সোনাইমুড়ী উপজেলায় শিক্ষা ব্যবস্থায় চরম নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে। একই সাথে গত কয়েক বছর ধরে নীরবেই ক্ষয়ে গেছে মানসম্মত শিক্ষার সব অনুষঙ্গ। শিক্ষা কার্যক্রমে জড়িত বেশীরভাগ শিক্ষক, কর্মকর্তা ও পরিচালনা কমিটির শক্ত সিন্ডিকেটে জিম্মি হয়ে আছে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা। পুরো উপজেলায় আমাদের অনুসন্ধানে উঠে আসে নজিরবিহীন সব চিত্র। বিষয়গুলো নিয়ে আমরা কয়েকজন অভিভাবক এবং শিক্ষাবিদের সাথে কথা বলি তারা এ অবস্থায় হতাশা প্রকাশ করেছেন এবং প্রজন্ম ধ্বংস হওয়ার আগেই সতর্ক হওয়ার আহবান জানিয়েছেন।
বর্তমানে সোনাইমুড়ী এলাকায় শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি নেই। সোনাইমুড়ী সরকারী কলেজ থেকে গত ৫৩ বছরে কোন ছাত্রছাত্রী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে পারেনি। গত ৭ বছরে সোনাইমুড়ী কলেজ থেকে রিয়া আক্তার নামে একজন ছাত্রী কেবল প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রায় একই অবস্থা। সোনাইমুড়ী কলেজসহ অন্যান্য শিক্ষালয় থেকে কেন মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী তৈরী হচ্ছে না- এমন প্রশ্নে দেখা যায়, সোনাইমুড়ী কলেজ, আমিশাপাড়া খলিলুর রহমান ডিগ্রী কলেজ ও সোনাইমুড়ী আলিয়া মাদ্রাসার পরীক্ষার হলগুলোতে নকলের ব্যাপক ছড়াছড়ি। অভিযোগ আছে ‘পরীক্ষা হলে নকলের সাথে সরাসরি পরীক্ষা পরিচালনা কমিটি ও কয়েকজন শিক্ষকও জড়িয়ে আছেন। নকলের প্রবণতা এতোটাই বেশী যে চলতি পরীক্ষায় আলিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্র থেকে এখন পর্যন্ত ৬ জন শিক্ষার্থীকে অনিয়ম ও নকলের দায়ে বরখাস্ত করা হয়।
পরীক্ষা কেন্দ্র গুলোতে প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা, কেন্দ্রীয় পরীক্ষা কমিটি ও ট্যাগ অফিসার যোগসাজসে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নকল সরবরাহ করে থাকেন। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা শিক্ষকদের বাধ্য করেন নকল সরবরাহ করতে। ১৭ নভেম্বর সোনাইমুড়ী আলিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে নকল সরবরাহের মতো অনৈতিকতার অভিযোগে শিক্ষক গোলাম কিবরিয়াকে সরিয়ে দেয়া হয়। গোলাম কিবরিয়া বর্তমানে পদিপাড়া মাদ্রাসায় কর্মরত আছেন। এ বিষয়ে সোনাইমুড়ী আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সাইফুল্লা মুনির বলেন, ‘নাহ এধরনের ঘটনা নয় তাঁকে শৈতল্য প্রদর্শনের অভিযোগে ক্লোজ করা হয়েছে। তাকে অব্যহতি দেয়া হয়েছে তবে বহিষ্কার করা হয়নি। বহু চিত্রের এটি কেবল একটি মাত্র চিত্র। এ ঘটনায় আলিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে (ভেন্যূ) পরীক্ষার অনিয়মের চিত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে।
এখানকার কেন্দ্রীয় পরীক্ষা কমিটি গুলো বড় অনিয়মের কারখানা। একই শিক্ষকদের কয়েক বছর ধরে বারবার কমিটিতে রাখা হচ্ছে। পুরো উপজেলায় অসংখ্য শিক্ষক থাকলেও একই শিক্ষকদের বারবার সদস্য করার পেছনে রয়েছে অনৈতিক মনোপ্রবৃত্তি। পরীক্ষা হলগুলোতে নকল সরবরাহ, নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্যই এমনটি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। জানা যায়, সোনাইমুড়ী সরকারী কলেজ কেন্দ্রীয় পরীক্ষা কমিটিতে আছেন, সোনাইমুড়ী কলেজের প্রভাষক মোস্তাফিজুর রহমান, প্রভাষক নুরুল হক, নান্দিয়াপাড়া কলেজের সহকারী অধ্যাপক সাইফুল্লাহ এবং হল সুপারের দায়িত্বে আছেন আমিশাপাড়া কলেজের সহকারী অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী। এই শিক্ষকরা টানা কয়েকবছর দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় হলগুলোতে নকলের মহামারি শুরু হয়। তবে এবছর নকল করার পরিমাণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে ভাইস প্রিন্সিপালের কঠোর হস্তেক্ষেপে।
সোনাইমুড়ি সরকারি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল পরীক্ষা পরিচালনা কমিটির টানা তিন বছরের দায়িত্ব পালনের কথা স্বীকার করলেও মূলত মোস্তাফিজুর রহমান ও নূরুলহক টানা ৬ বছর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। উপজেলা পর্যায়ে এ দুজন ছাড়া অন্য কোন শিক্ষককে পরীক্ষা পরিচালনার জন্য তৈরী করা যায়নি। এ ক্ষেত্রে কলেজ প্রশাসনের দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ ও সন্দেহমূলক। একই শিক্ষকরা বারবার পরীক্ষা কেন কমিটিতে এমন প্রশ্নে সোনাইমুড়ী কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল শহিদুল ইসলাম পাটোয়ারী বলেন, ‘একই শিক্ষক গতবারও দায়িত্বে ছিলেন এটা ঠিক, আসলে নতুন কাউকে আনলে প্রশিক্ষন সহ নানা বিষয় থাকে। অভিজ্ঞ হয় উঠতে সময় লাগে তাই অভিজ্ঞদেরই দায়িত্বে রাখা হচ্ছে’। এই বিষয়ে টেলিফোনে প্রশ্ন করা হলে মোস্তাফিজুর রহমান ও নুরুল হক দুই জনই কয়েক বছর কমিটিতে আছেন বলে এই প্রতিবেদককে জানান।
সোনাইমুড়ী আলিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে (ভেন্যূ সোনাইমুড়ী সরকারী কলেজ) ৫ সদস্যের পরীক্ষা কমিটিতে কারা আছেন জানতে চাইলে প্রথমেই ইউএনও ও শিক্ষা অফিসারের নাম বলে বাকীদের নাম প্রকাশে অনিহা প্রকাশ করা হয়। একই বিষয়ে সোনাইমুড়ী কলেজের ভাইস প্রিন্সিপালের সাথ কথা হলে তিনি জানান, ‘ইউএনও তো প্রধান হিসেবে সবকিছুই দেখভাল করেন। নামের তালিকা জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘সব তো মুখস্ত নেই ওনারা গতবারও থাকতে পারে তবে রেজুল্যশন দেখতে হবে। আপনি রবিবারে আইসেন। ’ একটি সূত্রে জানা যায়, এই পরীক্ষা কমিটির সদস্যরা হলেন, সোনাইমুড়ী আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সাইফুল্লা মুনির ও নান্দিয়া পাড়া আলিম মাদ্রাসার সহকারী অধ্যক্ষ সাহেব উল্যা, খলিলুর রহমান কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ । এই শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরেই দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
একই অবস্থা আমিশাপাড়া খলিলুর রহমান ডিগ্রি কলেজে কেন্দ্রীয় পরীক্ষা কমিটিতেও। আমিশাপড়া কেন্দ্রে পরীক্ষার হলে প্রত্যবেক্ষক হিসেবে অন্য কলেজের শিক্ষকরা দায়িত্ব পালনের নিয়ম থাকলেও তারা স্থানীয় বিভিন্ন স্কুলের ১৬ জন শিক্ষকদের দিয়ে দায়িত্ব সেরেছেন। অনুগতদের মাধ্যমে এক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা আরেক প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার হলে ডিউটি করতে গিয়ে পরস্পর নকলে সহযোগিতার ফন্দি করার অভিযোগ আছে। এছাড়াও হাইস্কুলের শিক্ষকদের হলে নিয়োগ দেয়া নিয়মবহির্ভূত। আবার প্রয়োজন ছাড়াও স্বল্প সংখ্যক পরীক্ষার্থী জয়াগ কেন্দ্র পরিচালনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে কথা হলে আমিশাপাড়া কলেজের অধ্যক্ষ নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘আসলে দক্ষতার অভার রয়েছে তো আর সবাই আগ্রহী হয় না। আমরা চেষ্টা করি সুন্দরভাবে শিক্ষা প্রদান করতে।
বাবু/জেএম