সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের গোটা গ্যালারি তখন দাঁড়িয়ে। প্রায় ২৫ হাজার দর্শকের তুমুল করতালিতে প্রকম্পিত চারপাশ। সেখানে সামিল স্ত্রী, সন্তান, স্বজনেরাও। ওয়ার্নার একবার চুলে হাত বুলালেন মাথা নিচু করে। এরপর হেলমেটের সামনে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রতীকে চুম্বন এঁকে দিলেন। হাঁটতে হাঁটতেই দুহাত প্রসারিত করে এবং ব্যাট উঁচিয়ে সবার অভিনন্দনের জবাব দিলেন। এরপর মাঠ ছেড়ে সিড়ি ভেঙে উঠে গেলেন ড্রেসিং রুমে। সাদা পোশাকে শেষবার! ধারাভাষ্যকক্ষের ইসা গুহ দারুণভাবে তুলে ধরলেন মুহূর্তটিকে, ‘গেম ওভার ফর দা গেম চেঞ্জার…।’
ওয়ার্নারের ক্যারিয়ারের মূল সুরই তো এটা। খেলার মোড় বদলে দিতেন তিনি। ব্যাট হাতে তার ছন্দে থাকা মানেই খেলাটা নতুন ধাপে পৌঁছে যাওয়া, প্রতিপক্ষের বোলিং ও মনোবল বিধ্বস্ত হওয়া। সেই ব্যাট আর ঝড় উত্তাল হবে না সাদা পোশাকে। ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসেও দারুণ সব স্ট্রোক খেলে ওয়ানডের গতিতে ফিফটি ছুঁয়ে দলকে জয়ের কাছে নিয়ে গিয়ে বিদায়বেলা রাঙালেন ওয়ার্নার। ম্যাচ জিতে পাকিস্তানকে ৩-০তে হোয়াইটওয়াশ করল অস্ট্রেলিয়া। সবকিছুই হলো তার ঘরের মাঠে নিজ শহরের দর্শকদের সামনে। ঝলমলে বিদায় তো একেই বলে!
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার পদচারণা শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে টি-টোয়েন্টি দিয়ে। সেবার তার দলে ডাক পাওয়াটাই তোলপাড় তুলেছিল বেশ। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেই তখনও তার পা পড়েনি! লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ ও ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি খেলেছেন ততদিনে ১০টি করে। তবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট না খেলেই জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার ঘটনা অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে বিরল।
সীমিত ওভারে ওপেন করা শুরু করলেও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নতুন বলের সামনে তাকে নিয়ে সংশয় ছিলই। এখানেও শুরুটা তাই হয় মিডল অর্ডারে। কিন্তু পাঁচটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে কিছু স্ট্রোকের ঝলক দেখালেও ফিফটি করতে পারেননি একটিও। এখানেও তাকে ভার দেওয়া হয় ইনিংস শুরুর। ওপেনিংয়ে প্রথম সুযোগেই খেলেন ৯৯ রানের ইনিংস, পরেরটিতে করেন সেঞ্চুরি। পাকাপাকি হয়ে যায় তার পরিচয়। তিন সংস্করণেই ওপেনার। আগ্রাসী ওপেনার।
সেই পথ ধরেই ২০১১ সালের ডিসেম্বরে তার টেস্ট অভিষেক নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে। প্রথম টেস্টে ভালো কিছু করতে না পারলেও পরের ম্যাচেই উপহার দেন সেঞ্চুরি। পঞ্চম টেস্টে ভারতের বিপক্ষে পার্থে খেলেন ১৫৯ বলে ১৮০ রানের ইনিংস। টেস্টেও জায়গা আপন করে নেন। ক্রমেই হয়ে ওঠেন তিন সংস্করণে অস্ট্রেলিয়ার ভরসা। ব্যাটিংয়ের দর্শন সব সংস্করণেই একই- আক্রমণ। নিজের মতো খেলেই তিনি ছাপ রাখেন প্রবলভাবে। প্রতিটি সংস্করণেই সফল আধুনিক ব্যাটসম্যাদের ছোট্ট তালিকায় নিজের নাম লেখান।
তার ব্যাটিংয়ের ধরনের কারণেই সবসময় খুব ধারাবাহিক হতে পারেননি। ক্যারিয়ারে দুই দফায় টানা তিন ইনিংসে সেঞ্চুরি করেছেন বটে, তিন দফায় এক ম্যাচে করেছেন জোড়া সেঞ্চুরি। তবে দারুণ ধারাবাহিক খুব একটা হতে পারেননি। ক্যারিয়ারের শুরুর ৬ টেস্ট বাদ দিলে পরের সময়টায় আর কেবল ৭ টেস্টে তার গড় ছিল পঞ্চাশের ওপর। ক্যারিয়ার শেষ করলেন ৪৪.৫৯ গড় নিয়ে। খুব খারাপ না হলেও এই ব্যাটিং গড় অন্য অনেক আধুনিক গ্রেটের তুলনায় হৃষ্টপুষ্ট নয়। কিন্তু কার্যকারিতায় তার জুড়ি মেলা ভার।

আশির বেশি স্ট্রাইক রেটে তিনি ৩৩৫ রানের ইনিংস খেলেছেন, প্রায় ৮৯ স্ট্রাইক রেটে আড়াইশ করেছেন, আশির কাছে স্ট্রাইক রেটে ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন। একশর বেশি স্ট্রাইক রেটে তার শতরান ৬টি, ওপেনারদের মধ্যে যা যৌথভাবে সর্বোচ্চ শেবাগের সঙ্গে। সব পজিশন মিলিয়েই তাদের চেয়ে বেশি আছে কেবল অ্যডাম গিলক্রিস্টের (৭টি)। সবকিছুতেই ফুটে উঠছে তার ব্যাটিংয়ের ধরন। এভাবে খেলেই তিনি রাঙিয়েছেন, ছাপ রেখেছেন, দলকে জিতিয়েছেন। ‘ম্যাচ উইনার’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এক সময়ের বিস্ফোরক টি-টোয়েন্টি ওপেনার ১১২টি টেস্ট খেলেছেন, নিজেকে তুলে নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের সফলতম টেস্ট ওপেনারের উচ্চতায়। এই গল্পেও মিশে আছে তার জয়গান।
তবে এসব পরিসংখ্যান, রেকর্ড তো স্রেফ বিশ্লেষণ আর কাটাছেঁড়ার অংশ। নইলে তার কাছে এসবের মূল্য তেমন একটা ছিল না কখনোই। নিজেকে তিনি সেভাবে মেলেও ধরতে চাননি। লোকে তাকে সেভাবে চেনেওনি। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তো, আনন্দদায়ী। টেস্ট ক্রিকেটেও যিনি পসরা মেলে ধরতেন বিনোদনের।
বিদায়বেলায় তিনি নিজেও তা বললেন। লোকে কিভাবে মনে রাখবে তাকে? শেষ টেস্ট শেষে এই প্রশ্নে ওয়ার্নার বললেন, “রোমাঞ্চকর ও বিনোদনদয়ী একজন হিসেবে… খেলার ধরন দিয়ে যে লোকের মুখে হাসি ফুটিয়েছে।”
বিদায়ী ইনিংসেও ঝলক
চতুর্থ দিন পাকিস্তান খেলতে নেমেছিল ৬৮ রানে ৭ উইকেট নিয়ে। সেখান থেকে খুব বেশি দূর যাওয়া হয়নি পাকিস্তানের। ১১৫ রানেই শেষ হয়েছে পাকিস্তানের ইনিংস। লিড ছিল ১২৯। অজিদের সামনে টার্গেট ১৩০। নিজের শেষ ইনিংস খেলতে নেমে প্রতিপক্ষের গার্ড অব অনার পেয়েছেন ওয়ার্নার। খেলেছেন নিজের স্বভাবসুলভ ইনিংস। ৬১ বলে ৭ চারের সাহায্যে তুলে নিয়েছেন অর্ধশতক।
আমের জামালকে সঙ্গে নিয়ে চতুর্থ দিনের শুরু করেছিলেন মোহাম্মদ রিজওয়ান। পাকিস্তানের ভাগ্যে কী আছে, তা বোঝা গিয়েছিল তৃতীয় দিনের শেষেই। তবে সেখান থেকেও ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নটা তারা দেখেছিল, ফর্মে থাকা এই দুই ব্যাটারের কল্যাণে। কিন্তু অজিদের বোলিং আক্রমণের সামনে তা আর টিকলো কই। দলীয় ১০৯ রানে ন্যাথান লায়নের বলে লেগ স্লিপে ক্যাচ নেন ওয়ার্নার। ফিরে যান মোহাম্মদ রিজওয়ান।
আর প্যাট কামিন্সের বলে বাউন্ডারি লাইনে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান আমের জামাল। ১০৯ রানেই নবম উইকেটের পতন। শেষ ব্যাটার হিসেবে আউট হন হাসান আলী। পাকিস্তানের দলীয় রান ১১৫। অজিদের সামনে টার্গেট ১৩০।
ছোট লক্ষ্যে খেলতে নেমে প্রথম ওভারেই ডাক মেরে ফিরে যান উসমান খাজা। মার্নাস ল্যাবুশেনকে নিয়েই এরপর এগুতে থাকেন ডেভিড ওয়ার্নার। দুজনের অবিচ্ছিন্ন জুটি পাকিস্তানকে আর কো্নো সুযোগই দেয়নি। লাঞ্চের আগেই ওয়ার্নার তুলে নেন তার টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ ফিফটি।
বিশেষ উপহার পাকিস্তানের
নিজের বিদায়ী ইনিংসেও ওয়ার্নার ছিলেন উজ্জ্বল। করেছেন অর্ধশতক। পাকিস্তানের ছোট লক্ষ্যের সামনে প্রথম ওভারেই দল উইকেট হারালেও বিপদ বাড়তে দেননি ওয়ার্নার। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কিছুটা আগ্রাসী ইনিংস খেললেও ছিল পরিপক্বতার ছাপ।
আর এমন এক ক্যারিয়ারের শেষে বিপক্ষ দল থেকেও সম্মান পেয়েছেন ওয়ার্নার। ম্যাচের শেষে পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে পাকিস্তানের অধিনায়ক শান মাসুদ ডেকে নেন ডেভিড ওয়ার্নারকে। সঙ্গে তুলে দেন বাবর আজমের জার্সি। যেখানে স্বাক্ষর করেছেন পাকিস্তান দলের সব সদস্য।
জার্সি তুলে দিতে গিয়ে ওয়ার্নারকে ধন্যবাদও জানান শান মাসুদ। শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘ধন্যবাদ তোমাকে। আমরা ভাবছিলাম পুরো দল তোমাকে বাবর আজমের জার্সি দেবো, এটা সৌজন্যতার স্মারক হিসেবে। তোমার জন্য শুভকামনা রইলো।’
উপহার দিতে কার্পণ্য করতে দ্বিধা করেননি ডেভিড ওয়ার্নার নিজেও। ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টে আউট হয়ে ফেরার পথে নিজের গ্লাভস ও হেলমেট ওয়ার্নার তুলে দিয়েছেন এক খুদে ভক্তের হাতে। সেই ক্ষুদে ভক্তের উচ্ছ্বাসটাও চোখে পড়েছে সবারই।