শুক্রবার ১১ জুলাই ২০২৫ ২৭ আষাঢ় ১৪৩২
শুক্রবার ১১ জুলাই ২০২৫
বাঙালির জেগে ওঠার মাস
হারুন হাবীব
প্রকাশ: শনিবার, ২ মার্চ, ২০২৪, ৪:৩৮ PM
১৯৭০ সালে যুক্ত পাকিস্তানের নির্বাচনের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিক পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করতে থাকে। পাকিস্তানের সেনা শাসক ও পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদরা সেই নির্বাচনের রায় অস্বীকার করেন।

ফলে গণতান্ত্রিক আন্দোলন দ্রুত অগ্নিঝরা আন্দোলনের পথে ধাবিত হয়, নানা পথপরিক্রমা ও রক্তপাতে সামরিক ও ধর্মকেন্দ্রিক শাসন-শোষণের পিঞ্জর ভেঙে বাঙালির স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করে। মূলত ১৯৭১-এর মার্চ মাসের প্রথম দিন থেকেই বিস্ময়করভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান।

এই জেগে ওঠার প্রক্রিয়া ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন থেকে শুরু হলেও গণ-আন্দোলনের রূপ লাভ করে ১৯৬৯ ও ১৯৭০-এর নির্বাচনের আগে। নির্বাচনী রায়ে আওয়ামী লীগ ব্যাপক সংখ্যগিরষ্ঠতা লাভ করে, কিন্তু সেনা শাসক জে. ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করেন না। এই অপকর্মে ইয়াহিয়াকে সরাসরি সহায়তা করেন পশ্চিম পাকিস্তান ভিত্তিক পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। এর প্রধান কারণ গণরায়ে নন্দিত হলেও একজন বাঙালির হাতে পাকিস্তানের ক্ষমতা যাবে, এটি মেনে নিতে পারেনি সেদিনকার পশ্চিম পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী।

এরই মধ্যে ৩ মার্চ ১৯৭১ নির্ধারিত হয় পাকিস্তান জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন। সিদ্ধান্ত হয় সে বৈঠক বসবে ঢাকায়। কিন্তু ১ মার্চ আকস্মিকভাবে জাতীয় সংসদের বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। এতে বিক্ষোভের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়। গোটা পূর্ব বাংলা অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা ভবনের সামনে ছাত্রসমাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করে বাংলাদেশের নতুন পতাকা। পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে নতুন পতাকা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। শুরু হয় আন্দোলনের নব পর্যায়। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ইশতেহার উত্থাপন করা হয়।

দৃশ্যতই পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলা রুখে দাঁড়ায় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর অন্যায্য অবস্থানের বিরুদ্ধে। উত্তাল মার্চের ৭ তারিখে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি তাঁর ইতিহাসখ্যাত ভাষণ দেন রমনা রেসকোর্সে (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। সেই ভাষণে তিনি পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে শেষবারের মতো সতর্ক করেন, ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের সূত্রপাত করেন, এমনকি জাতিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক দেন। সে ডাক কেবলই একজন সুদক্ষ রাজনীতিবিদের ছিল না, ছিল দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন সেনাপতি ও রাষ্ট্রনায়কের। সে কারণে মার্চ যখন ফিরে আসে, আমরা সেদিনের যুব-তারুণ্য ফিরে যাই ১৯৭১-এ।

এদিকে পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রে আলোচনা বা শান্তিপূর্ণ পথে বাঙালির ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। বাঙালিকে চিরদিনের জন্য অধীনস্থ করে রাখতে বুলেট ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় সামরিক সরকার। তারা অতর্কিতে ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা শুরু করে, যা ঘটে ২৫ মার্চ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইপিআরের পিলখানা, পুলিশের রাজারবাগ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। নৃশংস আক্রমণ চালানো হয় ঢাকা নগরীর বহু অংশে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় সংবাদপত্রের অফিস, বাঙালির জনপদ। এরপর তারা বাঙালির অবিসংবাদী নেতাকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। এমন প্রেক্ষাপটেই ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেপ্তারের আগে আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

