বেসরকারি সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর উপাচার্য প্রফেসর মো. মোজাম্মেল হককে বেআইনি ভাবে অব্যাহতি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটি ট্রাষ্টি বোর্ডের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ এই বেআইনি অব্যাহতির নেপথ্যে কাজ করেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ট্রেজারার ও বর্তমানে ট্রাষ্টি বোর্ডের সদস্য সচিব সরওয়ার জাহান৷ সরওয়ান জাহানের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা আত্মসাৎ, নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টারের খরচ নির্বাহ করাসহ বেশকিছু অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও জাল সনদের ব্যবসার অভিযোগ মতন গুরুতর অভিযোগই রয়েছে সরওয়ার জাহানের বিরুদ্ধেই। আর এসব নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করায় ভিসিকে তড়িঘড়ি করে কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে অব্যাহতি দিয়ে দেওয়া হয়।
ভিসি প্রফেসর মো. মোজাম্মেল হক অভিযোগ করেছেন, এই অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষেত্রে মানা হয়নি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০। আইন অনুযায়ী দেশের সকর বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য্য (চ্যান্সেলর) রাষ্ট্রপতি। ওই আইনে বলা হয়েছে, চ্যান্সেলর কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাষ্টি বোর্ড কর্তৃক প্রস্তাবিত কোন ব্যক্তিকে চার বৎসর মেয়াদের জন্য উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত করিবেন। এতে আরও বলা হয়েছে চ্যান্সেলর সুস্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য কারণে বোর্ড অব ট্রাষ্ট্রিজের সুপরিশক্রমে ভাইস চ্যান্সেলরকে অপসারণ করতে পারবেন। তবে শর্ত থাকে যে অপসারণের সিদ্ধান্তের আগে সংশ্লিষ্ট ভাইস চ্যান্সেলরকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু প্রফেসর মোঃ মোজাম্মেল হক জানিয়েছেন তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ দেওয়া হয়নি। উল্টো বেআইনীভাবে রাস্ট্রপতির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এক সভাতেই অব্যাহতির চিঠি ধরিয়ে দেওয়া হয়।
এমন ঘটনায় চট্টগ্রামের শিক্ষক মহলে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। শিক্ষক সমাজ বলছে, একজন ভিসিকে অন্যায়ভাবে কোন প্রকার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে অব্যাহতি দিয়ে বের করে দেওয়া গুণ্ডামির সামিল। সেইসাথে পুরো শিক্ষক সমাজকে অপমান করা হলো এ ঘটনার মাধ্যমে।
জানা গেছে, ২০২১ সালের ১৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ চার বছরের জন্য অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হককে সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ওই বছরের ১ এপ্রিল তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সে হিসাবে উপাচার্য হিসেবে তার মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ৩১ মার্চ। কিন্তুু মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় ১ বছর আগে প্রফেসর মো. মোজাম্মেল হককে অব্যাহতি দিয়ে দেওয়া হয়।
গত ২৫ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়টির বিওটি সদস্য সচিব সরওয়ার জাহান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হককে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ শরীফ আশরাফুজ্জামানকে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, ‘গত ২০ এপ্রিলে এই সিদ্ধান্ত সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির নীতি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ অনুযায়ী ৭৭তম বোর্ড অব ট্রাস্টির সভায় সদস্যদের সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়, যা ২১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়েছে।’
এতে আরও বলা হয়, ‘অধ্যাপক মোজাম্মেল হক বিভিন্ন অবৈধ কার্যকলাপের মাধ্যমে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন, শৃঙ্খলা ভঙ্গ, আর্থিক অনিয়ম, অসদাচারণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়বিরোধী কোনো এক কুচক্রী মহলের প্ররোচনায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে আসছিলেন। তাকে একটি কারণ দর্শানোর চিঠি ইস্যু করা হয়েছে এবং জবাব প্রাপ্তির সাপেক্ষে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। এতে আরও বলা হয়েছে আপনার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত হবে। অব্যাহতি নিয়ে কোন কথা থাকলে কিংবা স্পষ্ট জানতে চাইলে বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিবের সাথে যোগাযোগ করতে দ্বিধা করবেন না।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ২০০৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট একটি অসাধুচক্র অনেকগুলো জাল সনদ বিক্রি করেছে। অধ্যাপক মোজাম্মেল হক প্রতিষ্ঠানটিতে উপাচার্য হয়ে আসার পর এই জাল সনদের বিষয়টি জানতে পেরে অনলাইন পদ্ধতি বাদ দিয়ে সরাসরি এনালগ প্রক্রিয়ায় আবেদন যাচাইয়ের ব্যবস্থা করেন। তখনই ১০৫টি জাল সনদ ধরা পড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে পদাধিকারবলে তিনি এই সংক্রান্তে মামলা দায়েরের প্রস্ততিও নিচ্ছিলেন। একইসাথে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিকে জানিয়েছিলেন৷ এরপর ইউজিসি থেকে তদন্ত কমিটি করা হলে শুরু হয় তদন্ত। বর্তমানে সেই তদন্ত চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে।
এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে ভিসি মো. মোজাম্মেল হক দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুুতি নিচ্ছিলেন। আর এ মামলা হলে অনেক রাঘববোয়ালও ফেঁসে যেতে পারেন। এজন্যই অনিয়মের মিথ্যা অভিযোগ এনে উপাচার্যকে সাময়িক অব্যাহতির ঘোষণা দেওয়া হয় বিওটি থেকে।
অভিযোগ আছে, সাউদার্নের বিওটি নিয়ম ভেঙে প্রভিডেন্ট ফান্ডের ৫ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় ‘চিটাগং ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব’ নামে একটি কোচিং সেন্টার চালানো হচ্ছে। সেখানে এরই মধ্যে ৫০ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে। যা সম্পূর্ণ নিয়ম বহির্ভূত। বিষয়গুলো ইউজিসির মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করা হয়েছে। তারা যাচাই-বাছাই করতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন।
সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হক বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, "আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম ও অর্থ কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় এবং আত্মসাৎ করা টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাণ্ডে ফেরত দিতে বলায় নিয়ম ভেঙে আমাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আইন অনুযায়ী বিওটি আমাকে অব্যাহতি দিতে পারে না। আচার্যের (রাষ্ট্রপতি) কাছে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকার বিষয়টি আইনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। সে সুযোগও আমি পাইনি।"
এ বিষয়ে জানতে সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য সচিব সরওয়ার জাহানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তার ফোনে রিং বাজলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। এছাড়া সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাষ্টির বোর্ডের একাধিক সদস্যকেও বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তারা সাড়া দেননি।
ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক ওমর ফারুক গণমাধ্যমকে বলেন, আইন অনুযায়ী বোর্ড অব ট্রাস্টিজ রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত কোনো উপাচার্যকে অব্যাহতি দিতে পারে না। আমরা বিষয়টি নিয়ে সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির বিওটিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেব।