্রবেশের পরিকল্পনা কিন্তু সাম্প্রতিক নয়। সেই ১৯৬১ সালে পাকিস্তানি শাসনামলে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়, কিন্তু সেই সময় পাকিস্তান সরকার তা বাতিল করে। এরপর দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭৪ সালে উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তীতে নানা রাজনৈতিক কারণে প্রকল্প আলোর মুখ না দেখলেও ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে এটি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়া হয়। সেই প্রতিশ্রুতি এখন বাস্তব।
তিনি আরও বলেন, আগে এখানে ঝুপড়ি ঘর বা ছাউনি ঘর দেখা যেত। এখন আর দেখা যায় না। মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হয়েছে। মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন হয়েছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক মো. জাহেদুল হাসান বলেন, রূপপুর বিদ্যুৎ ঈশ্বরদী অঞ্চলের অর্থনীতিতে যে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে তার আভাস এখনই পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকার সঙ্গে সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন করা হচ্ছে, রয়েছে রেল যোগাযোগ, ইপিজেডে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নতুন করে অর্থলগ্নি করছে, মানুষের কর্মসংস্থানে অর্থনৈতিক চাঞ্চল্য শুরু হয়েছে।