বাঙালির জেগে ওঠার মাসএককথায় মার্চ মাস হয়ে ওঠে বাঙালির জাতীয় ইতিহাসের অমলিন অগ্নিঝরা অধ্যায়। স্বাধীনতার দবিতে গোটা জাতি হয়ে ওঠে ঐক্যবদ্ধ এবং অপ্রতিরোধ্য। একদিকে বঙ্গবন্ধুর আপসহীন নেতৃত্ব, অন্যদিকে সাড়ে সাত কোটি জাগ্রত মানুষের বজ্রকঠিন শপথ—‘জয় বাংলা’, ‘ঢাকা না পিন্ডিÑ ঢাকা ঢাকা’, ‘তোমার আমার ঠিকানাÑ পদ্মা মেঘনা যমুনা,’ ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ইত্যাদি স্লোগানে ভাসতে থাকে পূর্ববঙ্গ।
আমরা যারা সেই ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শী, একই সঙ্গে একাত্তরের রণাঙ্গনের সৈনিক, তারা সবাই বয়োজ্যেষ্ঠ হয়েছি। কিন্তু অগ্নিঝরা মার্চ তার গৌরব নিয়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। একের পর এক নতুন প্রজন্ম আসছে। তারা তাদের জাতির স্বাধীনতা সংরক্ষণে ইতিহাসের দিকে তাকাবে; শ্রদ্ধাভরে অগ্নিঝরা মার্চের দিকে তাকাবে, তাকাবে সেই মার্চের দিকে—যে মার্চ গোটা জাতিকে একত্র করে স্বাধীন-সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল।

কিছু নাম থাকে, যা অবিনশ্বর। সে নামকে উপেক্ষা করার শক্তি কারো হয় না। এ নাম কালের সীমানা ছাড়িয়ে সোচ্চার ও শক্তিধর হয়ে মহাকালের আঙিনায় টিকে থাকে। এ নাম মহাপুরুষের। তাঁদের যা কীর্তি—তা অস্বীকারের জো নেই, যদিও কেউ কেউ আত্মপ্রবঞ্চক বা আত্মঘাতী হয়ে শাশ্বত সত্যকে অস্বীকার করতেও উদ্যোগী হয়!

শেখ মুজিবুর রহমান, ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে উচ্চারিত না হলে যে নাম অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তেমনি এক নাম। এ নামকে জোর করে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার প্রয়োজন হয় না, জোর করে মুছে দেওয়াও সম্ভব হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, চীনের মাও জেদং, ভিয়েতনামের হো চি মিন, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, আফ্রিকার প্রথম মুক্ত উপনিবেশ ঘানার পেট্রিস লুমাম্বা, কওমি নক্রুমা, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিন ও যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটো যেমন—তেমনি বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নামে তাঁরা এক নন, কিন্তু কীর্তিতে অভিন্ন; আপন গৌরবে ভাস্বর।

এই লেখাটিতে আমি সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি রাষ্ট্রপিতাকে, যিনি তাঁর জীবনের সব সক্ষমতা দিয়ে আমাদের জাতীয় ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পত্তন করেছিলেন। আমার প্রত্যাশা, নতুন প্রজন্ম তাদের জাতীয় ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আজ ও আগামীর বাংলাদেশে সব শোষণ-অবিচারের অবসান করবে।

১৯৭৫-পরবর্তী দুর্ভাগ্যজনক সময়ে, বিশেষত সামরিক ও আধাসামরিক রাষ্ট্রযন্ত্রের জাঁতাকলে নতুন প্রজন্মের একটি অংশ বিকৃত ইতিহাস পাঠ করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস নিজেই তার আপন সত্য পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম। সে কারণেই নতুন প্রজন্ম আজ জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের অবিকৃত ইতিহাসের প্রতি পরিপূর্ণভাবে অনুগত হয়েছে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের মানুষ, তাদের জন্য এ জাগরণ আনন্দের। নতুনের এই উপলব্ধি ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশকে স্বমহিমায় এগিয়ে নেবে। তারা বাংলাদেশ রক্ষা করবে, এই প্রত্যাশা।

আমরা যখন অগ্নিঝরা মার্চ ও স্বাধীনতার ইতিহাসের কথা বলি, তখন স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় স্বাধীনতার শত্রু-মিত্রের চেহারাগুলো ভেসে ওঠে। বিশেষ করে ভেসে ওঠে সেসব ঘাতক, যুদ্ধাপরাধী ও ঘৃণ্য মানবতাবিরোধীর মুখ, যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষ ধারণ করে সেদিন নির্বিচারে গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ করেছিল আপন জনগোষ্ঠীর ওপর। ভাবতে বিস্মিত হতে হয় যে এসব ঘৃণ্য অপরাধগু তারা করেছিল আবার পবিত্র ধর্মের নামে, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামে!

বাংলাদেশের একটি বড় কলঙ্কমোচন হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিচার এবং একাত্তরের শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে। ইতিহাসের এসব অমোঘ দাবি থেকে সরে যাওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ ছিল না বাংলাদেশের। কারণ এ ছিল জাতির নৈতিক ও ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা।

আমার বিশ্বাস, বাঙালির নতুন প্রজন্ম আজ যতটা জেগে উঠেছে, তার চেয়ে বেশি জেগে উঠবে আগামী দিনগুলোতে। কারণ দিন যত এগোবে, ততই জাতীয় স্বাধীনতার ইতিহাসের পৃষ্ঠা উন্মোচিত হবে। আগের প্রজন্মের একজন হিসেবে আমি নবীন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করি। নব তারুণ্যের জাগরণ আমাকে আশান্বিত করে। মনে পড়ে, এমন আগুনঝরা দেশ-জাগানিয়া বসন্ত সেই কবে না দেখেছিলাম! প্রশ্নটি হয়তো এ কারণেই যে আরোপিত এক মানসিক আধিপত্যের কাছে জাতি অনেকাংশেই একসময় আত্মসমর্পণ করেছিল। কিন্তু মাঘের কনকনে শীত শেষে গাঝাড়া দিয়ে, মাথা তুলে জাতিকে নববসন্তে রাঙিয়ে দিয়েছে নবতারুণ্য। সেই মনোজাগতিক আধিপত্যের পিঞ্জর থেকে বেরিয়ে আসার দুয়ার খুলে দিয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধীদের সহিংসতার বিরুদ্ধে নবতারুণ্য তাদের অহিংস স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিয়েছে গোটা বাংলাদেশে। এ যেন ইতিহাসের ফিরে আসা।

ইতিহাস বোবা নয়। বাংলার রক্তরঞ্জিত ইতিহাসের বিরুদ্ধে কয়েক যুগ ধরে পরিকল্পিত আগ্রাসন পরিচালিত হয়েছে। বিশ্বাস করতে বাধ্য যে সত্য ও সুন্দরের অমোঘ বাণী হাতে ইতিহাস নিজেই আজ প্রতিরোধে নেমেছে। সব পাপ, সব কুৎসিত, সব অবিচার ভাসিয়ে দিতে এসেছে।

স্বাধীনতাবিরোধীরা বারবার এবং প্রায় প্রকাশ্যেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করেছে। পাঁচ দশক পরও তারা বাংলাদেশকে আক্রান্ত করছে, অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার ওপর আগ্রাসন চালাচ্ছে। একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর পুরনো ও নতুন দোসররা সব অর্থেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করেছে। তাদের প্রতিরোধ করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। কাজেই মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলোকে সুরক্ষা দিতে বাঙালির পুনর্জাগরণের বিকল্প নেই।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা  ও মহাসচিব সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত