প্রবাসীদের রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির অন্যতম শক্তি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় দুই হাজার কোটি ডলারের বেশি যা বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ ধরে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অথচ দেশের অর্থনীতিতে এমন অবদান রাখা প্রবাসীদের নিজ দেশে ফেরার পরই পোহাতে হয় অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা, নিরাপত্তাহীনতা এবং যাত্রীসেবা সংকটের নানা ভোগান্তি।
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাগেজ নিরাপত্তা, ইমিগ্রেশন সেবা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আচরণ, যাতায়াত ব্যবস্থা এবং বিদেশফেরত প্রবাসীদের পরিবার-পরিজনের জন্য বসার জায়গা সবকিছু নিয়ে রয়েছে ব্যাপক অভিযোগ। প্রবাসীদের ভাষায়, “সম্মানের সঙ্গে দেশে ফেরার পরিবেশ নেই।”
বিমানবন্দর লাগেজ হ্যান্ডলিংয়ে অনিয়ম বহুদিনের। প্রবাসীরা জানান, লাগেজ কেটে মূল্যবান পোশাক, পারফিউম, খাবারদাবার, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, ঘড়ি এমনকি কাপড় পর্যন্ত চুরি হওয়ার ঘটনা এখন নিয়মিত।
আরব আমিরাত প্রবাসী কামরুল হাসান বলেন, দীর্ঘ বিমান ভ্রমণের পর দেশে এসে দেখি লাগেজের চেইন কাটা। ঘড়ি, সুগন্ধি, শুকনো খাবারসহ বেশ কিছু জিনিস নেই। অভিযোগ করতে গেলে সবাই দায় এড়ায়। আমরা দেশে টাকা পাঠাই, কিন্তু আমাদের সম্পদই নিরাপদ নয় এটা খুবই দুঃখজনক।
লাগেজ স্ক্যানিং, হ্যান্ডলিং এবং সরবরাহের সময় পর্যাপ্ত সিসিটিভি মনিটরিং, দক্ষ জনবল এবং জবাবদিহির অভাবকেই যাত্রীরা এসব ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন।
ইমিগ্রেশন কাউন্টারে দাঁড়ানো এখন প্রবাসীদের কাছে সবচেয়ে ভীতিকর অভিজ্ঞতাগুলোর একটি। অনেকসময় সারির দৈর্ঘ্য এক-দেড় ঘণ্টা ছাড়িয়ে যায়। কর্মীসংখ্যা কম থাকা, ধীরগতির যাচাই প্রক্রিয়া, প্রযুক্তিগত সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে যাত্রীরা হয়রানির শিকার হন।
দুবাই প্রবাসী মোহাম্মদ সেলিম জানান, ইমিগ্রেশনে দেড় ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। পানি নেই, বসার জায়গা নেই। কর্মকর্তারা ক্লান্ত থাকেন, কিন্তু আচরণের কারণে মনে হয় আমরা অপরাধী! প্রবাসীরা তো সম্মান আশা করতেই পারে।
বিদেশের বিমানবন্দরে স্বয়ংক্রিয় ইমিগ্রেশন, ডিজিটাল যাচাই এবং নির্দিষ্ট লাইনের ব্যবস্থাপনা থাকলেও বাংলাদেশের বিমানবন্দরে এখনও অনেক কাজ ম্যানুয়াল হওয়ায় সময়ক্ষেপণ আরও বাড়ছে।
ইমিগ্রেশন শেষ করে বাইরে বের হওয়ার পর যাত্রীদের সামনে আসে আরেক চ্যালেঞ্জ নিয়ন্ত্রণহীন যাতায়াত ব্যবস্থা। অতিরিক্ত ভাড়া দাবি, অনুমোদনহীন পরিবহন, দালালচক্রের হয়রানি এমনকি রাইডশেয়ার গাড়ি ঢুকতে না দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
উত্তর আমিরাত প্রবাসী নাজমুন নাহার বুবলী বলেন, বিমানবন্দর থেকে বের হলেই আরেক যুদ্ধ। কোনটা বৈধ ট্যাক্সি, কোনটা অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে বোঝা যায় না। আমাদের পরিবাররা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এটা কি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিবেশ?
ঢাকা বিমানবন্দর এলাকায় একাধিক সংস্থার নিয়ন্ত্রণ থাকায় সমন্বয়হীনতা ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন অনেক যাত্রী।
এদিকে বিদেশফেরত প্রবাসীদের অভ্যর্থনা বা নতুন যাত্রীদের বিদায় জানাতে প্রতিদিন হাজারো মানুষ বিমানবন্দরে আসেন। কিন্তু তাদের জন্য নেই নিরাপদ, পরিষ্কার, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বসার জায়গা বা বিশ্রামাগার। ফলে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় শিশু ও বৃদ্ধদের বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
আবুধাবি প্রবাসী মোশাররফ করিম বলেন, প্রবাসী লাউঞ্জ করে আমাদের কোনো লাভ নেই। আমরা দীর্ঘদিন পর প্রবাস থেকে ফিরে দ্রুতই পরিবারের কাছে যেতে চাই। তখন বিমানবন্দরের ভিতরে অপেক্ষা অসহনীয় হয়ে ওঠে বরং আমাদের অভ্যর্থনা বা বিদায় জানাতে আসা পরিবারের জন্য আলাদা ফ্যামিলি লাউঞ্জ দরকার। আমাদের জন্য অপেক্ষা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, অসুস্থ হলে সাহায্যের ব্যবস্থাও নেই। বাস্তব চাহিদা বুঝে সরকারের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের বিমানবন্দরের প্রধান সমস্যাগুলো হলো, অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও মনিটরিং, দক্ষ জনবল ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি, যাত্রীসেবা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, পরিবহন ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা, অভিযোগ ব্যবস্থার অকার্যকারিতা, পরিবার-পরিজনের জন্য ন্যূনতম সুবিধার অভাব।
তাদের মতে, এসব সমস্যার সমাধান প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও মানবসম্পদ উন্নয়ন ছাড়া সম্ভব নয়। পাশাপাশি প্রয়োজন জবাবদিহিমূলক কাঠামো এবং সমন্বিত ব্যবস্থাপনা।
প্রবাসীরা মনে করেন, বড় কোনো প্রকল্প নয়; বরং কিছু ছোট, কার্যকরী পদক্ষেপ নিলেই সেবার মান বহুগুণ বাড়তে পারে।
তাদের কয়েকটি প্রস্তাব হলো, লাগেজ হ্যান্ডলিংয়ে কঠোর তদারকি ও সম্পূর্ণ সিসিটিভি কাভারেজ, ইমিগ্রেশন কাউন্টারে স্বয়ংক্রিয় গেট ও ডিজিটাল পদ্ধতির সম্প্রসারণ, কর্মকর্তাদের আচরণগত প্রশিক্ষণ, পরিবহনব্যবস্থার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ, পরিবারের জন্য আরামদায়ক অপেক্ষা কক্ষ ও বিশ্রামাগার, অনলাইন অভিযোগ ব্যবস্থাকে কার্যকর করা, ‘প্রবাসী লাউঞ্জ’ নয়, বাস্তবসম্মত ‘প্রবাসী পরিবার লাউঞ্জ’ নির্মাণ।
প্রবাসীর বলেন, দেশের জন্য কাজ করি, রেমিট্যান্স পাঠাই। বিনিময়ে শুধু সম্মান, নিরাপদ পরিবেশ আর সুশৃঙ্খল সেবা চাই আর কিছু নয়।
দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি প্রবাসীরা। অথচ দেশের মাটিতে পা রাখার পরই যদি তারা সম্মান, নিরাপত্তা এবং সাচ্ছন্দ্য না পান তা শুধু হতাশাজনকই নয়, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিমানবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন যতই হোক, মানবিক সেবা, শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা এবং যাত্রীবান্ধব পরিবেশ তৈরি না হলে প্রকৃত পরিবর্তন আসবে না।
প্রবাসীদের বাস্তব চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে দেশের বিমানবন্দরগুলোতে যাত্রীর আস্থা যেমন বাড়বে, তেমনি দেশে ফেরার অভিজ্ঞতাও হবে সম্মানজনক ও নিরাপদ।