শুক্রবার ১১ জুলাই ২০২৫ ২৭ আষাঢ় ১৪৩২
শুক্রবার ১১ জুলাই ২০২৫
জ্বালানির আমদানি নির্ভরতা কমাতে নিজস্ব উৎস উন্নয়নে মনোনিবেশের আহ্বান
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: শনিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৬:১৪ PM
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত জ্বালানির সহনীয় মূল্য ও নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ” শীর্ষক সেমিনার ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এ সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। 

স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, বিগত ৫০বছরে আমাদের অর্থনীতি কৃষি নির্ভর থেকে শিল্প ও সেবা খাত নির্ভর হয়ে উঠেছে, তাই এখন জ্বালানির নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ ও সহনীয় মূল্য নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, বিগত দুই দশকে আমাদের জ্বালানির ব্যবহার প্রায় ৪গুন বেড়ে ৪৫ মিলিয়ন টন অফ অয়েল ইকুইভ্যালেন্ট (টিওই)-এ পৌঁছে গেছে। 

শিল্পখাতে জ্বালানির চাহিদা মেটাতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানীর কোন বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে জ্বালানির ব্যবহারে আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশীয় মজুদকৃত কয়লা উত্তোলনে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ থাকা সত্তে¡ও, কয়লা উত্তোলন কার্যক্রম বৃদ্ধির উপর গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন বলে, তিনি মত প্রকাশ করেন। 

তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র বেশ পুরোনো এবং ২০৩০ সাল নাগাদ এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা উল্লেখজনক হারে হ্রাস পাবে, বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এখনই উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। পারমানবিক শক্তি ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন যেমন বাড়ানো দরকার, তেমনি জ্বালানি আমদানিতে বিদ্যমান সরকারি ক্রয় নীতিমালা সংশোধন করে মূল্য স্থিতিশীল রক্ষার কৌশলও নিতে হবে। এছাড়াও এনার্জি স্টোরেজ টেকনোলোজির ব্যবহার বাড়িয়ে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ কাজে লাগানো যেতে পারে বলে তিনি অভিমত জ্ঞাপন করেন। সার্বিকভাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাস ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের উপর সরকারকে অধিক হারে মনোনিবেশের আহবান জানান, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি।         

প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানান  গ্রাহকরা প্রতি ইউনিটের বিদ্যুতের গড় মূল্য ৮.৫৫ টাকা প্রদান করলেও সরকার ১২-২৫ টায় কিনে থাকে। তিনি উল্লেখ করেন, এলএনজি আমদানিতে ৭০টাকা খরচ পড়লেও, শিল্পখাতে ৩০টাকা হারে সরবরাহ করা হচ্ছে এবং মূল্যের এ পার্থক্যটা সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। তিনি আরো অভহিত করেন যে, জ্বালানি খাতে প্রায় ৫২হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে এবং দেশের মানুষের মাথাপিছু ভর্তুকির এ হার প্রায় ৩০০০ টাকা।জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, বিদ্যুৎখাতে অপ্রযোগিতার অনুপস্থিতি এবং গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের এককচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে আমাদেরকে অধিক মূল্যে জ্বালানি ক্রয় করতে হচ্ছে। 

তিনি আরো জানান, আমাদের ৪ হাজার এমএমসিএফটি গ্রাসের প্রয়োজন, যদিও আমাদের রয়েছে ৩ হাজারের কম এবং ঘাটতি মেটাতে নিজের গ্যাস উত্তোলন কার্যক্রম বাড়ানোর উপর গুরুত্বারোপ করেন। 

