১০ দিনের দীর্ঘ ছুটিতে বন্ধ সরকারি অফিস, ব্যাংক-বীমা, বন্দর, কলকারখানা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং দোকানপাট। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন থেকে শুরু করে দেশের উৎপাদন খাতে এক রকমের স্থবিরতা নেমে এসেছে, বলছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসাসংশ্লিষ্টরা।
পাইকারি-খুচরা ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের পদচারণায় মুখর থাকে রাজধানীর এমন বেশ কয়েকটি বাজার সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, এতদিন পেরোলেও শুরু হয়নি দৈনন্দিন বেচা-কেনা এবং স্বাভাবিক কার্যক্রম।
দীর্ঘ ছুটিতে স্থবিরতা নেমে এসেছে কারওয়ানবাজারে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, অন্য সময়ের তুলনায় এবার ঈদের প্রায় এক সপ্তাহ পার হলেও পণ্য সরবরাহ সেভাবে শুরু হয়নি।
পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী মোনতা গাজি বলেন, “সবজি থেকে শুরু করে অন্যান্য পণ্য মাত্র আসতে শুরু করেছে। একদিকে শহরে মানুষ কম, অন্যদিকে আড়তের কর্মচারীরা ছুটিতে থাকায় বেচাকেনা এক রকমের বন্ধ।”
একই অবস্থা পুরান ঢাকা, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী এবং সদরঘাটের আড়তেও। পণ্য পরিবহন মন্থর হওয়ায় ধীরগতিতে চলছে সরবরাহ এবং বাজার ব্যবস্থাপনা।
সদরঘাটের পাইকারি ব্যবসায়ী মকবুল হোসেন বলেন, “মৌসুমি ফল, মাছ, সবজি সব ধরনের পণ্য পরিবহন চলছে ধীরগতিতে। রবিবারের আগে পুরোদমে কাজ শুরু হবে বলে মনে হয় না।”
অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি বৈদেশিক রপ্তানি কার্যক্রমেও স্থবিরতা নেমে এসেছে। বাংলাবান্ধা, ভোমরা ও বেনাপোল বন্দর বন্ধ ১০ দিন। এতে করে স্থলবন্দরের বাণিজ্য একেবারেই স্তিমিত।
চট্টগ্রাম বন্দর সচল থাকলেও একেবারে ধীরগতিতে চলছে পণ্য খালাস। বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ঈদের ছুটিতে আছেন বেশিরভাগ কর্মী। পোশাক কারখানা বন্ধ থাকায় চাপ কম থাকলেও কর্মীর অভাবে দেরি হচ্ছে জাহাজ পণ্য খালাসে।
কারখানা মালিক এবং ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বলছে, এভাবে গড়পড়তা ঈদের ছুটি দেওয়ায় অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে ঈদ-উল-ফিতরে দীর্ঘ ছুটির পর ঈদ-উল-আজহায়ও এমন ছুটিতে কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার অভিযোগ তাদের।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকিন আহমেদ বলেন, “এমনিতেই আমাদের অর্থনীতি চাপের মুখে। এ অবস্থায় ঈদ-উল-ফিতরে নয়দিন ছুটি দেওয়া হলো, এবার ১০ দিন। দেশের অর্থনীতির সবকটি খাত বন্ধ হয়ে আছে। এটা পাগলামি ছাড়া আর কিছু না। যেখানে একদিন বন্ধ দিয়ে পরদিন কারখানা চালু রাখা উচিত, সেখানে ১০ দিন ধরে সব বন্ধ রেখে বসে থাকার কোনো যৌক্তিকতাই নেই।”
তাসকিন বলেন, “এমন না মানুষ ১০ দিন ছুটি কাটিয়ে পূর্ণোদ্যমে কাজে যোগদান করবে। ঈদের আমেজ কাটতে কাটতে যাবে আরও এক সপ্তাহ। যদি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মাসে ২০ দিনই বন্ধ থাকে সেটির বিরূপ প্রভাব যেমন মালিকদের ওপর পড়বে, একইভাবে ভোগাবে শ্রমিকদেরও।”
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম বলেন, “টানা ১০ দিন ছুটি দেওয়া একটি বড় সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মনে হয় না সরকার অংশীজনদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা না করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এছাড়া স্বাভাবিকভাবেই দেশের অর্থনীতিতে এত লম্বা ছুটির আংশিক প্রভাব এড়ানোর সুযোগ নেই।”
অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ছুটিতে থাকলেও কারখানা ছুটির বেলায় কারখানা আইন মেনে ছুটির দেওয়ার পরামর্শ দেন এ গবেষক।
এছাড়া, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ ধরনের দীর্ঘ ছুটি সমস্যা সৃষ্টি করে উল্লেখ করে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মাদ হেলাল উদ্দিন বলেন, “লম্বা ছুটিতে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক উইং সচল রাখা খুব জরুরি ছিল। যেমন, এখন দেশের সবকটি ব্যাংক বন্ধ। যেসব ব্যাংক বা ব্যাংকের উইং আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে জড়িত তাদের ১০ দিন বন্ধ দিলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চাইলে এই লম্বা ছুটিতে বিশেষায়িত বেশ কয়েকটি ব্যাংক খোলা রাখা যেত।”