কক্সবাজার জেলার উপকূলে লবণ উৎপাদনের মৌসুম শুরু হলেও মাঠে নেই চাষিরা। এখনো প্রস্তুত হয়নি লবন মাঠ, গর্তে পড়ে আছে শত শত মণ লবন। চাষিদের দাবি, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত লবন মাঠে নামবেন না তারা।
শিগগিরই লবন উৎপাদনে মাঠে নামবেন চাষিরা দাবি বিসিকের৷ আর লবনের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব।
কক্সবাজার ঈদগাঁও উপজেলার পোকখালী এলাকা। গত বছর এই সময় মাঠে লবন উৎপাদনের ব্যস্ত ছিল চাষিরা আর এ বছর লবন উৎপাদন তো দূরে লবন উৎপাদনের মৌসুমে মাঠে নেই চাষিরা থাক, এখনো মাঠ প্রস্তুত কিংবা মাঠেই নামেনি তারা।
বিসিক জানায়, শীতকালকে ঘিরে শুরু হয় দেশের লবন উৎপাদনের প্রধান মৌসুম। যা চলে নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত। এই সময়ে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপকূলীয় অঞ্চলে লবণ মাঠ তৈরি থেকে শুরু করে উত্তোলন হয় সমুদ্রের নোনা পানি শুকানোকে কেন্দ্র করে।
কক্সবাজার পোকখালী এলাকার লবণচাষি মিজানুর রহমান। গত বছর ৪ একর জমিতে লবণ চাষ করে উৎপাদন করে ১৪'শ মণ লবন। কিন্তু লবনের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় গুনতে হয়েছে ৬ লাখ টাকার লোকসান।
লবন চাষি মিজান বলেন, মাঠে প্রতি মণ লবন উৎপাদন করতে খরচ হয় ৪'শ থেকে সাড়ে ৪'শ টাকা। কিন্তু বিক্রি করে পেয়েছি ২০০ টাকা। যার কারণে গত আড়াই লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। তাহলে এবার বলেন এতো টাকা লোকসান দেয়ার পর কিভাবে মাঠে নামবো?
শুধু ঈদগাঁও পোকখালী এলাকার মিজানুর রহমান নয় এখনো লবন মাঠে নামেনি কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, টেকনাফ, মহেশখালী, চকরিয়া ও পেকুয়ার চাষিরা। তাদের দাবি- লবনের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত এবং জমির লিজ মূল্য না কমালে মাঠে নামবেন না তারা।
মিজানের পার্শ্ববর্তী লবন চাষি জয়নাল বলেন, গত দেড় বছরের প্রায় ৭০০ হাজার মণ লবন এখনো মাঠে গর্তে পড়ে রয়েছে। কারণ লবনের মুল্য না পেয়ে এ অবস্থা। যদি প্রতি মণ লবন সাড়ে ৪'শ টাকা থেকে ৫'শ টাকা বিক্রি করে পাওয়া যায় তাহলে চাষি বেঁচে থাকবে। কিন্তু গত দুই বছর ধরে তো লবনের মূল্য পাচ্ছি ২০০ টাকা। তাহলে কিভাবে আমাদের সংসার চলবে। লোকসান দিতে দিতে আর মাঠে নামতে ইচ্ছে করছে না।
আরেক চাষি আয়াস বলেন, প্রচণ্ড রোদের তাপের মুখেও মাঠে পরিশ্রম করে লবন উৎপাদন করি ৬মাস। আর বাকি ৬ মাস কোন আয় থাকে না। কিন্তু বন্ধের সময় জেলেও চালসহ আর্থিক সহায়তা পায়। সেক্ষেত্রে আমরা লবন চাষিরা কোন ধরণের সরকারের পক্ষ থেকে চাল কিংবা আর্থিক সহায়তা পায় না। তার ওপর লবণের ন্যায্যমূল্য মিলছে না।
মহেশখালীর গোরকঘাটা এলাকার লবণ চাষি ফারুক আহম বলেন, লবনের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত লবন মাঠে নামবো না। আর লোকসান সইতে পারছি না। সরকার তো ধান-চাল মাঠ পর্যায় থেকে ন্যায্যমূল্য ক্রয় করে। কিন্তু লবন কেন ন্যায্যমূল্য চাষিদের কাছ থেকে ক্রয় করতে পারে না। লবণ চাষিরা কেন এতো অবহেলিত?
কক্সবাজার লবন চাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ সোয়াইবুল ইসলাম সবুজ বলেন, কক্সবাজারে প্রায় ৪১ হাজারের বেশি লবন চাষি রয়েছে। কিন্তু চলতি মৌসুম পহেলা নভেম্বর থেকে শুরু হলেও এখনো মাঠে নেমেছে মাত্র কুতুবদিয়া ও ছনুয়ার কয়েক হাজার চাষি। কিন্তু প্রায় ৩৯ হাজার লবন চাষি এখনো কাট মাঠে নামেনি। কারণ হিসেবে উঠে আসছে বাজারে প্রচারিত প্রচুর পরিমাণ শিল্প লবণ আ আমদানি হয়েছে, মিল মালিক সিন্ডিকেটের কারণে লবনের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হচ্ছেনা, অন্যদিকে জমির লিজ মূল্য বৃদ্ধি, শ্রমিকের মজুরি বেশি এবং দালাল চক্রের দৌরাত্ম। এসব সমস্যা নিরসনে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। যদি মাঠ পর্যায়ে চাষিদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হয় তাহলে চাষিরা মাঠ নামতে সবসময় প্রস্তুত।
এখনো মাঠে মজুদ রয়েছে গতবছরের ৩ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন লবন। এখন শুধুমাত্র বাঁশখালীর ছনুয়া এবং কক্সবাজারের কুতুবদিয়া এলাকার চাষিরা মাঠে নেমেছেন। তবে শিগগিরই লবন উৎপাদনে মাঠে নামবেন চাষিরা এমনটা আশা বিসিকের।
বিসিক কার্যালয় কক্সবাজারের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বাংলাদেশ বুলেটিনকে জানান, লবণ মৌসুম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। কক্সবাজারের কুতুবদিয়া ও বাঁশখালীর ছনুয়া না এলাকায় অনেক চাষি মাঠে নেমেছেন। অন্যান্য এলাকাতেও শিগগিরই চাষিরা মাঠে নামবেন বলে তিনি আশা করেন।
তিনি বলেন, এ বছর বর্ষা মৌসুম বিলম্বিত হওয়ায় চাষিরা সময়মতো মাঠে নামতে পারেননি। বর্তমানে চাষিরা মনপ্রতি মাত্র ২৪০ টাকা দরে লবণ পাচ্ছেন, যা তাদের নি হতাশার কারণ। তবে সামনে লবণের দাম বাড়বে বলে বিসিক আশাবাদী।
এদিকে গত মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের শহীদ এটিএম জাফর আলম সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসন ও বিসিকের আয়োজনে স্থানীয় লবণ মিল মালিকদের সঙ্গে বার্ষিক পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বর্তমান লবণের মজুত, ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ, লবণ মিল মালিক, প্রান্তিক চাষিদের সমস্যা ও লবণ শিল্পের সম্ভাবনার বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
সভা শেষে শিল্প সচিব ওবায়দুর রহমান বলেন, শিল্প লবণের আড়ালে কোনো অজুহাতে খাবার লবণ আমদানি করতে দেয়া হবে না। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। মাঠ পর্যায়ে লবণের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণে বিষয়ে শিল্প সচিব ওবায়দুর রহমান বলেন, সংশ্লিষ্টদের উত্থাপিত প্রস্তাবনা সরকারের উর্ধ্বতন পর্যায়ে পর্যালোচনা করে লবণের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া কক্সবাজারে জমি পেলে লবণ সংরক্ষানাগার স্থাপনা গড়ে তোলা হবে।
উল্লেখ্য, গত বছর ৬৯ হাজার একর জমিতে ৪১ হাজারের বেশি চাষি লবণ উৎপাদনে নিয়োজিত ছিল। আর চলতি বছর লবন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ লাখ ১৮ হাজার মেট্রিক টন।