চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ৮, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ২৪, ২৫ ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে চট্টগ্রাম-১০ সংসদীয় আসন। ৪ লাখ ৮৫ হাজার ভোটার অধ্যুষিত এই আসনে প্রার্থী হয়েছেন ১০ জন প্রার্থী। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৩০ জুলাই আসনটিতে উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী হিসেবে মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বাচ্চু ৫২ হাজার ৯২৩ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির মনোনীত লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী সামসুল আলম পেয়েছেন ১ হাজার ৫৭২ ভোট। সেই নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ১২ শতাংশের কম৷ তখন অনেকটাই ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে মহিউদ্দিন বাচ্চুর গলায় বিজয়ের মালা উঠলেও এবারের নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়া তাঁর জন্য বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে। নিজ দলের একজন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় একই সাথে এই আসনের আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী, ২০১০ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সমর্থিত সাবেক মেয়র ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের সাবেক উপদেষ্টা এম মনজুর আলমকে স্থানীয় আওয়ামী লীগেরই একাংশ সমর্থন জোগানোয় আসনটিতে নৌকা ডুবির আশংকা করছে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা।
অভিযোগ উঠেছে নগর আওয়ামী লীগের একাংশের নেতা কর্মীদের এই আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মহিউদ্দিন বাচ্চুর পক্ষে কাজ না করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে৷ মহিউদ্দিন বাচ্চুর একাধিক সমর্থক বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, “চট্টগ্রাম-১০ আসনের ৮টি ওয়ার্ডেই এখন আওয়ামী লীগ সমর্থিত ওয়ার্ড কাউন্সিল রয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মহিউদ্দিন বাচ্চুর পক্ষে একাধিক ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে দেখা যাচ্ছে না। একই ভাবে এই আসনের বিভিন্ন ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের অনেক নেতারা পরোক্ষভাবে সাবেক বিএনপি নেতা মনজুর আলমকে জেতানোর জন্য কাজ করছেন। অনেক আসনে দলেরই কোন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে সেখানে তার পক্ষে দলের নেতা কর্মীরা কাজ করছে৷ কিন্তু মনজুর আলম তো আওয়ামী লীগের কেউ নন বরং তিনি আওয়ামী লীগ ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দেয়া লোক।”
বুধবার (৩ জানুয়ারি) চট্টগ্রাম-১০ আসনের হালিশহর চুনা গুদাম এলাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী মনজুর আলমের ফুলকপির পক্ষে প্রকাশ্য বিশাল শোডাউন করে প্রচারণা চালিয়েছেন রামপুর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও চসিক প্যানেল মেয়র আবদুস সবুর লিটন৷ লিটন উক্ত ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। এর আগে গত ২৭ ডিসেম্বর আবদুস সবুর লিটন তার ফেসবুকে লিখেছেন,... ২৫ নং রামপুরের মানুষ যাকেই ভোট দিবে দেক, তারা তাদের পছন্দের (এমপি) বেছে নিক, আমার তাঁতে কিছুই যাই আসে না, বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন ভোট কেন্দ্রে গিয়ে যাকে খুশি তাকে ভোট দিতে, আমি জননেত্রীর সেই সিপাহ শালার একজন সৈনিক মাত্র, আপনারা আগামী ৭ই জানুয়ারী ভোট কেন্দ্রে যাবেন, যাকে খুশী তাকে ভোট দিয়ে জয় যুক্ত করবেন…….। সম্প্রতি চট্টগ্রাম ১০ আসনের ১৩নং পাহাড়তলী ওয়ার্ডে বিএনপি চেয়ারপার্সনের সাবেক উপদেষ্টা মনজুর আলমের পক্ষে বিশাল শোডাউনের নেপথ্যে কাজ করেছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর, নগর যুবলীগের সহ সভাপতি ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী৷ সেদিনের পথ সভায় খোদ প্রার্থী মনজুর আলম বলেছিলেন, “এই ১৩নং ওয়ার্ডে গণ সংযোগ ও ভোটের কার্যক্রম সব কিছুর রূপকার হলেন আমাদের ওয়াসিম ভাই।” লালখান বাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর, নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি আবুল হাসনাত বেলাল ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে নিজ ওয়ার্ডে সকল প্রকার নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা দেয়৷ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গ্রেফতার, হয়রানির প্রতিবাদে তিনি এমন ঘোষণা দেন বলে ফেসবুক স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেছেন৷ তবে কারা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে সেই বিষয়টি স্পষ্ট কিছু উল্লেখ করেননি কাউন্সিলর বেলাল।
চট্টগ্রামের রাজনীতিতে মহিউদ্দিন বাচ্চু প্রয়াত সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর একনিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে সুপরিচিত৷ মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর বর্তমানে এই বলয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁর পুত্র চট্টগ্রাম-৯ আসনের সংসদ, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। বিগত উপনির্বাচনেও প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীদের সম্মিলিত সমর্থন পেয়েছিলেন মহিউদ্দিন বাচ্চু৷ তবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পেলেও মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীদের বড় একটি অংশকে ভোটের মাঠে মহিউদ্দিন বাচ্চুর পাশে দেখা যাচ্ছে না৷ গুঞ্জন আছে, এই অংশটি মনজুর আলমকে সমর্থন দিচ্ছে। একই আসনে চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদকে স্বতন্ত্র প্রার্থী করার পেছনেও প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরী বলয়ের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে দায়ী করা হচ্ছে৷ নিজ গ্রুপের অসহযোগিতার মধ্যে মহিউদ্দিন বাচ্চুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন চট্টগ্রাম আওয়ামী পরিবারের আরেকটি বলয়ের নেতা নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন৷ বিগত কিছুদিন যাবত আ জ ম নাছির ও তাঁর অনুসারীরা সার্বক্ষণিক মহিউদ্দিন বাচ্চুর প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে যাতায়াত করছেন৷ ভোটের কর্মকৌশল নিয়ে আ জ ম নাছিরের উপস্থিতিতে দফায় দফায় বৈঠক করতেও দেখা যাচ্ছে।
যদিও এই বিষয়ে মহিউদ্দিন বাচ্চু কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, আমাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সংগঠনের সভানেত্রী মনোনয়ন দিয়েছেন৷ আমার বিশ্বাস প্রকৃত আওয়ামী লীগের সকল নেতাকর্মীরা নৌকা পক্ষেই কাজ করবে৷ এছাড়া সাধারণ ভোটাররা সবাই নৌকাকে বিজয়ী করতে ব্যালটের মাধ্যমে রায় দেবে।
মনজুর আলম আওয়ামী লীগের কেউ নন : চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর মনজুর এক সময় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছের লোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। চসিক মেয়র থাকাকালীন মহিউদ্দিন চৌধুরী তার বিশ্বস্ত লোক মনজুর আলমকে সর্বাধিক সময় ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দ্বায়িত্ব দিয়েছিলেন৷ তবে ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগে মনজুর আলম বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করে তার নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ওই সময় নির্বাচনে চার দলীয় জোট তাকে সমর্থনও দেয়। সেই সমর্থন নিয়ে মনজুর আলম বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে বিপুল ভোটে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন । ২০১২ সালের ৪ জুলাই বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া দলের গঠনতন্ত্রের ক্ষমতাবলে মনজুর আলমকে তার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নিযুক্ত করেন।
একই বছর ৮ জুলাই রোববার তৎকালীন মেয়র মনজুর আলম ঢাকা সংসদ ভবন এলাকায় জিয়াউর রহমানের কবের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান৷ সেদিন রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে যান মনজুর। সেখানে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন । এসময় উপদেষ্টা মনোনীত করায় খালেদা জিয়াকে ফুল দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন তৎকালীন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এম মনজুর আলম। সাক্ষাৎকালে উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়ায় দলীয় প্রধানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন মনজুর।
২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে চসিক মেয়র পদে কমলা মার্কায় নির্বাচনে অংশ নিলেও মাঝ পথে কারচুপির অভিযোগ তুলে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন মনজুর আলম৷ সেসময় তিনি গণমাধ্যমে বলেছিলেন, “ভোট কেন্দ্রে জালভোট, ভোট সন্ত্রাসের মাধ্যমে চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে প্রতিপক্ষ প্রার্থী নির্বাচন পরিবেশ নষ্ট করেছে। জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়ায় নিজেকে নির্বাচন থেকে প্রত্যাহার করে নিলাম। সেই সঙ্গে রাজনীতি থেকে অবসর নিলাম।”
মোহাম্মদ মনজুর আলম ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এই আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আফছারুল আমীনের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন তিনি। তবে ওই বছর আর নির্বাচন করেননি।
যদিও মনজুর আলম ২০১৫ সালে বিএনপি’র রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে ভোটের সময় হলেই তিনি বার বার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত মনজুর আলম আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে ফিরে আসেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বাংলাদেশ বুলেটিনকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তারা জানিয়েছেন, মনজুর আলম এক সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। কিন্তু চসিক মেয়রের আসনে বসার জন্য তিনি দল ত্যাগ করেছিলেন ৷ বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পদ গ্রহণ করেছিলেন৷ পরের বার ভোটে পরাজয় বুঝতে পেরে ভোটের দিন হঠাৎ করেই রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষনা দেন। অদ্যাবধি চট্টগ্রাম মহানগর আওতাধীন কোন এলাকায় মনজুর আলম দলের সাধারণ সদস্য পদের ফরমও পূরণ করেনি৷ বহুবার চেষ্টা তদবির করলেও দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা আজ অবধি মনজুর আলমকে সাক্ষাৎ পর্যন্ত দেননি৷ সুতরাং তিনি আমাদের আওয়ামী পরিবারের কেউ না।
এই বিষয়ে মনজুর আলমের বক্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। বৃহস্পতিবার (৪ জানুয়ারি) চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে নিজের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ ও সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় কালে মনজুর আলম নিজেকে সাবেক বা বর্তমান আওয়ামী লীগের কেউ হিসেবে পরিচয় দেননি৷ এই বিষয়ে মনজুর আলমের মিডিয়া সমন্বায়ক আবদুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই বিষয়টি নিয়ে এই মুহূর্তে প্রার্থী ছাড়া অন্য কেউ মন্তব্য করতে পারবেন না বলে জানান।