যুগ যুগ ধরে মঙ্গোলীয় জাতি-গোষ্ঠীর পরিচয় ছিল তারা যাযাবর যোদ্ধা, আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত এবং নৃশংস কৌশলে পারদর্শী। নির্দয় জাতি হিসেবে তাদের পরিচিতি আরো বিস্তৃতি লাভ করে, যখন তারা মুসলিম ভূখণ্ডে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, মুসলিম শহরগুলো ধূলিস্যাৎ করে দেয়।
মূলত তারা সেখানে মৃত্যু ও জরা ছাড়া আর কোনো কিছু ছেড়ে আসেনি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই মঙ্গোলীয়রাই এক সময় ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয় এবং ইসলামের প্রচার-প্রসারে অনন্য অবদান রাখে।
যাযাবর বিজেতা: চেঙ্গিস খান ছিলেন একজন মঙ্গোল সেনাপতির ছেলে। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। তিনি উত্তর-পূর্ব এশিয়ার যাযাবর জাতিগুলোকে একত্র করে এবং প্রভাবশালী মঙ্গোলীয় গোত্রপ্রধানদের পরাজিত করে পৃথিবীর বৃহৎ এক সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। যদিও তাঁর উত্থান হয়েছিল ভয়াবহ নৃশংসতার মধ্য দিয়ে, তবে সামরিক কৌশল ও প্রতিভায় মঙ্গোলীয়দের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতেই হবে।
মুসলিম বিশ্বে গণহত্যা: ১২১৯ থেকে ১২২২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উত্তর-পূর্ব ইরানে চেঙ্গিস খানের সামরিক অভিযানের মাধ্যমে মুসলিম ভূখণ্ডে মঙ্গোলীয়দের অভিযান শুরু হয়। এরপর মাত্র ৪০ বছরে তারা চারটি প্রভাবশালী মুসলিম সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়। সেগুলো হচ্ছে আব্বাসী, আইয়ুবী, সেলজুক ও খাওরিজম। তারা মুসলিম বিশ্বের অসংখ্য সমৃদ্ধ নগরী ধুলার সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। মার্ভ, নিশাপুর ও উত্তর আফগানিস্তানের বলখ শহরে নারী-পুরুষ নির্বিচারে গণহত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন চেঙ্গিস খান। মঙ্গোল রাজদরবারের ঐতিহাসিক জুভাইনি লিখেছেন, মঙ্গোলীয়দের অভিযানের পর মার্ভে নিহতদের সংখ্যা গণনা করতে বেঁচে থাকা মানুষের ১৩ দিন সময় লেগেছিল।
মার্কিন ইতিহাস গবেষক ডেভিড মরগান লিখেছেন, মধ্য এশিয়ায় মঙ্গোল অভিযান ছিল একটি গণহত্যার প্রচেষ্টা মাত্র। চেঙ্গিস খান নিজে এই গণহত্যাকে উৎসাহিত করেছে। ঐতিহাসিক ইবনে আসির লেখেন, চেঙ্গিস খান বুখারা নগরী জয় করার পর নগরবাসীর উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘হে লোক সকল, নিশ্চয়ই তোমরা মহাপাপ করেছ। তোমাদের নেতারাও পাপ করেছে। যদি জিজ্ঞাসা করো, আমার কথার প্রমাণ কী? আমি বলব, আমিই তার প্রমাণ। যদি তোমরা পাপ না করতে, তবে আমার মতো শাস্তিকে স্রষ্টা তোমাদের কাছে পাঠাতেন না।’
১২২৭ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিস খানের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে তিনি উত্তর চীন ও ইরান দখল করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় মঙ্গোলীয় অভিযান শুরু হয়। দক্ষিণ চীন ও পূর্ব ইউরোপের অভিমুখে তাদের অভিযান পরিচালিত হয়। ১২৫৫ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিস খানের নাতি হালাকু খান মঙ্গোলীয়দের শাসক নিযুক্ত হন। তিনি ইরান থেকে ভূমধ্য সাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ মুসলিম ভূখণ্ড দখলের উদ্দেশে অভিযান শুরু করে। যার পরিণামে ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের পতন ঘটে। বাগদাদে তারা নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
