২০২১ সালে চট্টগ্রাম নগরীর টেক্সটাইলে মোড়ে বারো ফুট প্রস্থের ফুটপাত দখল করে তৈরি করা হয়েছিল ৬৬টি পাকা দোকান। এসব পাকা স্থাপনা নির্মাণ করতে গিয়ে রাতের আঁধারে কাটা হয়েছিল ফুটপাতে থাকা বেশকিছু গাছ। সে সময় বর্তমান সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলেছিলেন তিনি মেয়রের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে নগরীর কোথাও কোনো ফুটপাত কিংবা ভূ-সম্পত্তি বরাদ্দ দেননি তিনি। টেক্সটাইল, শেরশাহ ও তারাগেট এলাকায় ফুটপাতে যেসব দোকান বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তা সাবেক প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম সুজন দিয়ে গেছেন।
অথচ এর প্রায় আড়াই বছর পর ২০২৪ সালে এসে সেই স্থানটিতে আবারো দোকান নির্মানের উদ্যোগ নিয়েছে চসিক। সড়কের ফুটপাথের জায়গা যেহেতু আর অবশিষ্ট নেই তাই এবার ফুটপাথ সংলগ্ন প্লটে যাতায়াতের পথে গায়ের জোরে দোকান বানাচ্ছে চসিক। আর এই কাজের মূখ্য ভূমিকা পালন করছে সম্প্রতি ব্যবসায়ীকে মারধর করে আলোচনার জন্ম দেয়া চসিকের স্টেট অফিসার রেজাউল করিম। এই স্থানে প্লট মালিককেও অকথ্য ভাষায় গালাগালে অভিযোগ উঠেছে নিজেকে চসিকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয় দেয়া স্টেট অফিসারের দ্বায়িত্বে থাকা রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে। আর এসব কাজ করতে গিয়ে ভুক্তভোগীদের রিতিমতন শাসাচ্ছেন সহকারী স্টেট অফিসার মামুনও স্টেট শাখার কর্মচারিরা।
সম্প্রতি টেক্সটাইল মোড় থেকে চন্দ্রনগরমুখী সড়কের ৪ একর জায়গাজুড়ে আলহাজ্ব নুরুল ইসলামের প্লটে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে সেখানে দোকান নির্মানের উদ্যোগ দিয়েছে চসিক। চসিকের স্টেট অফিসার রেজাউল করিম যদিও এসব দোকান আগের বরাদ্ধ কৃত বলছেন কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে আগেই যদি বরাদ্ধ হয় তাহলে গণহারে দোকান নির্মানের আড়াই বছর পর কেন? তবে সরেজমিন পরিদর্শনে স্থানীয়রা জানিয়েছে এখানে নতুন দোকান প্রতি দেড় থেকে আড়াই লাখ টাকা অগ্রিম নিয়ে দোকান বানানোর সুযোগ করে দিচ্ছে চসিক। তবে মূল লেনদেন করছে স্থানীয় একটি চক্র।
আলহাজ্ব নুরুল ইসলাম নামের ব্যক্তি ৮৩ নং হাজি টেক্সটাইল গেইট হোল্ডিং এর প্লটিতে তাঁর নিজস্ব বিনিয়োগে একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এছাড়া একই প্লটে বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভারের প্রতিষ্ঠানসহ আরো অন্তত ৯টি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সম্প্রতি টেক্সটাইল গেইটের দিকে এসব প্রতিষ্ঠান গুলোর একটিতে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দোকান নির্মানের উদ্যোগ নিয়েছে চসিক। ইতিমধ্যে যাতায়াতের পথে রাবিশ ফেলে এবং ড্রেনের ওপরের স্লেব ভেঙ্গে স্থানীয় চিহ্নিত ফুটপাথের কথিত ইজারাদারদের গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে গেছে চসিক। ধারনা করা হচ্ছে একে একে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গুলোর চলাচলের পথের দিকে হাত বাড়াবে সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় দোকান সিন্ডিকেট চক্র।
এই বিষয়ে নুরুল ইসলামের ছেলে আজিজুল হক বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, আমার বাবা ১৯৬৫ সাল থেকে এই প্লটে একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এসব প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স থেকে শুরু করে যথাযথ কর্তৃপক্ষে যাবতিয় অনুমতি ও ডকুমেন্ট রয়েছে। একই সাথে শত শত লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে এবং দেশের প্রচলিত আইন মেনে যথাযথ রাজস্ব পরিশোধ করে ব্যবসা পরিচালনা করছি। এর আগে প্লটের সামনের সম্পূর্ণ ফুটপাত দখল করে চসিক প্রচুর দোকান নির্মাণ করেছে। সেসব দোকানের ফাঁকে আমাদের প্রতিষ্ঠান গুলোতে যাতায়াতের সরু পথ ছাড়া অত্র এলাকার সড়কের পাশে আর কোনো জায়গা অবশিষ্ট রাখেনি চসিক। সম্প্রতি আমাদের যাতায়াতের পথগুলো বন্ধ করে দিয়ে আবারো দোকান নির্মাণের কাজ চালানো হচ্ছে।
এই বিষয়ে চসিকের আলোচিত স্টেট অফিসার রেজাউল করিমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি মেয়রের নির্দেশে সব কাজ করছেন বলে জানান। তিনি বলেন, আগে বরাদ্ধ দেয়া কিছু দোকান আমরা বুঝিয়ে দিতে পারিনি এখন সেগুলো বানিয়ে দিচ্ছি। অন্যের যাতায়াতের পথ বন্ধ করে কেন দোকান নির্মিত হচ্ছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, তাদের এক প্লটে অনেকগুলো পথ আছে আমরা এতো গুলোপথ ব্যবহার করতে দেবো না।
তবে প্লট মালিকের অভিযোগ, চসিক সামান্য ফুটপাথে শত শত দোকান নির্মাণ করেছে; অথচ আমার ৪ একর প্লটে মাত্র ১০টির মতন প্রতিষ্ঠান আমার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে সরকার যে পরিমান রাজস্ব পায় চসিকের ফুটপাথের দোকান থেকে তার একাংশ রাজস্ব সরকার পায় কিনা সন্দেহ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই পুরো এলাকার দোকানগুলো স্থানীয় একটি চক্র নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিমাসে প্রতিটি দোকান থেকে ৫-৬ হাজার টাকা ভাড়া উত্তোলন করছে চক্রটি। সেই হিসেবে চসিকের ভাণ্ডারে তেমন কিছুই জমা হয় না। নতুন দোকান থেকে আদায় করা কয়েক লাখ টাকার অর্ধেক চসিক স্টেট শাখার দ্বায়িত্বশীলদের পকেটে চলে যায়। আর সেই টাকার লোকে চসিক কর্তারা বরাবরই ফুটপাতসহ সর্বত্র দোকান নির্মাণে অতি-উৎসাহী।
সেই চসিক স্টেট অফিসারের অকথ্য গালাগাল : সম্প্রতি নগরীর একটি মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদককে চসিক স্টেট অফিসার রেজাউল করিম ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের শারীরিক নির্যাতনের সিসিটিভি ভিডিও দেশ জুড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয় ঘটনাটি ঘটে বৃহস্পতিনার (৪ এপ্রিল)। সেই একই দিন দুপুরে চসিক স্টেট অফিসার রেজাউক করিম তার নিজ কার্যালয়ে প্রকাশ্য এক সেবা প্রার্থীকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে লাঞ্চিত করেছেন মর্মে অভিযোগ উঠেছে।
ভুক্তভোগী মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের চলাচলের পথ বন্ধ করে দিয়ে চসিক দোকান নির্মাণ করতে দেখে আমরা তাৎক্ষনিক সিটি মেয়রের সাথে সাক্ষাত করে বিষয়টি তাঁকে অবহিত করি। এসময় এসব দোকান নির্মানের বিষয়ে সিটি মেয়র কিছুই জানেন না বলে জানান। সিটি মেয়রের পরামর্শে আমরা বিষয়টি লিখিতভাবে অভিযোগ জানাতে ৪ এপ্রিল দুপুরে টাইগারপাশস্থ চসিক কার্যালয়ে যাই। আমাদের আবেদন পত্রটি গ্রহণ করে সিটি মেয়রের অফিস আমাকে স্টেট অফিসারের সাথে দেখা করতে বলেন। আমি চসিক ভবনের স্টেট অফিসার রেজাউল করিমের সাথে দেখা করতে তাঁর অফিস কক্ষে যাই। এসময় তিনি আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে আমার প্রতিষ্ঠানের মালিকের নাম ধরে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। আমরা কিভাবে চট্টগ্রামে ব্যবসা করি সেটি তিনি দেখে নেবেন বলেও হুমকি দেন।
স্টেট অফিসারের কক্ষে সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করলে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাবে বলেও তিনি জানান।
স্টেট অফিসার নিজেকে চসিকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয় দিয়ে বলেন, আমি চাইলে সব করতে পারি। আমি যা বলি সেটাই আইন। একজন ম্যাজিস্ট্রেটের এমন লাঞ্চনার বিষয়ে আর কাকে বিচার দেবেন এমন প্রশ্ন রাখেন ভুক্তভোগী ইব্রাহিম।
এমন আচরণের বিষয়ে জানতে চসিক স্টেট অফিসার রেজাউল করিমের সাথে ২য় দফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।