তিনি বলেন, ভোলায় প্রায় ৭০ সিএমএফএফটি গ্যাস মজুদ রয়েছে, যা উত্তোলনে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান জানানো হবে। এখন থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা ছাড়াও কোন দরপত্র আহবান করা হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, তেল আমদানি উন্মুক্ত দরপত্রের কারণে পূর্বের চেয়ে ৩৫% হ্রাসকৃত মূল্য পাওয়া গেছে, এর ফলে সাশ্রয় হবে ৩৭০ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ খাতে আইপিপি-এর পরিবর্তে মার্চেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট ব্যবস্থা চালু হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। উপদেষ্টা আরো বলেন, পর্যায়ক্রমে ৪০টি সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে এবং এ ধরনের প্রকল্পগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় জমির সংস্থান সরকার থেকে করা হবে। 

তিনি উল্লেখ করেন, সরকারী কিছু সংস্থা যেমন:  বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রেল, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সড়ক বিভাগের অনেক জমি আছে, যেটা ব্যবহৃত হচ্ছে না, সেখানে এধরনের সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প। এছাড়াও নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য ১৫বছরের জন্য কর অব্যাহিতর সুযোগ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এখাতে অর্থায়নের জন্য বন্ধকী ঋণের পরিবর্ততে সম্পদ ভিত্তিক ঋণ ব্যবস্থা প্রচলনের উপর গুরুত্ব দেওয়ার জন্য ব্যাংকের প্রতি আহবান জানান যার মাধ্যমে ঋণ প্রক্রিয়া আরো নিরাপদ হবে।   

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম ও খনিজ সম্পদ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তামিম। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদী জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ ব্যবহারিক হবে না, বরং এক্ষেত্রে ৩ থেকে ৫ বছরের কর্মপরিকল্পনা অধিক কার্যকর হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে জ্বালানি আমদানি করতে হবে, তবে অদূর ভবিষ্যতে দেশকে জ্বালানি স্বনির্ভর করা ও জ¦ালানির মূল্য হ্রাসে নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর জোর দেন। তামিম আরও বলেন, নবায়ানযোগ্য জ্বালানি শক্তি উৎপাদনের জন্য আমাদের গৃহস্থালির ছাদ ব্যবহার করা প্রয়োজন।  

বিশেষ করে ২০২০-২১ অর্থবছরের পর টাকা অবমূল্যায়ন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ক্রমবর্ধমান জ্বালানি আমদানি এবং আন্তর্জাতিক জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে গ্যাসের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ অনেক বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সিস্টেমের ক্ষতির কারণে কমপক্ষে ৫% গ্যাস নষ্ট হচ্ছে, যা ১৩০ এমএমসিএফডি-এর সমতুল্য। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ভিত্তিতে কয়লা বাংলাদেশের ভ‚পৃষ্ঠ থেকে উত্তোলনে তিনি পরামর্শ প্রদান করেন। তিনি বলেন, এলএনজি আমদানির জন্য তিনি দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি বা হেজিং ব্যবস্থার উপর তিনি জোরারোপ করেন, পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য এলএনজি সঞ্চয় ক্ষমতা বাড়ানোর আহবান জানান। 

অনুষ্ঠানের নির্ধারিত বক্তব্যে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভ‚তত্ত¡ বিভাগের সম্মানিত অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন, কনফিডেন্স গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিম, বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড রিনিউএ্যাবল এনার্জি এসোসিয়েশনের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মোঃ নূরুল আক্তার, আইএফডিএল বাংলাদেশ’র পার্টনার ব্যারিস্টার শাহওয়ার জামাল নিজাম এবং বিএসআরএম-এর হেড অব কর্পোরেট এ্যাফেয়ার্স সৌমিত্র কুমার মুৎসুদ্দি অংশগ্রহণ করেন। 

অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও অনুসন্ধান কার্যক্রম অনীহার কারণেই আজকের এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তাছাড়াও গ্যাস আমদানির প্রতি আমাদের অধিক হারে আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, ভৌগলিকভাবে আমরা নাইজেরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মত প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ স্থানে অবস্থান করছি, তাই গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে নিজেদের সম্পৃক্তকরণ বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই।   

