টেকসই উন্নয়নের অন্যতম শর্ত হিসেবে গোটা বিশ্বেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শুদ্ধাচারকে ব্যবসা-বাণিজ্যের টেকসই বিকাশের পূর্বশর্ত হিসেবে দেখে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাসেল কমিটি অন ব্যাংকিং সুপারভিশন (বিসিবিএস) কর্পোরেট জগতে সুশাসনের জন্য যে ১৩ দফা নীতিমালা প্রণয়ন করেছে তা আমাদের সহায়তা করতে পারে বলে মনে হয়েছিল।
বিসিবিএস-এর এই ১৩ দফায় মূলত চার স্তরের জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আর্থিক সেবাদানকারীসহ অন্যান্য কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে সুশাসনের চর্চা তথা শুদ্ধাচারের সংস্কৃতি লালনের পথনকশা দেওয়া হয়েছে। এই চার স্তরের জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থাপনার উদ্যোগগুলো হলো:
১. প্রতিদিনের ব্যবস্থাপনায় ম্যানেজমেন্ট কন্ট্রোলের মাধ্যমে ভুল-ত্রুটি এড়ানো
২. কমপ্লায়েন্স বিষয়ে যে নীতি-নির্দেশনা রয়েছে সেগুলো যথাযথভাবে মেনে চলা
৩. এরপরেও যে সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে যায় সেগুলো যাতে ভবিষ্যতে আর না হয় তা নিশ্চিত করতে অভ্যন্তরীণ অডিটের ব্যবস্থা রাখা এবং
৪. প্রতিটি খাতের রেগুলেটর প্রতিষ্ঠান দ্বারা যথাযথ তদারকির ব্যবস্থা রাখা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফ থেকে আমরাও চাইছিলাম এই জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থাপনার চর্চাগুলো বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের অংশীজনদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ুক। তাই এমন প্রেক্ষাপটে আমাদের জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের অংশ হিসেবে দেশের ব্যাংকিং খাতে শুদ্ধাচার সংস্কৃতি চর্চার যে নির্দেশনা নীতি-নির্ধারণী মহল থেকে এসেছিল সেটিকে আমরা সাদরে গ্রহণ করেছিলাম। আমাদের পুরো ব্যাংকিং খাত অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের তাগিদ অনুভব করে কৃষক, ক্ষুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তা বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন এবং পিছিয়ে পড়া মানুষদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য বৃত্তিপ্রদানসহ নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করতে শুরু করে।
বিষয়টি ব্যাংকিং খাতের জন্য প্রকৃতপক্ষেই ছিল একান্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমরা যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি কমিটি করে দেই এবং নিয়মিতভাবে এ বিষয়ের অগ্রগতি গভর্নরকে অবহিত করতে বলি। কাজটির গুরুত্ব সব পর্যায়ে অনুধাবন করার জন্যে এই ‘জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়নবিষয়ক নৈতিকতা কমিটি, বাংলাদেশ ব্যাংক’ গঠন করা হয়। আজ ভাবতে ভালো লাগছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ পুরো আর্থিক খাত সেদিন আমাদের ওই নৈতিক আহ্বানে বড় ধরনের সাড়া দিয়েছিল। এর ফলে এই খাতের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা অনেকাংশেই বেড়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই শুদ্ধাচার চর্চা কমিটির আওতাধীনে সব বাণিজ্যিক ব্যাংকে একটি করে শুদ্ধাচার কমিটি গঠন করা হয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকের এসব শুদ্ধাচার কমিটির প্রধানগণ প্রতি মাসে একবার করে বাংলাদেশ ব্যাংকে আসতেন। এখানে নতুন নতুন আইডিয়া শেয়ার করা হতো এবং পৃথকভাবে প্রতিটি ব্যাংকের উদ্যোগ ও কাজের সফলতা জানতে চাওয়া হতো। ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিরাও খুবই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই কাজে অংশগ্রহণ করতেন। এই অংশগ্রহণের প্রভাব আমরা ব্যাংকিং খাতে নৈতিকতার পরিবেশ উন্নয়নের ওপর পড়তে দেখেছি।
একদিন নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান আমাকে জানাল যে, শুদ্ধাচার বিষয়ে তার মাথায় একটা নতুন বুদ্ধি এসেছে; ‘৫০ জন ছড়াকারের কাছ থেকে চার লাইনের ১০০টি শুদ্ধাচারবিষয়ক ছড়া সংগ্রহ করে একটি বই করতে চাই। এরপর ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিতে চাই, তারা যেন দেশের বিভিন্ন এলাকায় হাইওয়ের পাশে বিলবোর্ড লাগিয়ে এসব ছড়া প্রচার করে। তাছাড়া শাখার লেনদেন কাউন্টারের ওপরে ব্যানার আকারে ঝুলিয়ে এবং দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন আকারে প্রচার করে ছড়াগুলো তাদের গ্রাহকদের দৃষ্টিতে আনবে। একজন শিশু বা কিশোর দেশের যে এলাকাতেই থাকুক না কেন, তার চোখে বারবার এই শুদ্ধাচারের ছড়াগুলো পড়বে। চার লাইনের এসব ছড়া সহজেই তাদের মুখস্থ হয়ে যাবে এবং মাথায় স্থায়ীভাবে কাজ করতে থাকবে। ব্যাংকে যারা কাজ করেন তারাও এগুলো দেখে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন।’
মাহফুজুরের প্রস্তাবটি আমার খুব ভালো লাগল। আমি সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ে নোট নিয়ে আসতে বললাম এবং মাহফুজুরকে কাজটি সম্পাদনের জন্যে উৎসাহ দিলাম। আমার বড়ই সৌভাগ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রায় সব কর্মকর্তাই, বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত তরুণরা, ব্যাংকিং খাতকে আরও মানবিক ও প্রান্তজন-হিতৈষী করার নানা উদ্যোগে দারুণ উৎসাহের সঙ্গে যুক্ত হতে সামান্য দ্বিধা করেননি।
নৈতিকতা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততার মধ্য দিয়ে যে আচরণ তাই শুদ্ধাচার। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতি-প্রথার প্রতি আনুগত্যও এক ধরনের শুদ্ধাচার। শুদ্ধাচার সুশাসনের পূর্বশর্ত। আবার এ দুটো একে অপরের পরিপূরক। সুশাসনের অভাবে মানুষ দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচার, সন্ত্রাস ও বৈষম্যের শিকার হয়। সুশাসনের জন্য দরকার স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও অংশীদারিত্ব। সমাজের সব ক্ষেত্রে এগুলো প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। আর সবচেয়ে জরুরি হলো শিশুদের মধ্যে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা করা। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই মাহফুজুরের সম্পাদনায় প্রকাশিত হলো ‘ছড়ায় ছড়ায় শুদ্ধাচার’। বইটির প্রাক-কথনে আমি লিখলাম, ‘মানুষের চরিত্রনিষ্ঠাই হচ্ছে শুদ্ধাচার। অর্থাৎ নৈতিকতা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততার মধ্য দিয়ে যে আচরণ তাই শুদ্ধাচার। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতি-প্রথার প্রতি আনুগত্যও এক ধরনের শুদ্ধাচার। শুদ্ধাচার সুশাসনের পূর্বশর্ত। আবার এ দুটো একে অপরের পরিপূরক। সুশাসনের অভাবে মানুষ দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচার, সন্ত্রাস ও বৈষম্যের শিকার হয়। সুশাসনের জন্য দরকার স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও অংশীদারিত্ব। সমাজের সব ক্ষেত্রে এগুলো প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। আর সবচেয়ে জরুরি হলো শিশুদের মধ্যে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা করা।
ব্যাংকের কর্মকর্তাগণের সততা ও দক্ষ কাজের মূল্যায়ন করে উৎসাহিত করা হলে সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তার সংখ্যা আরও বাড়বে এই প্রত্যাশা নিয়ে চালু করা হলো ব্যাংকের সেরা কর্মকর্তা নির্বাচন কর্মসূচি। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি বছরই তাদের সেরা কর্মীদের চিহ্নিত করে পুরস্কৃত করে থাকে। এ ছাড়াও সেরা কর্মকর্তাদের ছবি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রবেশ পথে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বছরব্যাপী ঝুলিয়ে রাখা হয়। এতে পুরস্কারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দায়িত্বজ্ঞান ও আগ্রহ বাড়ে। সেই সঙ্গে অন্য কর্মকর্তাগণও সেরা কর্মকর্তা হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকে এই প্রোগ্রামটি এখনও চলছে বলে জানি। কোনো কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকও প্রোগ্রামটি অনুসরণ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে দেশের স্বার্থে বিভিন্ন উন্নয়নমুখী কর্মসূচি চালু করে। কখনও এসব কর্মসূচির পেছনে পুনঃঅর্থায়নও করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রবর্তিত কর্মসূচিগুলোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকারী ব্যাংকগুলোকে উৎসাহ প্রদানের জন্য অনুষ্ঠান করে সার্টিফিকেট প্রদান করার রীতিও চালু করা হয়। এতে বিভিন্ন ব্যাংক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে সফল হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যায়। উদাহরণস্বরূপ কৃষিঋণের টার্গেটের কথা উল্লেখ করা যায়। কৃষকগণ যাতে সহজ শর্তে প্রয়োজনীয় ঋণ পায় সে লক্ষ্যে ব্যাংকগুলোকে আগ্রহী করে তোলা বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম লক্ষ্য। এতে কৃষকগণের পাশাপাশি দেশও উপকৃত হয়। আমি নিজে আমার সাত বছর সময়কালে দুশর বেশিবার ঢাকার বাইরে গ্রামে-গঞ্জে গিয়েছি। কৃষকদের ও নারী উদ্যোক্তাদের প্রকাশ্যে ঋণদানে অংশগ্রহণ করেছি। স্কুল ব্যাংকিংয়ের হিসাব বই শিশুদের হাতে তুলে দিয়েছি। সুবিধা-বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের হাতে বৃত্তির চেক তুলে দিয়েছি। দশ টাকার হিসাবধারী পথশিশুদের সঙ্গে ইফতার খেয়েছি। চরের শিক্ষার্থীদের স্কুলব্যাগ ও বই বিতরণ করেছি। ছিটমহলের দুর্ভাগা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে সীমান্তের ওইসব গ্রামেও গিয়েছি। যেসব সবুজ উদ্যোক্তারা কেঁচো সার, সোলার সেচ ও জৈবসার উৎপাদন করছিলেন তাদের কাজ স্বচোখে দেখতে গিয়েছি। সবুজ গার্মেন্টস কারখানা দেখার কথাও এই প্রসঙ্গে বলতে পারি। এমন দুটো পরিদর্শনে বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. কৌশিক বসু এবং নেদারল্যান্ডসের রানী ম্যাক্সিমাকেও নিয়ে গিয়েছিলাম। তারা বাংলাদেশের মানবিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং দেখে খুবই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন।
সার্বিক বিচারে আমার মনে হয় ওই সময়টায় দেশের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী মহল থেকে আসা নির্দেশনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আর্থিক সেবা খাতে শুদ্ধাচারের সংস্কৃতির শুরুটা আমরা ভালোভাবেই করতে পেরেছিলাম। দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্তা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর দায় ছিল যাতে তারা নিজেদের ব্যবস্থাপনায় শুদ্ধাচারের সংস্কৃতিকে প্রোথিত করে আর্থিক খাতের বাকি অংশীজনদের জন্য কার্যকর দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এ দায়িত্বটি পালনে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। আর এই চেষ্টাটিই কাম্য। সুফলও দৃশ্যমান হয়েছে পরবর্তী সময়ে। আগে যেখানে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ ব্যাংকের দরজায় যেতে ভয় পেতেন, এখন তাদের অধিকাংশই নিয়মিত ব্যাংকিং করছেন। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছে ঠিকই, তবে ব্যাংকারদের মানসিকতায় ইতিবাচক পরিবর্তন সে সময় আনা সম্ভব হয়েছিল বলেই তারা প্রযুক্তির গণমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করেছেন।
শুদ্ধাচারের সংস্কৃতি বিকাশে আমাদের এই সাফল্যের পেছনে যে বিষয়টি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে তা হলো আমাদের তারুণ্যমুখিতা। আমরা সব সময়ই শুদ্ধাচার চর্চার আন্দোলনে ব্যাংকিং খাতের তরুণ কর্মকর্তাদের দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছি, তাদের দিক থেকেও সাড়া পেয়েছি তুলনামূলক বেশি। এই তরুণরা শুদ্ধাচারের বার্তাগুলো ছড়িয়ে দিয়েছেন অনেকটা স্বপ্রণোদিতভাবেই। এর প্রভাবে ব্যাংকিং খাতের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা বেড়েছে। এই আস্থায় যেন কোনো কারণেই চিড় না ধরে সেদিকে সর্বদাই নজর রাখতে হবে। আগামীতে এই তরুণরাই দেশের ব্যাংকিং খাতের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে যাবেন, তখন শুদ্ধাচারের সাংস্কৃতিক ভিত্তি নিশ্চয় আরও মজবুত হবে। ব্যাংকিং খাত নিয়ে মানুষের দুশ্চিন্তা থাকবে না।
লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়