সকালবেলার রোদটা তখনো ততটা চড়া হয়নি। আটঘরিয়ার খিদিরপুর বাগদীপাড়ায় গুচ্ছগ্রামের সরু পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে শোনা যায় নারীকণ্ঠের উঁচু গলা। শিপ্রা কথা বলছে। চোখে মুখে যেন দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভ আর প্রত্যয়ের আগুন। ন্যায্য অধিকার আদায়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় তার প্রতিটি বাক্য যেন ছুটে যায় আয়োজিত বৈঠকের ভিড় ভেদ করে।
শিপ্রা বলেন, “আদিবাসীদের সরকারি সুবিধা আমাদের হাতে আসে না। তালিকা করে দিলে সোজা ভুক্তভোগীর হাতে যেতো। কিন্তু তৃতীয়জন ঢুকলেই কালো হাতও ঢোকে।”
স্বজাতি নেতা, রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনের মধ্যবর্তী প্রভাবশালী—সবাইকেই তার কাছে সমান অপরাধী মনে হয়। খুব সামান্য পড়াশোনা করেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিলো তাকে। অথচ আজ সে সভা–সেমিনার কাঁপিয়ে কথা বলে নিজের মানুষদের অধিকার নিয়ে।
মারমী পল্লীর দুপুরবেলা: এক তরুণীর থামতে থাকা স্বপ্ন
মারমী গ্রামের দিঘির পাশ দিয়ে এগোতেই দেখা মিলল প্রীমা বিশ্বাসের। বস্তায় ভরে ধান তুলছে রোদ মাথায় নিয়ে। মাঝেমধ্যে মুখে হাত ঠেকিয়ে ঘাম মুছে। প্রীমার বয়স খুব বেশি নয়, কিন্তু তার মুখে ক্লান্তির রেখাগুলো বাড়ির দায়িত্ব, দারিদ্র্য আর ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের গল্প বলে।
কিছুদিন আগেও সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্নে পড়ালেখা করছিল সে। কিন্তু এইচএসসির ফলাফল আর ফিরল না—পরীক্ষাও খারাপ গেল। তবুও প্রীমা গায়ে পড়া রোদকে পাত্তা না দিয়ে বলে, “এখানে ৩০০ মানুষ। স্কুল নেই। শিশুরা পড়তে পারে না। শিক্ষা যেন আমাদের জন্য কখনোই ছিল না।”
কাছেই পড়ে আছে শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের জরাজীর্ণ ভবন। পাঁচ–ছয় বছর ধরে বন্ধ। উঁকি দিলে দেখা যায় ফাঁকা ঘর, দেয়ালে চুন উঠে গেছে, আর কোণে জমে থাকা ধুলা—তার নিঃসঙ্গতা বলে দেয়, স্বপ্নের মৃত্যু কখনো কখনো নীরব হয়।
দিঘির স্রোতের নিচে জমে থাকা দ্বন্দ্ব
পাশেই বিস্তত ৩৩ বিঘার দিঘি। জল ছলছল করছে, কিন্তু সেই পানিতে লুকিয়ে আছে অনেক বছরের বিরোধ, দলাদলি আর মামলা-মোকদ্দমা। একসময় রানী ভবানীর সম্পত্তি ছিল এটি। পরে খ্রিস্টান-হিন্দু দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। মামলা ঘুরে ঘুরে অবশেষে মন্দির কমিটির পক্ষে রায় আসে। এখন খ্রিস্টান আদিবাসীদের সম্পৃক্ত করে দিঘিতে মাছ চাষ হয়—সেখানে যেন অতীতের বিভক্তির মাঝেও একটু সহাবস্থানের রোদঝলমল আছে।
মিশন স্কুলের সেই শিক্ষক দম্পতির গল্প
মারমীর এক কোণে বসে আছেন আগ্নেশ বিশ্বাস। স্বামী ডোমিনিক বিশ্বাস ১৯ বছর শিক্ষকতা করে মারা যান। আগ্নেশ নিজের কাঁধে নেন স্কুলের দায়িত্ব। ১৩ বছর ধরে শিশুদের হাতে কলম তুলে দেন। ২০১৯ সালে প্রজেক্ট বন্ধের পর স্কুলটিও বন্ধ হয়ে যায়।
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “চার গ্রুপের ৮৫টি যৌথ পরিবার থাকে এখানে। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি—শিশুদের ভবিষ্যৎ থেমে গেছে।” তার চোখের দিকে তাকালে বোঝা যায়, শুধু স্কুল নয়—হারিয়ে গেছে এক প্রজন্মের সম্ভাবনা।
অবহেলার রাস্তায় হাঁটা
কালিকাপুর বাজার থেকে মারমী পল্লীর দুই কিলোমিটার রাস্তা কাঁচা। বর্ষায় হাঁটতেই নাভিশ্বাস উঠে যায়। শিশুদের সরকারি স্কুলে যেতে হলে সেই কাদা পেরোতে হয় প্রতিদিন। একজন বয়স্ক গ্রুপ নেতা বললেন, “রাস্তাটা কেনো হয় না জানি না। দরখাস্ত দেই, ছবি তোলে, আসে—আরে বাবা, বছর বছর শুধু আশা আসে, রাস্তা আসে না।”
বীরাঙ্গনা সোনা বালা ও মায়া রানী—অন্ধকার থেকে আলোয় উঠার দিন
গুচ্ছগ্রামের একটু ভেতরে গেলে দেখা মেলে ৭০ ছুঁইছুঁই দুই নারীর—সোনা বালা ও মায়া রানী। চুলে পাক ধরেছে, হাঁটায় ধীরগতি, কিন্তু চোখে বিজয়ের দীপ্তি।
১৯৭১ সালের ২২ অক্টোবরের সেই রাতের স্মৃতি আজও তাঁদের কণ্ঠ কাঁপিয়ে দেয়। রাজাকারদের হাতে নির্যাতনের পর আশপাশের মানুষের চিৎকারে বেঁচে ফিরেছিলেন তাঁরা। কিন্তু স্বাধীনতার পর ৪৫ বছর কাটিয়েছেন অবহেলা, দারিদ্র্য আর লজ্জার দেয়ালের আড়ালে।
অবশেষে ২০১৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি মিলেছে। বীরনিবাসে উঠেছেন, পাচ্ছেন ভাতা—যেন শেষ বয়সে একটু মর্যাদার বাতাস।
মায়া রানী বলেন, “জীবনের শেষে এসে সম্মান পেলাম। আমাদের বংশধররাও বলতে পারবে আমরা মুক্তিযোদ্ধার পরিবার।”
সোনা বালা হাসি মুখে বলেন, “মরার আগেই দেশের কাছে প্রমাণ হলো—আমরা কষ্ট করে ভুল করিনি।”
আবাসনের চেয়ে বেশি জরুরি—এক টুকরো জায়গা
৭৫ বছরের বিষ্ণুপদ সূত্রধর বলেন, “৪২টা ঘরের জন্য জায়গা ছিল, এখন মানুষ ৮০ পরিবার। জায়গা কোথায় পাবো?” অনিতা রানীর গল্প আরও কষ্টের—নিজস্ব জমি নেই, ভাসুরের জায়গায় অন্যের ঘরের কোণে থাকতে হয়। দীলিপ চন্দ্রের সমস্যা আবার ভিন্ন—শ্মশানে যাওয়ার রাস্তা নেই। “শবদেহ নিয়ে অন্যের জমি পেরোতে হয়। সবসময় ঝামেলা।”
পল্লীর অর্থনীতি— মাছের ঘেরের মতো ছোট, তবু ভরসা
দিঘিতে মাছ চাষই তাদের মূল আয়ের উৎস। ৫২ পরিবার মিলে তিন মাস অন্তর মাছ ধরে ৩–৩.৫ লাখ টাকা ভাগাভাগি হয়। তবে এটা শুধু বাঁচার মতো আয়—উন্নতির নয়। শিশুরা স্কুলে যায় না, কর্মসংস্থান নেই, স্বাস্থ্যসেবা নেই—ফলে দারিদ্র্য যেন এক অনন্ত চক্র।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের পাবনা জেলা শাখার সভাপতি আশিক চন্দ্র বানিয়াচের বক্তব্য
আশিক চন্দ্র বানিয়াচ বলেন, “বর্তমানে আদিবাসী সম্প্রদায় নানা ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জমিজমা দখলের উদ্দেশ্যে একটি চক্র জাল দলিল তৈরি করছে। ৫ আগস্টের পর থেকে শিক্ষা ও গৃহ নির্মাণ–সংক্রান্ত সরকারি বরাদ্দ বন্ধ রয়েছে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পও স্থবির হয়ে আছে।
পাবনা জেলার ছয়টি উপজেলায়—পাবনা সদর, ঈশ্বরদী, আটঘরিয়া, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও সুজানগর—প্রধানত আদিবাসীদের বসতি রয়েছে। সাঁথিয়ায় কিছু পরিবার থাকলেও তারা নিজেদের আদিবাসী পরিচয়ে সামনে আসতে চান না।”
অভিযোগ উঠেছে যে তিনি নাকি আদিবাসী নেতা হিসেবে স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। এ বিষয়ে তিনি বলেন, “আদিবাসীদের মধ্যে দুটি গ্রুপ তৈরি হয়েছে। একটি উপজেলা পর্যায়ে ‘আদিবাসী সমবায় সমিতি’ নামে কাজ করছে, আরেকটি জেলা থেকে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের ব্যানারে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। উপজেলা পর্যায়ের কিছু কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় তারা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে। বরং তারাই সরকারি সুবিধা নিজের লোক চিনে বণ্টন করে স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিচ্ছে।”
মারমী দিঘি বিষয়ে মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক গৌরাঙ্গ ঘোষের বক্তব্য
গৌরাঙ্গ ঘোষ বলেন, “মারমী দিঘি মূলত দেবোত্তর সম্পত্তি। জয়কালী মাতাই ছিলেন এই সম্পত্তির মালিক। স্থানীয় এক ব্যক্তি, জমশেদ নামে, জাল দলিল তৈরি করে সম্পত্তি আত্মসাতের চেষ্টা করেন। এ ঘটনার পর মন্দির কমিটি মামলা দায়ের করে এবং মামলা ডিসি, জজ আদালত ও হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। শেষ পর্যন্ত আদালতের সব পর্যায়ে রায় মন্দির কমিটির পক্ষেই আসে। এরপর থেকেই মন্দির কমিটির তত্ত্বাবধানে সম্পত্তিটি পরিচালিত হচ্ছে এবং এই ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় আদিবাসী খ্রিস্টান সম্প্রদায়কেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে।”
শেষ দৃশ্য: কুয়াশা ভেদ করে কি দেখা দেবে আলো?
পাবনার আদিবাসী পল্লীগুলোর গল্প শুধু বঞ্চনার নয়—এটা প্রতিদিন বেঁচে থাকার এক অব্যক্ত যুদ্ধের গল্প। শিপ্রার মতো নারী অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেন, প্রীমার মতো তরুণীরা চেষ্টা করে স্বপ্ন ধরে রাখতে, আগ্নেশ বিশ্বাসের মতো শিক্ষকরা এক জীবনের শ্রম দিয়ে প্রজন্ম গড়ার চেষ্টা করেন, আর সোনা বালা ও মায়া রানীর মতো নারীরা প্রমাণ করেন—সম্মানই মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি।
তবু প্রশ্ন রয়ে যায়—রাস্তা ছাড়া শিশুরা কীভাবে স্কুলে যাবে? স্কুল ছাড়া এই প্রজন্ম কোথায় দাঁড়াবে? আর সুযোগ ছাড়া একদিন কি আদিবাসী সমাজ সত্যিই এগোতে পারবে?
মেঘলা বিকেলের আলো দিঘির পানিতে ঝিলিক তোলে। সেই আলোয় শিশুদের মুখে লেগে থাকা ধুলো–মাখা হাসিটাই বলে—আশা এখনো বেঁচে আছে।