প্রথমেই অকপটে স্বীকার করি—এক সময় আমি ৭ নভেম্বর সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতাম না। এই অজ্ঞতা কেবল ব্যক্তিগত নয়; বরং এটি আমাদের রাষ্ট্রীয় রাজনীতি, ইতিহাসচর্চা ও সহাবস্থানের অভাবের ফল। প্রতিহিংসা ও দলীয় আধিপত্যের রাজনীতির কারণে এক সরকার কেবল তাদের সুবিধাজনক ইতিহাস প্রচার করে, আর বাকি অংশটিকে অন্ধকারে ঢেকে রাখে। ফলে যারা বাস্তব অর্থে দেশ ও জাতির জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের অবদান ধীরে ধীরে বিস্মৃত হয়।
সম্প্রতি বিভিন্ন প্রামাণ্য নিবন্ধ ও ঐতিহাসিক উৎস থেকে জানলাম—৭ নভেম্বর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য বাঁকবদলের দিন, যার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের করুণ হত্যাকাণ্ডের পর দেশ এক গভীর রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখে পড়ে। রাষ্ট্রক্ষমতা যায় খন্দকার মোশতাক আহমেদের হাতে, যিনি সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ সমীকরণের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। এই সময় প্রশাসন ভেঙে পড়ে, জনগণ বিভ্রান্ত হয়, আর সেনাবাহিনীর ভেতরে জন্ম নেয় অবিশ্বাস ও বিভাজন।
এরই ধারাবাহিকতায় ৩ নভেম্বর সেনানায়ক খালেদ মোশাররফ এক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেন। বাহ্যত তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, কিন্তু বাস্তবে তা ছিল আরেকটি ক্ষমতা-সংগ্রাম, যা সেনাবাহিনীতে বিভাজন আরও গভীর করে।
অন্যদিকে, সেনাবাহিনীর ভেতরে তখন সক্রিয় ছিল জাসদ-সমর্থিত ‘বিপ্লবী সৈনিক সংগঠন’, যার নেতৃত্বে ছিলেন কর্ণেল আবু তাহের। দেশ দ্রুত বিশৃঙ্খলার দিকে এগোচ্ছিল। সেনার নিম্নস্তরের সদস্য ও সাধারণ জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে, এবং ৭ নভেম্বর সৈনিক-জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেন। তাঁকে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে আহ্বান জানানো হয়। এই দিনটিই ইতিহাসে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ নামে খ্যাত হয়।
৭ নভেম্বর কেবল ক্ষমতার পালাবদল নয়, এটি ছিল রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠন ও নতুন দিকনির্দেশনার সূচনা। দায়িত্ব গ্রহণের পর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রশাসনিক কাঠামো, সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন।
তিনি ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’-এর ধারণা দেন, যা তৎকালীন বিভাজিত জাতিকে নতুনভাবে একত্রিত করেছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—তিনি একদলীয় বাকশালী শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন। সেনাবাহিনীতে স্থিতিশীলতা ফেরানোর পাশাপাশি জনগণকে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের নতুন সুযোগ দেন।
ফলে ৭ নভেম্বর হয়ে ওঠে গণআকাঙ্ক্ষার পুনর্জাগরণ, জাতীয় ঐক্য ও রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের প্রতীক—যার স্থপতি ছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
আজ, প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে, বাংলাদেশ যেন আবারও এক অনিশ্চিত সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সংস্কার ও কমিশনের সুপারিশ নিয়ে মতানৈক্য, নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে দ্বন্দ্ব, অনির্বাচিত সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন, রাজনৈতিক দলের মধ্যে তীব্র নেতিবাচক প্রতিযোগিতা, বিনিয়োগ খাতে স্থবিরতা, অর্থনৈতিক মন্দা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি—সব মিলিয়ে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে।
যেভাবে ১৯৭৫ সালে দেশ নেতৃত্ব সংকটে ভুগছিল, আজও তেমনি রাষ্ট্রে আস্থার ঘাটতি ও দিকনির্দেশনার অভাব দেখা দিয়েছে। ইতিহাস আমাদের শেখায়—যখন রাষ্ট্র সংকটে পড়ে, তখন জনগণ এমন নেতৃত্বের খোঁজে থাকে, যিনি দলীয় সীমা ছাড়িয়ে জাতির স্বার্থে কাজ করতে পারেন।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বের দর্শন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—দায়িত্ববোধ, দৃঢ়তা ও জনগণের সংহতি থাকলেই একটি রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে। আজকের সময়ে সেই চেতনা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। এটি কোনো দলীয় প্রচারণা নয়, বরং এক নাগরিক উপলব্ধি—যে বোধ আমাদের শেখায়, গণতন্ত্র ও সংহতি কোনো এক দলের সম্পত্তি নয়; বরং এটি জাতির অস্তিত্বের ভিত্তি।
৭ নভেম্বর ইতিহাসের এক বেদনাবিধুর অথচ শিক্ষণীয় দিন। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জাতি যখন বিভাজিত হয়, তখনই সংহতির আহ্বান আসে সাধারণ মানুষের মধ্য থেকেই।
বর্তমান প্রজন্মের দায়িত্ব—ইতিহাসকে দলীয় চশমা ছাড়াই দেখা, সত্যকে উপলব্ধি করা, এবং বোঝা যে গণতন্ত্র, সংহতি ও নেতৃত্ব—এগুলোই রাষ্ট্রের টিকে থাকার প্রধান ভিত্তি। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শ, তাঁর দূরদৃষ্টি ও জাতি-সংহতির আহ্বান আজও অনুপ্রেরণার উৎস—যে আহ্বান কেবল অতীতের নয়, বর্তমানেরও দিকনির্দেশনা হয়ে উঠতে পারে।
লেখক: সাইদুর রহমান সাঈদ
শিক্ষার্থী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সাধারণ সম্পাদক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন অব চকরিয়া (ঢাবির ‘চকোরী’)