সৃষ্টির পেছনের সংকট নিয়ে প্রাণখুলে কথা বলেছেন তারা। নির্মাণের কণ্টকাকীর্ণ পথ মাড়াতে গিয়ে কীভাবে হৃদয়ে রক্ষক্ষরণ সৃষ্টি হয়েছে, কীভাবে তরী বেয়ে চলছেন সেই স্মৃতি আর কষ্টের কথা উঠে এসেছে ঢাকা লিট ফেস্টে নির্মাতাদের বর্ণনায়।
গত শনিবার লিট ফেস্টের দ্বিতীয় দিনে বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত ‘ওটিটি: দ্য ফিউচার অব কনটেন্ট ক্রিয়েশন’ শীর্ষক আলোচনায় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে নানা আশংকার কথা তুলে ধরা হয়। সম্ভাবনাময়ী এ খাতে সরকারি বিধিনিষেধ এলে ক্রমেই মুখ থুবড়ে পড়লে পারে বলে মন্তব্য করেন কবি সাজ্জাদ শরিফ। তিনি বলেন, ‘সরকার ওটিটির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলে সেটা মেধাবী নির্মাতাদের জন্য বড় বাধা তৈরি করবে। এ ধরনের বাধা দেয়ার প্রবণতা ইতোমধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমি মনে করি, এটার মধ্য দিয়ে দেশ সৃজনশীলভাবে ক্ষতির মুখে পড়বে। নির্মাতারা যে গল্প বলতে চান, সেটা বলতে দিতে হবে। এ ধরনের চিন্তায় সৃজনশীল ক্ষতির পাশাপাশি ব্যবসায়িকভাবেও ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। মূল কথা হলো বিশ্বের সমস্ত প্ল্যাটফর্ম যে গল্প বলতে চায়, সেই গল্প বলতে পারবে আর আমি বলতে পারব না কেন?’
সাহসী গল্প বলার জড়তা থাকায় পৃথিবীজুড়ে তাল মেলানো যাচ্ছে না এতে করে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সবাই বলে মনে করেন সাজ্জাদ শরিফ। তার মতে, ‘গল্পের অপূর্ণতা থেকে যায় তাই নিজের গল্পটাই বলতে হবে। বাঙালিরা সব গল্প দেখে কিন্তু বাঙালিরা যে গল্পের মধ্যে বাঁচে, সংগ্রাম করে, লড়াই করে, স্বপ্ন দেখে, জয়ী হয়, পরাজিত হয়, সেই গল্পটাকে ভালোভাবে তুলে আনতে হবে।’
এই নির্মাতাদের মতে, ‘পেপ্যালের মতো আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ের বাংলাদেশে কার্যকর না হওয়ায় চরকিসহ দেশীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো দেশের বাইরের দর্শকের কাছে সহজেই পৌঁছাতে পারছে না। আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ে কার্যকর করলে, দেশের বাইরে থেকে ডলার এলে, শুধু ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোই লাভবান হবে না, এখান থেকে বাংলাদেশের রাজস্বও সমৃদ্ধ হবে।’
নির্মাতা সৈয়দ আহমেদ শাওকী বলেন, ‘আমাদের নির্মাণে পশ্চিমের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। চরিত্র নির্মাণে পশ্চিমের ধাঁচ থাকে। ইউরোপিয়ান সিনেমার আদলে আমাদের সিনেমার আবেগের দৃশ্যগুলো নির্মাণ করা হয়। ওদের সিনেমার একজন (চরিত্র) মন খারাপ করে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষের মন খারাপ হলে এভাবে তাকিয়ে থাকে না, ভেউ ভেউ করে কাঁদে। পশ্চিমাদের কাছে এটা উচ্চস্বরে কান্না হয়তো মেলোড্রামাটিক মনে হতে পারে; কিন্তু এটাই আমাদের বাস্তবতা, আমাদের বাস্তবতাকেই সিনেমায় তুলে আনতে হবে। যেভাবে আমি, আমার মা, ভাই, বোন কাঁদে, সেভাবেই আমার চরিত্রগুলো কাঁদবে, আমি এটাকে মেলোড্রামাটিক বলতে পারি না।’
একই দিনে কনকনে শীতের পড়ন্ত বিকেলে ‘থ্রু হার লেন্স’ সেশনে নারী নির্মাতারাও তাদের ক্ষোভ উতরে দেন। নির্মাণের প্রায় ক্ষেত্রেই মানসিকতার সমস্যা প্রকট হয়ে আছে মস্তব্য করে নির্মাতা তাসমিয়াহ আফরীন মৌ বলেন, ‘মানসিক ও পলিসির পরিবর্তনর মাধ্যমে সংকটের পথটাকে আরো মসৃণ করা সম্ভব। এ যেমন ‘ইতি তোমারই ঢাকা’নামে একটা অ্যান্থোলজি সিনেমা হয়েছিল। এখানে ১১ জন পুরুষ পরিচালক ছোট ছোট করে তাদের চোখে দেখা সিনেমা নির্মাণ করেছেন। তাহলে সেখানে নারীর চোখে দেখা গল্প কই? নারীদের চোখে দেখা গল্প বা নারীজীবনের গল্প পুরুষরা বলে যাচ্ছে কিন্তু নারীরা বলতে পারছে না।’
কেবল শুধু নারী দিবসে নারী নির্মাতাদের কদর কিছুটা বাড়ে- এমন মন্তব্য করে নির্মাতা হুমায়রা বিলকিস বলেন, ‘আমি একটা ওটিটি প্ল্যাটফর্ম থেকে ফোন পেয়েছিলাম নারী দিবসের প্রকল্পে কাজ করতে। সেটাও খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। আমি শুধু পরিচালনা করব বাকী অন্য সব তারা করবেন। এভাবে কি কাজ করা যায়?’
কিছুটা আক্ষেপ এর সুরে নির্মাতা রুবাইয়াত হোসেন বলেন, ‘কিছুদিন আগে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকি নতুন ২৫টি কনটেন্ট নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু সেখানে একজন নারী নির্মাতা নেই। তারা নারী নির্মাতার ওপর আস্থা রাখতে পারে না, কিন্তু নারীদের প্রজেক্টগুলো ঠিকমতো শেষ হওয়ার উদাহরণ বেশি।’
ফিচার ডকুমেন্টারি প্রদর্শনের জন্য প্রেক্ষাগৃহ পাওয়া যায় না বাংলাদেশে তাই সেই কষ্টের কথা তুলে ধরে নির্মাতা হুমায়রা বিলকিস বলেন, ‘আমার নির্মিত বিলকিস অ্যান্ড বিলকিস (থিংস আই কুড নেভার টেল মাই মাদার) আন্তর্জাতিক ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল আমস্টারডামসহ কিছু আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রদর্শিত হয়েছে। কিন্তু দেশে সেটি প্রদর্শন করতে পারছিন না। এমনকি কেউ নিতে চান না পরিবেশনার দায়িত্বও। শুধু ফিচার ডকুমেন্টারি নয়, স্বাধীন চলচ্চিত্রগুলোও অনেক সময় নিতে চান না পরিবেশক ও হল মালিকরা। ’
তৃতীয় দিনে 'কালচার কিপারস' সেশনে নির্মাতা অং রাখাইন অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘প্রথম সিনেমা বানাতে আমার ১৩ বছর লেগেছে, যদিও সেটা আলোর মুখ দেখেনি। যাদের উপরে সিনেমা বানাচ্ছি, ওদের ভাষা-সংস্কৃতি বুঝতেই আমার ১০ বছর লাগছে। আমার দম থাকবে, আমি সেলফ সেন্সরে বিশ্বাস করি না। সেলফ সেন্সর দিয়ে কাজ করলে আমাকে খুঁজে পাবেন না, ফেইক কাজ হবে। চেষ্টা করি না বলা গল্প বলার, স্ক্রিনে আনার। যতই বাঁধা আসুক।'
৫ জানুয়ারি শুরু হয় দেশি বিদেশি কবি, সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ, লেখকদের মিলনমেলা ঢাকা লিট ফেস্ট ২০২৩। চার দিনের এই উৎসবে ১৭৫টির বেশি সেশনে অংশ নিয়েছেন পাঁচটি মহাদেশের ৫০০-এরও বেশি বক্তা, শিল্পী ও চিন্তাবিদ। রোববার বহুরৈখিক এই আয়োজনের পর্দা নামে।
-বাবু/এ.এস