যেভাবে মুসলমান হলো: আইনে জালুতের যুদ্ধে মঙ্গোলীয় বাহিনীর পরাজয়ের পর মঙ্গোলীয় সাম্রাজ্যে বিভক্তি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। চেঙ্গিস খানের ছেলে জুচি খান গোল্ডেন হর্ড অঞ্চল, কুবলাই খান (গ্রেট খান) চীন আর হালাকু খান ও তার উত্তরসূরিরা ইরান ও রুশ অঞ্চল শাসন করতে থাকে। এদের মধ্যে গোল্ডেন হর্ডের খানরা প্রথম ইসলাম গ্রহণ করে এবং তাদের পর পারস্যের ইলখানিদ সাম্রাজ্যের খানরা মুসলমান হয়।
চেঙ্গিস খানের নাতি ও জুচি খানের ছেলে বারকি খান মঙ্গোলীয় শাসকদের ভেতর প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। ১২৬৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ১০ বছর গোল্ডেন হর্ড শাসন করেন। বারকি খানের কয়েকজন সভাসদও ইসলাম গ্রহণ করেন। বারকি খান মুসলিম বিশ্বে তাঁর পূর্বপুরুষ ও পরিবারের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের জন্য অনুতপ্ত ছিলেন। আইনে জালুতের যুদ্ধে মঙ্গোলদের পরাজয়ের পর বারকি খান মামলুক সুলতান কুতুজের সঙ্গে সমঝোতা করেন। ১২৬২ খ্রিস্টাব্দে বারকি খান ও হালাকু খানের মধ্যে যুদ্ধ হয়। ককেশাস পাহাড়ের পাদদেশে দুই বাহিনীর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের ফলাফল ছিল অমীমাংসিত। তবে ধারণা করা হয়, বারকি খান যদি হালাকু খানকে প্রতিহত না করত, তবে হয়তো ইসলামের পবিত্র ভূমি মক্কা-মদিনাও আক্রান্ত হতো। বারকি খানের উত্তরসূরি টোডে-মঙ্কে ও উজবেক—যার নামে উজবেকিস্তানের নামকরণ করা হয়েছে তারাও মুসলিম হয়েছিলেন।
ইলখানিদ শাসক ও হালাকু খানের প্রত্যক্ষ উত্তরসূরি গাজান খান (১২৯৫-১৩০৫ খ্রি.) ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন। তিনি ১৭ জুন ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দে শায়খ সদরুদ্দিন ইবরাহিম হামাভি (রহ.)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। মুসলিম হওয়ার পর মাহমুদ গাজান নাম ধারণ করেন। যদিও গাজান খানের সঙ্গে আঞ্চলিক মুসলিম শাসকদের রাজনৈতিক বিরোধ ছিল, তবে তিনি ইসলামী জ্ঞানচর্চা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। সংখ্যালঘুদের প্রতিও তিনি ছিলেন অত্যন্ত উদার। সবাই তাঁর রাজ্যে স্বাধীনভাবে ধর্মপালনের সুযোগ পেত।
তৃতীয়ধাপে ইসলাম গ্রহণ করেন চাগতাই খানাতের শাসক তারমাশিরিন খান (১৩৩১-১৩৩৪ খ্রি.)। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করাই তিনি বৌদ্ধ ও টেংগ্রিস্ট মোঙ্গলদের ক্ষোভের শিকার হন এবং তারা তাঁকে হত্যা করে। তবে তার পরে তুঘলক তৈমুর খান (১৩৪৭-১৩৬০ খ্রি.) ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মধ্য এশিয়ায় একটি শক্তিশালী মুসলিম সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন ঘটান। তিনি তাঁর সাম্রাজ্য পাকিস্তানের লাহোর পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। তৈমুরের বংশধর সম্রাট জহিরুদ্দিন বাবর ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন।
এভাবেই যে চেঙ্গিস নিজেকে মুসলমানের জন্য ঈশ্বরের শাস্তি দাবি করেছিলেন তার উত্তরসূরিরা ইসলামের সেবকে পরিণত হয়। মাত্র দেড় শ বছরের মধ্যে তার সাম্রাজ্যের চার ভাগের তিন ভাগ মুসলিম সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।
বাবু/এ আর