বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫ ২৬ আষাঢ় ১৪৩২
বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫
মাশরাফি বিন মর্তুজা
আমি ফুরিয়ে যাইনি
‘বাবার কণ্ঠে ছেলেটা আমার পঙ্গু হয়ে যাবে, আর পারছে না, এখনই থামার সময়’
জাহিদ হাসান মাহা
প্রকাশ: রবিবার, ৯ এপ্রিল, ২০২৩, ৩:৫২ PM আপডেট: ০৯.০৪.২০২৩ ৪:১৩ PM
‘জানি না আমি কতদিন খেলা চালিয়ে যেতে পারব। তবে আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি, যখন আমি বুঝতে পারব আমার দক্ষতা ও ইচ্ছাশক্তি কমে আসছে, তখন নিজে থেকেই সরে যাবো ’
বয়স ৩৯ পেরিয়ে ৪০-এর দিকে, তাতে কী, মাশরাফি তো আর ফুরিয়ে যাওয়ার মানুষ না। যার বোলিং দেখেলে এখনও মনে হয় সেই শৈশবের কথা, যার বোলিংয়ে মুগ্ধ ছিলো পুরো ক্রিকেট বিশ্ব। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জীবন্ত কিংবদন্তি অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা জীবন্ত এক অধ্যায়। বয়স ৪০ ছুই-ছুই, হাঁটুতে অনেক অস্ত্রপাচার, দুই পায়ে অসংখ্য ব্যান্ডেজ। 

এই-তো সেদিন তার আগুনঝরা বোলিংয়ে লণ্ডভণ্ড ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়কের ফাইফারে লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের কাছে মাত্র ৩৪ মিনিটে ১০ উইকেটের ব্যবধানে হারে সাদাকালো ক্লাবটি। এই জয় ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে সবচেয়ে দ্রুততম জয়। বিকেএসপির ৩ নম্বর মাঠে সেদিন টস জিতে মোহামেডানকে ব্যাটিংয়ে পাঠায় রূপগঞ্জ। তার  বোলিং তোপে মাত্র ৮০ রানে অলআউট হয়ে যায় ইমরুল কায়েসের দল। রান তাড়া করতে নেমে ৮.২ ওভারে কোনো উইকেট না হারিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছে যায় রূপগঞ্জ। মাশরাফি ৮.৪ ওভারে মাত্র ১৭ রান দিয়ে নেন ৫ উইকেট। মেডেন দেন তিনটি। আর ১ উইকেট নিতে পারলে লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড গড়তে পারতেন। লিস্ট ‘এ’ তে সপ্তমবারের মতো ফাইফার নেন এই পেসার। এছাড়া সবচেয়ে বয়স্ক হিসেবেও এই কীর্তিতে নাম লেখান সাবেক কাপ্তান।

গত কয়েকদিন আগে মাশরাফির বাবা বলেছেন, থামার সময় হয়েছে ছেলেটার। এখনি ক্রিকেটকে বিদায় বলা উচিত তার। ওর-পায়ের অবস্থা বিবেচনা করেই এখন থামতে বললেন তিনি। আরও বলেন, ‘আপনারাও দেখছেন তার পায়ের কী অবস্থা। সে খুড়িয়ে খুড়িয়ে বল করছে। এভাবে ক্রিকেট খেলা সম্ভব না। এভাবে কতদিন সম্ভব? আমি মনে করি এটা শেষ হওয়া উচিত। পায়ের যে অবস্থা, বয়স হয়েছে এটা-তো আর গায়ের জোড়ের বিষয় না।’ তবে অবসর নিয়ে মাশরাফির সঙ্গে কোনো কথা হয়নি বলে জানান গোলাম মুর্তজা। এরপর অবশ্য অবসরের বিষয় তার কাছেই ছেড়ে দিলেন তিনি। ‘এ বিষয়ে (অবসর) তার সঙ্গে কোনো কথা হয়নি। তার যতদিন মনের সাহস আছে ততদিন খেলবে। সে- ভালোই বোঝে সবকিছু, কোনটা কখন সম্ভব আর সম্ভব না! অতএব আমার বলে দেওয়ার কিছু নেই।’ 
মাশরাফি

মাশরাফি


বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা নড়াইলে জন্ম ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজার। ছোটবেলা থেকেই তিনি বাঁধাধরা পড়াশোনার পরিবর্তে ফুটবল আর ব্যাডমিন্টন খেলতেই বেশি পছন্দ করতেন, আর মাঝে মধ্যে চিত্রা নদীতে সাঁতার কাটা ছিল তাঁর শখ। তারুণ্যের শুরুতে ক্রিকেটের প্রতি তার আগ্রহ জন্মে, বিশেষত ব্যাটিংয়ে, যদিও এখন বোলার হিসেবেই তিনি বেশি খ্যাত, যেজন্যে তাকে ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ নামেও অভিহিত করা হয়। 

৮ নভেম্বর, ২০০১ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে টেস্ট ক্রিকেটে তার অভিষেক ঘটে। একই ম্যাচে খালেদ মাহমুদেরও অভিষেক হয়। বৃষ্টির বাগড়ায় ম্যাচটি অমীমাংসিত থেকে যায়। মাশরাফি অবশ্য অভিষেকেই তার জাত চিনিয়ে দেন ১০৬ রানে ৪টি উইকেট নিয়ে। গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার ছিলেন তার প্রথম শিকার। মজার ব্যাপার হল, তার প্রথম ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচও ছিল এটি। তিনি এই বিরল কৃতিত্বের অধিকারী ৩১তম খেলোয়াড় এবং ১৮৯৯ সালের পর তৃতীয়। একই বছর ২৩শে নভেম্বর ওয়ানডে ক্রিকেটে মাশরাফির অভিষেক হয় ফাহিম মুনতাসির ও তুষার ইমরানের সঙ্গে। অভিষেক ম্যাচে মোহাম্মদ শরীফের সঙ্গে বোলিং ওপেন করে তিনি ৮ ওভার ২ বলে ২৬ রান দিয়ে বাগিয়ে নেন ২টি উইকেট। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যক্তিগত তৃতীয় টেস্ট খেলার সময় তিনি হাঁটুতে আঘাত পান। এর ফলে তিনি প্রায় দুই বছর ক্রিকেটের বাইরে থাকতে বাধ্য হন। ইংল্যন্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্ট খেলায় তিনি সফলতা পান। ৬০ রানে ৪ উইকেট নেয়ার পর আবার তিনি হাঁটুতে আঘাত পান। এ যাত্রায় তিনি প্রায় বছর খানেক মাঠের বাইরে থাকতে বাধ্য হন।

২০০৪ সালে ভারতের বিরুদ্ধে খেলার সময় রাহুল দ্রাবিড়কে অফ-স্ট্যাম্পের বাইরের একটি বলে আউট করে তিনি স্বরূপে ফেরার ঘোষণা দেন। সেই সিরিজে তিনি ধারাবাহিকভাবে বোলিং করেন এবং টেন্ডুলকার ও গাঙ্গুলীকে আউট করার সুযোগ তৈরি করেন। তবে ফিল্ডারদের ব্যর্থতায় তিনি উইকেট পাননি। এই সিরিজের একটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে ভারতের বিরুদ্ধে অবিস্মরণীয় জয়ের নায়ক ছিলেন তিনি। ওয়ানডে, টেস্ট আর টি-২০’র ২১ বছরে দুই হাঁটুতে সাতবার অপারেশন। ক্যারিয়ারের দশ বার ডাক্তারের ছুরির নিচে নিজেকে সপে দেয়া। প্রতি ম্যাচ শেষে সিরিজ দিয়ে টেনে বের করতে হয় হাঁটুতে জমা বিষাক্ত রস। ঘুম থেকে উঠে সঙ্গে সঙ্গে নামতে পারেন না বিছানা থেকে। হাঁটু দু’টোকে কয়েকবার ভাঁজ করতে হয়, সোজা করতে হয় তারপর শুরু হয় দিন। মাঝে মধ্যে রাতগুলো হয়ে উঠে আরও আতংকের। ঘুমের মধ্যে অনুভব করেন কোনো একটা পা বাঁকানো যাচ্ছে না। ডাক্তাররা বলেছিলেন, এভাবে ক্রিকেট চালিয়ে গেলে পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন, কিন্তু দমে যাননি ক্রিকেটের এই কিংবদন্তি। সব শঙ্কা উড়িয়ে বল হাতে বাঘের মতো ছুটে চলা। এ যেন অপ্রতিরোধ্য এক বীর সেনানীর গল্প। যার জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে সাহসীকতা, দেশপ্রেম আর অদম্য এক যোদ্ধার প্রতিচ্ছবি। শত ঝড়ঝাঁপটা পেরিয়ে লাল সবুজ পতাকার সম্মান, হাসি-কান্নার ভাড় যার দুই কাঁধে। ম্যাচ হারলেও চোখের জল ফেলেন অনেকটা নিরবে। সবার আড়ালে। যাতে তরুণ ক্রিকেটাররা হতাশ না-হন। বলছি পাগলাটে কৌশিকের কথা। কি ভুল শুনছেন? না- ঠিকই শুনেছেন। বলছি বাংলাদেশ ক্রিকেটের জীবন্ত কিংবদন্তি হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালার মতো টাইগার ক্রিকেটের সোনালি দিনের বংশীবাদক এবং লড়াকু অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার কথা। পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়েও যিনি বল করে যান। দলকে নেতৃত্ব দেন সামনে থেকে। নিজের কষ্ট, ব্যাথা নিজের মধ্যেই রেখে দেশের জন্য লড়ে যান ক্রিকেট যুদ্ধে। সেই নায়কের কথা। না,  এমন মানুষকে শুধু নায়ক বলা তো অপরাধ। তার নামের পাশে মহানায়ক শব্দটাই বেশি মানান সই। 
মাশরাফি

মাশরাফি


মাশরাফিকে নিয়ে ভিন্নজনের মতামত : 
‘আমার দুর্ভাগ্য, আমি মাশরাফির সঙ্গে এক টিমে খেলতে পারিনি’- ব্রায়ান লারা (সাবেক অধিনায়ক, ওয়েস্ট ইন্ডিজ)। ‘পৃথিবীতে দুই ধরনের বোলার আছে। এক মাশরাফি আর অন্যটি বাকি সব’- গ্লেন মেগ্রা (সাবেক ফাস্ট বোলার, অস্ট্রেলিয়া)। ‘আমার সৌভাগ্য, আমাকে কোনোদিন মাশরাফির বল মোকাবিলা করতে হয়নি’- স্যার ভিভ রিচার্ডস (লিজেন্ড ব্যাটসম্যান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ)। ‘অধিনায়ক তো অনেকেই আছেন, মা আছেন কয়জন?- মাশরাফির ব্যাপারে ইঙ্গিত করে’- এডাম গিলক্রিস্ট (সাবেক উইকেটকিপার, অস্ট্রেলিয়া)। ‘আপনি যদি মাশরাফির পুরো এক ওভার স্বাচ্ছন্দ্যে খেলে ফেলতে পারেন তার মানে একদিন আপনি লিজেন্ড হবেন’- ভিভিএস লাক্সম্যান (সাবেক ব্যাটসম্যান, ইন্ডিয়া)। ‘নেতা, মানুষ আর খেলোয়াড় এই ৩টি শব্দ যোগ করলে মাশরাফির মতো কোনো ক্রিকেটারের আগে কোনোদিন ক্রিকেটবিশ্ব দেখেনি’- নাসের হোসাঈন (সাবেক ক্যাপ্টেন, ইংল্যান্ড)। ‘তোমরা আমাকে একজন মাশরাফি দাও, আমি তোমাদের এগারোটা ‘সোনার টুকরো’ (ক্রিকেটার) উপহার দিবো’- শন পলক (সাবেক অধিনায়ক, দক্ষিণ আফ্রিকা)। ‘আমাদের সৌভাগ্য আমরা মাশরাফির যুগে জন্মেছিলাম’- আমিনুল ইসলাম বুলবুল (সাবেক ক্যাপ্টেন, বাংলাদেশ)। 

মাশরাফি রাজনীতিতে নাম লেখানোর পর থেকেই একটা প্রশ্ন তাকে বারবার শুনতে হয়েছে- তাহলে ক্রিকেট ছাড়ছেন কবে? পরিস্কার কোনো উত্তর দেননি মাশরাফি। শুধু আলতো হেসেছেন। 

বাবু/জেএম
« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


Also News   Subject:  আমি   ফুরিয়ে   যাইনি  







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত