একদিন আগেও যেখানে ছিলো ক্রেতা-বিক্রেতার কোলাহাল সেখানে এখন ধ্বংসস্তূপ। প্রতিদিন যারা লাখ লাখ টাকা গুনতেন তারা এখন পথে। অভিশাপের আগুন একদিনের ব্যবধানে নিঃস্ব করে দিয়েছে কয়েক হাজার ব্যবসায়ীকে। হাজারো স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তাদের। ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যখন ব্যবসায়ীরা বিলাপ করছেন তখন এক শ্রেণির সুযোগ সন্ধানীরা সেখান থেকে কাপড় লুটপাট করছেন। ব্যবসায়ীদের কাপড় নিয়ে নিজেদের মধ্যেও বাঁধছে বচসা। চোখের সামনে এ দৃশ্য শুধু অপলক চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারছেন না বাকরুদ্ধ ব্যবসায়ীরা।
জানা যায়, যেখানে রঙিন কাপড়গুলো মোড়ানো ছিল স্বচ্ছ পলিব্যাগে, আজ সেসব কাপড়ের রঙ একই কালো। পরশু ও ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে যে বাজার ছিল জমজমাট সেখানে ধ্বংসস্তূপ আর হাহাকার। নতুন কাপড়ের গন্ধের বদলে সেখানে শুধুই পোড়া গন্ধ। বঙ্গবাজারের পাশপাশি ভয়াবহ এই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের সাততলা এনেক্সকো টাওয়ারেও। অগ্নিকাণ্ডের পর ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও এনেক্সকো টাওয়ারের ৫ম ও ওপরের তলাগুলোতে পানি ছিটানো অব্যাহত রেখেছে ফায়ার সার্ভিস।
৩য়, ৪র্থ ও ৫ম তলা থেকে একের পর এক বস্তা ফেলা হচ্ছে নিচে। অগ্নিকাণ্ডের পর অবশিষ্ট কাপড়সহ যেসব মালামাল রয়েছে মূলত সেগুলোই বস্তায় করে নিচে ফেলা হচ্ছে। চারদিকে অসংখ্য উৎসুক মানুষের উপস্থিতি। সব মিলিয়ে মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচির চেনা আবহেও অপরিচিত এক বঙ্গবাজার দাঁড়িয়ে আছে ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষত নিয়ে।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৬টায় আগুন লাগার পর সাড়ে ৬ ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ততক্ষণে ধ্বংস হয়ে গেছে সব। পুরো বদলে গেছে বঙ্গবাজার এলাকার দৃশ্যপট।
বঙ্গবাজারসহ আশপাশের মার্কেটে কুলির কাজ করতেন আক্কাস আলী নামের একজন। তিনি বলেন, এখন ঈদের বাজার, এই সময় এসব মার্কেটে মানুষে গমগম করতো। সারা দেশ থেকে বিক্রেতারা পাইকারি মাল নিতে আসতো, এছাড়া খুচরা বিক্রিসহ বিদেশি ক্রেতাদের আনাগোনা থাকতো এসব মার্কেটে। সব দোকানে কাস্টমারদের ভিড় লেগে থাকতো, আমরা তাদের মালামাল এক স্থান থেকে অন্য স্থানে এনে দিতাম। কিন্তু আজ সব থেমে আছে, চারদিক থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সবার মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কোনো ক্রেতা বিক্রেতার কোনো ব্যস্ততা নেই। আমরাও আজ বেকার, সবার ক্ষতি।
এনেক্সকো টাওয়ারের পাশেই অস্থায়ী চায়ের দোকান ছিল সাহাবুদ্দিন মিয়ার। তিনিও বলেন, প্রতিদিন সকাল থেকে মানুষের ভিড়, ব্যস্ততা লেগে থাকতো। কিন্তু আজ সব পুড়ে গেছে, কিছুই নেই, নেওয়ার মতো আর কিছুই নেই। ক্রেতা-বিক্রেতার কারও ব্যস্ততা নেই। আগুনে সব শেষ করে দিয়েছে এখানকার সবার। ছাই আর ধোঁয়া ছাড়া আর কিছুই নেই, ব্যবসায়ীরা পথে বসে গেছে আজ।
এদিকে বাকরুদ্ধ ব্যবসায়ীদের সামনে যেন হরিলুট চলছে। আগুনে ক্ষতিগ্রস্থ কাপড়গুলো নিতে যেন সুযোগ সন্ধানীদের কাড়াকাড়ি চলছে। শত শত লোক ধ্বংস্তুপের ভেতর থেকে কাপড় কুড়োনোয় যেন ব্যস্ত। যেখানে মালিকরা তাদের সব হারিয়ে বিলাপ করছেন ঠিক তখনি তাদের সামনেই সুযোগ সন্ধানীরা তাদের কাপড় চোপড় সরাচ্ছেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, কিছু দোকান মালিক তাদের কাপড় চোপড় সরিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখছেন সেখান থেকেও কাপড় নিয়ে চলে যাচ্ছে এ সুযোগ সন্ধানীরা। দৃশ্যটি এমন যেন সেখানে হরিলুট চলছে।
ব্যবসায়ী আবু হানিফ বলেন, আমরা কি করবো। কি বা করার আছে। কোটি টাকার কাপড় যেখানে চলে গেছে সেখানে আমি কি খুঁজবো। তিনি বলেন, খোঁজার আর কিছু নাই। এক আল্লাহকে ডাকা ছাড়া কোনো পথ নেই। গতকালও আসছিলাম আজও আসছি। মনকে কিছুতেই মানাতে পারছি না। কি করবো, আমাদেরকে কে দেখবে এসব কিছুই ভাবছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ যে চোখের সামনেই তো আমাদের দোকানের মালামাল নিয়ে যাচ্ছে কি বলবো আমরা। আমাদের কিছু বলার নাই।
মিনহাজুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, আমার দুটি দোকান ছিল কিন্তু এখন আমি নিঃস্ব। দুই দোকানে প্রায় ২ কোটি টাকার কাছাকাছি মালামাল। কিছুই বের করতে পারেনি। আর কিভাবেই বের করবো। কাল যখন আসি ততক্ষণে সবশেষ। আর এখন যাদের দেখছেন এদের আমরা চিনিই না। এরাই এখন কাপড় চোপড় ভালো-পোড়া নিয়ে যাচ্ছে। কি বলবেন তাদের। মানুষের বিবেক যদি লোপ পায় তাহলে আমরা কি বলবো।
তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের চিন্তা আমরা কি এ বিপদ কাটিয়ে উঠবো। সবাই তো আশ্বাস দিচ্ছে কিন্তু সেই আশ্বাসের ফল আমরা কবে পাবো, কিভাবে পাবো। এ দুঃশ্চিন্তায় আছি। আমরা যারা এখানে ব্যবসা করি তারাতো এই চিন্তাই করছি। আর আমাদের সামনে কি ঘটছে। কিছু লোকজন ভালো খারাপ কাপড় নিয়ে চলে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, আমাদের কিছু লোকজন কিছু কাপড় নিয়ে পাশে রাখছে সেখান থেকেই নিয়ে চলে যাচ্ছে। এখন আমরা আসলে বাকরুদ্ব হয়ে গেছি। একদিন আগেই আমরা কি ছিলাম আর এখন কি। এমন কথা বলতে বলতে মিনহাজুলের চোখে জল আসে। বাকরুদ্ধ মিনহাজুল শুধু বলে দোয়া কইরেন।
তৌকির আহমেদ নামের আরেকজন ব্যবসায়ী বলেন, অনেকে হালকা পোড়া বা ভিজে যাওয়া কাপড় নিয়ে গেছে আমরা কিছু বলিনি। সবচেয়ে দুঃখ লাগল আমার ভালো মালামালের বস্তাটাও নিয়ে গেছে।
গোডাউনের অবশিষ্ট কাপড় রক্ষা করতে পারলেও বেশির ভাগ কাপড়ই আগুনে ছাই হয়েছে। গোডাউনের অবশিষ্ট কাপড় রক্ষা করতে পারলেও বেশির ভাগ কাপড়ই আগুনে ছাই হয়েছে।
বঙ্গবাজারের সামনে হোসপাইপের পানিতে ডুবে থাকা কাপড়ের স্তূপ সরিয়ে কাপড় সংগ্রহ করছেন কয়েকজন। কাছে গিয়ে জানতে চাইলে জানান, ঈদে পরিবারের জন্য পোড়া কাপড় সংগ্রহ করছেন তারা। স্তূপ থেকে বেছে বেছে হালকা পোড়া কাপড় মতিন মিয়া নামের একজন দিনমজুর।
মতিন মিয়া বলেন, ‘আমরা পইড়ে থাকা হালকা পোড়া কাপড় নিচ্ছি। এর মধ্যে থেইকা যদি দু-একটা ভালো খুঁজে পাই, তাইলে নিজেও পরতি পারবো, ছেলেমেয়েরাও পরতি পারবে।’ বস্তা থেকে কাপড় চুরির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা ভালো কাপড় ধরি নাই। আমরা বস্তার ওদিকেও যাই নাই। বস্তা মাথায় কাপড় চুরি করছে টোকাইরা আর আশেপাশের লোকজনরা। ওরা দল বেঁধে মাথায় করে নিয়ে গেছে।’
মিনহাজুল, হানিফের মত হাজারো ব্যবসায়ী ধ্বংসস্তূপের আশে পাশে নির্বাক দাঁড়িয়ে আছেন। একদিন আগে বঙ্গবাজার, আর এখনকার বঙ্গবাজার। তাদের মনে হাজারো প্রশ্ন তারা কি আবার দাঁড়াতে পারবেন? নাকি এখনেই শেষ গন্তব্য।
গতকালের আগুনে বঙ্গবাজারসহ আশপাশের ৬টি মার্কেটের ৫ হাজার ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান। প্রাথমিকভাবে আগুনের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো জানা যায়নি।
-বাবু/এ.এস