ড. ইজাজ হোসেন বলেন, জ্বালানির মূল্য যেন বেশি মাত্রায় বৃদ্ধি করা না হয়, সেলক্ষ্যে সরকারের সাথে ব্যবসায়ীদের আলাপচারিতা বৃদ্ধি করতে হবে। স্থানীয় বাজারে ডলার মূল্যের অস্থিতিশীলতার কারণে আমাদের জ্বালানি আমদানি আরো বেশি হারে ব্যয় বহুল হয়ে পড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে মূল্যস্ফীতি ও সামগ্রিক অর্থনীতিতে, তাই নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান কার্যক্রম আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। তিনি জানান, আমাদের ১ শতাংশ কৃষি জমিতে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ১৫ হাজার মেগওয়াট উৎপাদন সম্ভব, তাই অব্যবহৃত কৃষি জমি ব্যবহারের সকলকে উদ্যোগী হওয়ার উপর আহবান জানান।   

ইমরান করিম বলেন, উচ্চ মূল্য হারে অধিক পরিমাণ জ্বালানি আমদানি করে আমরা তুলনামূলকভাবে স্বল্প মূল্যে ভোক্তাদের জ্বালানি সরবরাহ করছি, ফলে সরকারের উপর এখাতে ক্রমাগত চাপ বাড়ছে এবং এর প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিতে। জ্বালানি খাতে বিদ্যমান করারোপের হারকে আরো সহনীয় হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।   

ইঞ্জিনিয়ার মোঃ নূরুল আক্তার বলেন, আমাদের ব্যবহার জ্বালানির প্রায় ৬০ভাই আমদানি নির্ভর হওয়ার কারণে মূল্যটা সাশ্রয়ী হচ্ছে না, পাশাপাশি এনার্জি লস ও ভোক্তা পর্যায়ের ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার কারণেও এক্ষেত্রে কাঙ্খিত সুফল আসছে না। জ্বালানির প্রায় ১৫ভাগই নষ্ট হয় বলে উল্লেখ করে তিনি জানান, বিশেষকরে আবাসিক, শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে এ হার ৩০-৪০% পর্যন্ত হয়ে থাকে, এক্ষেত্রে আমাদের রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষকে আরো দক্ষ হওয়া প্রয়োজন। প্রতি দুইবছর অন্তর অন্তর জ্বালানি বিষয়ক অডিট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এখাতে অডিট কার্যক্রম নিশ্চিতকরনের উপর তিনি জোরারোপ করেন।

ব্যারিস্টার শাহওয়ার জামাল নিজাম বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন প্রকল্পগুলোকে ঋণ যোগ্য করে তোলার বিয়ষটি আমাদের দেশে বেশ চ্যালেঞ্জিং। তিনি বলেন, অখন্ডিত জমির অপ্রতুলতা এবং সকলের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে বাংলাদেশের মত ভৌগলিক দিক দিয়ে ছোট দেশ সৌরশক্তি উৎপাদনে পিছিয়ে রয়েছে। তবে আমাদের অব্যবহৃত পতিত জমি সৌরবিদ্যুৎ খাতে ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে জ্বালানি খাতে উন্নয়ন সম্ভব। 

সৌমিত্র কুমার মুৎসুদ্দি বলেন, শিল্পখাতে নিরবিচ্ছিন্ন পণ্য উৎপাদনের জন্য জ্বালানির নিরাপত্তার কোন বিকল্প নেই এবং এক্ষেত্রে জ্বালানি ব্যবহারের অধিক হারে দক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে জ্বালানি সরবরাহ প্রদানের জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান।  

মুক্ত আলোচনায় ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী, প্রাক্তন ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি কামরুল ইসলাম এফসিএ, হুমায়ুন রশিদ এবং প্রাক্তন সহ-সভাপতি এম আবু হোরায়রাহ্ অংশগ্রহণ করেন। ঢাকা চেম্বারের সহ-সভাপতি মোঃ জুনায়েদ ইবনে আলী, পরিচলনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ সহ সংশ্লিষ্ট খাতের প্রতিনিধিবৃন্দ সেমিনারে যোগদান করেন।
« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত