মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫ ৩ আষাঢ় ১৪৩২
মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫
বিদেশি পতাকার ব্যবহার এবং আমাদের আইন
ইমামুল ইসলাম ও ধ্রুবব্রত দাস
প্রকাশ: শনিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২২, ৫:৪১ PM আপডেট: ০৫.১২.২০২২ ৫:০২ PM
বিশ্বকাপ ফুটবল বৈশ্বিক পরিমণ্ডলের সবচেয়ে বৃহৎ আয়োজন। এ আয়োজনে বিশ্বের ৩২ স্বাধীন রাষ্ট্র তাদের দেশের জাতীয় শক্তি আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রদর্শনের জন্য হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে নামে। জাতীয় আবেগের প্রতিযোগিতা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রদর্শনের এ সুযোগ সবাই নিতে পারে। কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্ব থেকে অনেক রাষ্ট্রকে বিদায় নিতে হয়। তাই অনেক রাষ্ট্রই এ বৈশ্বিক জমকালো আসরে সুযোগ পায় না। মাত্র বত্রিশটি জাতীয় টিম নিয়ে এই মহা আয়োজন হয়ে থাকে।

এ মহা আয়োজনের সাথে সারাবিশ্বের মানুষের আবেগ জড়িত। এই বিশাল মহাজজ্ঞে সরাবিশ্বের মানুষ যেমন এক প্লাটফর্মে এসে আনন্দ উপভোগ করে, তেমনি সারাবিশ্বের মানুষ তাদের প্রিয় দল কিংবা খেলোয়াড়দেরকে নিয়ে বিভক্ত হয়ে যায়।

দুই.
এ বিভাজন আমাদের বাংলাদেশেও প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশের ফুটবল ভক্তরা আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল এ দুই মেরুতে বিভক্ত। তাছাড়া জার্মানি, পর্তুগাল কিংবা অন্যান্য দেশেরও কিছু ফুটবল ভক্ত আছে। এদেশের ফুটবল-ক্রিকেট পাগল মানুষ তার প্রিয় দলের জন্য অনেক আবেগ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে থাকেন। তাদের প্রিয় দলের জাতীয় পতাকা-জার্সি এসবের পেছনে অনেক টাকা ব্যয় করে থাকেন। তাদের আবেগ প্রকাশ কতটা যৌক্তিক কিংবা অযৌক্তিক তা আমার বিশ্লেষণ না। বিশ্লেষণ বাংলাদেশের মাটিতে ঘরে ঘরে বিদেশি জাতীয় পতাকা প্রদর্শন এ নিয়ে বাংলাদেশের আইন কী বলে। আদৌ কি বাংলাদেশিরা এভাবে যত্রতত্র এভাবে উড়াতে পারে কী না তা বিশ্লেষণ জরুরি। 

তিন.
জাতীয় পতাকা যেকোনো দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক। এক্ষেত্রে বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে আমাদের দেশে বিদেশিদের জাতীয় পতাকা উত্তোলন কতটা আইন সঙ্গত? বাংলাদেশে বিদেশি পতাকা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। আইনের নয় নম্বর বিধিতে কে, কখন, কোথায়, কীভাবে বিদেশি পতাকা উত্তোলন করবে তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। 

১. বাংলাদেশে বিদেশি দূতাবাসের অফিস, কনস্যুলারের অফিস, রাষ্ট্রদূতের বাসভবন ও গাড়িতে সংশ্লিষ্ট দেশের পতাকা উত্তোলন করতে পারবেন। ২. বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী  ও মন্ত্রীবর্গ তাঁদের রাষ্ট্রীয় সফরকালে বাংলাদেশে তাঁদের দেশের পতাকা তাদের অবস্থানরত বাসভবনে উত্তোলন  ও গাড়িতে ব্যবহার করতে পারবেন। ৩. বাংলাদেশে বিদেশি রাষ্ট্রের জাতীয় দিবসের আয়োজন যদি তাদের দূতাবাস ব্যতিরেকে বাইরে অন্য কোথাও করা হয়, সেক্ষেত্রে তাঁদের জাতীয় পতাকার সাথে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা যথাযথ মর্যাদার সাথে উত্তোলন করতে হবে। ৪.  উক্ত আইন ব্যতিরেকে অন্য কোনো ভবন কিংবা গাড়িতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অনুমতি ছাড়া বিদেশি পতাকা উত্তোলন করা যাবে না।

চার.
বাংলাদেশিদের ফুটবল-ক্রিকেট আবেগ এতটাই তীব্র তারা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে অনেক কিছু করে থাকেন। গত বিশ্বকাপে এক ব্যক্তি জার্মানির বড় পতাকা বানিয়ে বিশ্বে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। যদিও সে ব্যক্তি কোনো ধনী ছিলেন না, নিতান্তই গরিব ছিলেন। আবার কোনো কোনো ব্যক্তি তাদের বিল্ডিং তাদের প্রিয় দলের রঙে রঞ্জিত করেন। প্রিয় দলের হরেক রকম জার্সি পরিহিত শিশু-যুবক-যুবতী-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা অহরহ দেখা যাচ্ছে। ফুটবলের প্রতি প্রেম থেকেই তারা এটা করে থাকেন।

সমষ্টিগতভাবে আবার অনেকে মিলে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা, আনন্দ মিছিল, র‌্যালি, দলবদ্ধ হয়ে বড় বড় স্ক্রিনে খেলা দেখা এ ধরনের মহাকারবার আমাদের দেশে সচারাচর দেখা যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হল মাঠে বিশ্বকাপ দেখার যে মহা আয়োজন তা রীতিমত বিস্ময়কর ব্যাপার। বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের ছবি ফিফার টুইটারে প্রকাশিত হয়েছে। যদিও এটা আমাদের জন্য গর্বের।

তবে বিশ্বকাপ নিয়ে আমাদের যে এত মাতামাতি তা অনেকে বাড়াবাড়ি পর্যায়ের মনে করেন। আমাদের দেশে অনেক মানুষ দরিদ্র, তাই এত টাকা এভাবে অপচয় না করে তা মানবিক কাজে ব্যয় করলে অনেক আরো ভাল হত এমন মন্তব্য রয়েছে অনেকের। টাকার অপচয় কিংবা বিশ^কাপ নিয়ে অতি আবেগের বাড়াবাড়ি এটি নিয়ে আমাদের কোনো প্রশ্ন নেই। আমাদের প্রশ্ন বিদেশি পতাকা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা আমাদের দেশের আইন মানছি কি না; কিংবা এর মাধ্যমে আমরা আমাদের পতাকার অবমাননা করছি কি না? বিদেশি পতাকা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের অতি আবেগ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ আইনসিদ্ধ কি না তা খতিয়ে দেখা জরুরি।

পাঁচ.
আমাদের দেশে বিদেশিদের জাতীয় পতাকা আমরা উত্তোলন করতে পারি কি না?  উত্তোলনের আইনগত ভিত্তি কি আছে? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজ করলে দেখা যাচ্ছে- আমারা কোনোভাবেই আমাদের দেশে বিদেশিদের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে পারি না, করলে সেটা আইনের লঙ্ঘন।

এছাড়া বাংলাদেশে বিদেশি জাতীয় পতাকা উত্তোলন আমাদের জাতীয় পতাকার প্রতি অবমাননা কি না তা একটু খতিয়ে দেখতে হবে। আমাদের পতাকা আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের জাতীয় পতাকার অবমাননা কোনোক্রমেই কাম্য হতে পারে না। অতি আবেগের বর্শবর্তী হয়ে আমাদের জাতীয় পতাকার প্রতি অবমাননা হয় এমন কাজ থেকে আমাদের অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। কোন কাজে আমাদের জাতীয় পতাকার প্রতি অবমাননা হয়, কোন কাজে আমাদের জাতীয় পতাকার প্রতি অবমাননা হয় না তা সম্পূর্ণ আইনগত ব্যাপার। বিদেশি পতাকা নিয়ে আমাদের অতি আবেগ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ আমাদের জাতীয় পতাকার প্রতি অবমাননার শামিল কি না তার আইনগত দিকও পর্যালোচনা জরুরি।

দু’দলের মধ্যে যখন কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়, তখন  স্টেডিয়ামে বিদেশি জাতীয় পতাকা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোন আইন প্রযোজ্য তা আমাদের দেশের আইনে স্পস্টভাবে উল্লেখ নাই। যেমন বাংলাদেশ-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ যদি আমাদের দেশে অনুষ্ঠিত হয় সেক্ষেত্রে উভয় দেশের পতাকা কোন নিয়মে উত্তোলিত হবে? বিদেশি জাতীয় পতাকা স্টেডিয়ামে উত্তোলনের ক্ষেত্রে কোন বিধি বা আইন প্রযোজ্য হবে তাও বিচার-বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা কওে সুষ্পষ্ট করা জরুরি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে- আইন তো মানুষের জন্য। আমাদের দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী আবেগ-ভালোবাসার বর্শবর্তী হয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলে বিদেশিদের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করছে, পতাকা নিয়ে শোভাযাত্রা করছে, বাড়িতে-বাড়িতে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে পতাকা উত্তোলন করে বিশ্বকাপ ফুটবল উপভোগ করছে। দলবদ্ধভাবে বিদেশিদের জাতীয় পতাকা নিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখছে। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষের এ সামষ্টিক আবেগ কি আমাদের দেশের আইন পরিপন্থি? তাদের এ সমষ্টিগত আবেগ দ্বারা কি তারা আমাদের দেশের আইন লঙ্ঘন করছে কি না তা ভাবতে হবে; কিংবা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে এ আইনটি মানানসই কি না- তা পর্যালোচনা জরুরি। এক্ষেত্রে বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে বিদেশি রাষ্ট্রের জাতীয় পতাকার যত্রতত্র প্রদর্শন করতে আমরা পারব কি না, সেক্ষেত্রে আমাদের বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট বিদেশি পতাকা ব্যবহার আইনটি পর্যালোচনা করে নতুন কোনো নির্দেশনা দিতে পারেন কি না এটিই এখন বিবেচ্য বিষয়।
লেখক : ইমামুল ইসলাম, সাংবাদিক; ধ্রুবব্রত দাস, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী

বাবু/এসআর
« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত