শারীরিক প্রতিবন্ধী হিরন (৩০)। দুটি পা থাকলেও সেগুলো দিয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই তার। তাই হাটু গেঁড়ে দুই হাতের সমন্বয়ে চলাফেরা করতে হয়। জন্ম থেকেই এমন অবস্থা তার।
ত্রিশ বছরের প্রতিবন্ধী হিরন ১৫ বছর ধরে জেলে পেশায়,কিন্তু চেয়ারম্যান-মেম্বারদের দারে দারে ঘুরেও ভাগ্য জোটেনি জেলে কার্ডের। জেলে কার্ড না থাকায় নদীতে মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সরকারি সহায়তার চাল পাননা তিনি। তাই পেটের তাড়নায় যেতে হয় নদীতে।
তার পূর্ব পুরুষের ভিটা ছিল ভোলা জেলাতে। নদী ভাঙনে বসতি হারিয়ে এখন ঠাঁই হয়েছে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চর লরেন্স ইউনিয়নে। অন্যের জমিতে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নিয়ে থাকেন তিনি। এর আগে তিনি পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন চর কালকিনি এলাকায় থাকতেন। ওই ইউনিয়নের ভোটার তিনি। পুনরায় নদী ভাঙার কবলে পড়ে তাকে বসতি স্থানান্তর করতে হয়েছে।
হিরন পেশায় একজন জেলে। শারীরিক সক্ষমতা অপূর্ণ থাকলেও মনোবল নিয়ে নদীর বুকে নৌকা নিয়ে ভেসে বেড়ায় হিরন। গভীর জলে জাল ফেলে মাছ ধরে সে। লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীতে মাছ শিকার করে চলে তার সংসার। বাড়িতে তার স্ত্রী এবং সাত বছরের ছেলে নাহিদ ও পাঁচ বছরের মেয়ে নাহিদা রয়েছে। পরিবারের সকলের মুখে অন্ন তুলে দিতে মাছ শিকারই ভরসা হিরনের।
হিরনের বাবার নাম মোতাসিন মাঝি। দ্বিতীয় বিয়ে করে অন্যত্র থাকেন তার বাবা। মেঘনায় এখন মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা চলছে। কিন্তু অভাব অনটনের কারণে সরকারি নিষেধাজ্ঞা মেনে চলছে না জেলে হিরন।
বুধবার (২০ মার্চ) বিকেলে লক্ষ্মীপুর কমলনগর উপজেলার চর কালকিনি ইউনিয়নের নাছিরগঞ্জ এলাকার মেঘনার তীরে দেখা হয় হিরনের সাথে। দেখা হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সে নদীতে মাছ শিকার করে তীরে আসে। নদী থেকে ধরা কিছু পোয়ামাছ দেখা যায় তার নৌকাতে। যার বাজার মূল্য হবে তিন থেকে চারশ টাকার মতো।
শারীরিক প্রতিবন্ধী স্বত্ত্বেও মাছ শিকারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ পেশা বেচে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে হিরন বলেন,বাবা জেলে ছিলো, সেই সুবাদেই এই পেশায় আসা। ১৪ থেকে ১৫ বছর ধরে জেলে পেশায় আছি।নদীতে গেলে এখন আর ভয় লাগে না।সংসার চালানোর একমাত্র অবলম্বন মাছ শিকার করা। সাধারণ মানুষের মতো চলাফেরা করতে না পারায় অন্যকাজ করতে জানি না।
নদীতে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা চলছে। ইলিশ শিকারে নিয়োজিত জেলেদের একটি অংশকে মাছ শিকার থেকে দূরে রাখতে ভিজিএফ এর আওতায় দুইভাবে ৪০ কেজি করে ৮০ কেজি চাল দেয় সরকার। কিন্তু হিরন তালিকাভূক্ত জেলে নয়, তাই সে চাল পায় না।
নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে হিরন কেন নদীতে মাছ শিকারে গিয়েছেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, পেটের টানে যেতে হয়। চালের কার্ড (জেলে কার্ড) নেই, তাই সরকারি চাল পাই না।
চালের কার্ডের জন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে গেলেন কিনা- এমন প্রশ্নে হিরন বলেন, কয়েক জনকে বলেও কাজ হয়নি। চেয়ারম্যানও পাত্তা দেয় না।
হিরনের সাথে কথা বলার সময় তার পাশে থাকা কামাল মাঝি নামে এক জেলে নৌকার মালিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, জেলে কার্ডের জন্য আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা করে দিতে হয়। আবার অনেক সময় টাকা দিলেও কাজ হয় না। পছন্দের লোকেরা কার্ড পায়।
কাকে টাকা দিতে হয়- এমন প্রশ্নে কামাল মাঝি বলেন, চেয়ারম্যান-মেম্বারদের টাকা দিতে হয়। তাদের সহযোগিদের মাধ্যমে টাকা কালেকশন (সংগ্রহ) করে। যারা টাকা দিতে পারে, তারা চাল পায়।
এ বিষয়ে চর কালকিনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: ছায়েফউল্লাহ বলেন, হিরন আমার কাছে আসেনি তাই তার এ অবস্থা সম্পর্কে আমি জানিনা। আমি খোঁজ নিয়ে চলতি মাসের চালের ব্যবস্থা করবো।পরবর্তীতে উপজেলা মৎস্য অফিসারের সাথে কথা বলে জেলে কার্ড করার ব্যবস্থা করবো।
কমলনগর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো:আবদুল কুদ্দুস বলেন, হিরনের এনআইডি কার্ড হাতে পেলে জেলে কার্ডের ব্যবস্থা করে দিবো।