সোমবার ৭ জুলাই ২০২৫ ২৩ আষাঢ় ১৪৩২
সোমবার ৭ জুলাই ২০২৫
‘এলেন, খুন করলেন, উড়াল দিলেন’
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: সোমবার, ৩ জুন, ২০২৪, ১:১৮ PM আপডেট: ০৩.০৬.২০২৪ ৭:০৯ PM
নরসিংদীর মনোহরদীর কাহেতরগাঁও এলাকার পারভীন আক্তার মাস দুয়েক আগে পাড়ি জমান কানাডায়। তাঁর স্বামী নাজমুল হাসান প্রায় সাত বছর কানাডায় বাস করছেন। স্বজন কাউকে না জানিয়ে আকস্মিক ১৬ মে ঢাকায় আসেন পারভীন। 

২৪ ঘণ্টার মতো রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকার একটি বাসায় অবস্থান করে পরদিন ফের কানাডার মন্ট্রিলে চলে যান তিনি। 

তবে বসুন্ধরার যে বাসায় তিনি ছিলেন, সেখান থেকে শনিবার রাতে অর্ধগলিত এক পুরুষের লাশ উদ্ধারের পর প্রযুক্তিগত তদন্তে পারভীনের নামটি সামনে আসে। এতে চমকে ওঠেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। তদন্তে বেরিয়ে আসে নিহত ওই যুবকের নাম আরিফুল ইসলাম। 

অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে বসুন্ধরার ওই ফ্ল্যাট এক সপ্তাহের জন্য ১৩ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছিলেন আরিফুল। তিনি ১৭ মে জাপান থেকে ঢাকায় ফিরে ওই ফ্ল্যাটে ওঠেন। বছরখানেক ধরে জাপান অবস্থান করছিলেন নরসিংদীর যুবক আরিফুল।

পারভীনের বাবা বৃদ্ধ নুরুল ইসলামের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কথা বলেছেন একাধিক কর্মকর্তা। মেয়ে ঢাকায় এসে আবার এক দিনের মধ্যে কানাডায় চলে গেছে, শুনে প্রথমে চমকে ওঠেন নুরুল ইসলাম। এর পর মেয়েকে ফোন করে সত্যতা জানতে চান। ফোনের ওপাশ থেকে পারভীন বাবাকে জিজ্ঞেস করেন কেন এমন প্রশ্ন বারবার করছেন। এর পর বাবার কাছে আর কোনো কিছু গোপন করতে পারেননি তিনি। 

পারভীন বলেন, ‘বিশ্বাসঘাতককে মারতে ঢাকায় গিয়েছি। ও নরপিশাচ। এমন মৃত্যু ওর প্রাপ্য ছিল। ওকে মেরে আমার কোনো অনুশোচনা নেই।  কোনো দুঃখ নেই। এ জীবনে আর দেশে ফিরতে চাই না।’  

সূত্র জানায়, স্বামী কানাডায় থাকার সময় পারভীনের সঙ্গে ‘গভীর’ সম্পর্ক গড়ে তোলেন আরিফুল। টোপ দিয়ে বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে নিয়ে যেতেন। অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তুলে রেখেছিলেন চতুর আরিফুল। ওই ছবি ব্যবহার করে দীর্ঘদিন পারভীনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখেন। ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে মাঝে মাঝে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করতেন আরিফুল। এক পর্যায়ে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর হলফনামার মাধ্যমে পারভীনকে বিয়ে করেন, তবে সংসার করেননি কখনও। বিয়ের বিষয়টিও গোপন রাখা হয়েছিল। 

গোপন ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে পারভীনকে পরবর্তী সময়ে হোটেলে যেতে বাধ্য করতেন আরিফুল। মূলত বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে নেওয়ার পর স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেওয়ার জন্যই তাঁর ওই ‘বিয়ে-নাটক’। বছরখানেক আগে আরিফুল চলে যান জাপান। সেখানে এক জাপানি তরুণী নাচুকিকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর ধর্মান্তরিত হলে নাচুকির নতুন নাম রাখেন আয়েশা। জাপানি ওই তরুণী বর্তমানে অন্তঃসত্ত্বা।

সম্প্রতি জাপান থেকে দফায় দফায় পারভীনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন আরিফুল। বাংলাদেশে ফেরত আসার জন্য চাপ দিতে থাকেন। দেশে ফেরত না এলে ভিডিও পারভীনের স্বামী ও স্বজনের কাছে পাঠানোর হুমকি দেন। কথা না শোনায় পারভীনের স্বামীর কাছে কিছু ভিডিও পাঠিয়ে দেন আরিফুল। এসব দেখে পারভীনকে দেশে ফেরত এসে আরিফুলের সঙ্গে সব মিটমাট করতে চাপ দেন তাঁর স্বামী নাজমুল। আরিফুলকে নিয়েই সংসার করতে বলেন।

পরে বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের সমঝোতায় যেতে ঢাকায় আসেন তিনি। আরিফুলও জাপান থেকে আসেন ঢাকায়। একই বাসায় ওঠার পর পুরোনো ভিডিও ডিলিট করতে আরিফুলকে বারবার অনুরোধ করেন পারভীন। জাপানে নিজের সংসারে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন। 

তবে আরিফুল নাছোড়বান্দা। জোর করে ওই ফ্ল্যাটে পারভীনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়ান। এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ায় প্রথমে আত্মহত্যার কথাও ভাবতে থাকেন পারভীন। পরে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আরিফুলকে খুন করেন। ঘুমিয়ে পড়লে আরিফুলকে ছুরিকাঘাত করা হয়।

পুলিশ বলছে, ওই ছুরি আগে থেকেই পারভীনের কাছে ছিল। গতকাল পারভীন তাঁর বাবাকে জানান, আরিফুলের সঙ্গে সমঝোতা না হলে আত্মহত্যা করবেন এমন পরিকল্পনা করেই দেশে ফিরেছিলেন। পরে চিন্তা করেন, যে দীর্ঘ দিন তাকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলছিল, তারই উপযুক্ত শাস্তি হওয়া দরকার। কানাডা থেকে ফেরার সময় পারভীনের কাছে টিকিটের খরচ বাদে আড়াই লাখ টাকার মতো ছিল।  

পারভীন গত ১৬ মে কানাডা থেকে ঢাকায় এসে খিলক্ষেতের একটি হোটেলে ওঠেন। পরদিন বেলা ১১টায় বসুন্ধরার ভাড়া ফ্ল্যাটে যান। পারভীন ঢাকায় ফিরেছেন নিশ্চিত হয়ে জাপান থেকে ১৭ মে বিকেল ৪টায় ঢাকায় আসেন আরিফুল। 

এর আগেই বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সি-ব্লকের ২ নম্বর রোডের এক নম্বর ভবনে মাটি প্রপার্টিজের ২০৩ নম্বর স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট সাত দিনের জন্য ভাড়া করে রাখেন আরিফুল। অগ্রিম ১৩ হাজার টাকা বিলও পরিশোধ করেন অনলাইনে। দেশি-বিদেশি নাগরিকরা অল্প দিনের জন্য অনলাইনে স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে থাকেন।

ভবনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, ১৭ মে বিকেল ৪টা ৯ মিনিটে আরিফুল ও পারভীন অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেছেন। দু’জনের মুখেই ছিল মাস্ক। আরিফুলের হাতে একটি লাগেজ। ১৮ মে ভোর ৬টা ৩১ মিনিটে পারভীন অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে যান।

পারভীন স্বীকার করেন, ১৭ মে রাত ২টার দিকে আরিফুলকে হত্যা করা হয়। এর পর নিজে খুনের দায় স্বীকার করে ওই ফ্ল্যাটে চিরকুট লিখে রাখেন।

সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও তদন্তে তারা আরিফুলের সঙ্গে পারভীনকে ঢুকতে দেখেছেন। এর পর একা বের হয়ে যেতে দেখা যায়। এর ১৫ দিন পর শনিবার বিকেলে পরিচ্ছন্নতা কর্মী ওই কক্ষের দরজা নক করে সাড়াশব্দ না পেয়ে বিকল্প চাবি দিয়ে ঘর খুলে লাশ দেখতে পান। এর পর খবর পেয়ে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে।

আরিফুল হত্যাকাণ্ডে তাঁর বোন সাফরিজা আক্তার রেলি বাদী হয়ে রোববার ভাটারা থানায় মামলা করেছেন। এতে পারভীন আক্তার ও তাঁর কানাডা প্রবাসী স্বামী নাজমুল হাসান বাবুকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া আসামি করা হয়েছে মাটি প্রপার্টিজের মালিক ও কর্মচারীকেও।

সাফরিজা আক্তার রেলি জানান, পারভীনের সঙ্গে তাঁর ভাইয়ের বিয়ের বিষয় তারা জানতেন না। লাশ উদ্ধারের পর বিয়ের হলফনামা দেখে তারা বিয়ের কথা জানতে পারেন। তবে মে মাসের শুরু থেকে পারভীন তাঁকে ও তাঁর ভাইকে ফোন করে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিলেন।

সাফরিজা বলেন, ‘পারভীন আমাকে একাধিক দিন ফোন করে গালমন্দ দিয়েছে। আরিফুল নাকি তার জীবন নষ্ট করে দিয়েছে। এ জন্য আরিফুলসহ পরিবারের সবাইকে সে দেখে নেবে। পারভীনের স্বামী বাবুও ফোনে হুমকি দিয়েছে। পরিকল্পিতভাবে পারভীন আমার ভাইকে জাপান থেকে দেশে এনে হত্যা করে কানাডায় পালিয়েছে।’

আরিফুলের স্বজন জানান, আরিফুল রাজধানীর বিজয়নগরে একটি আবাসিক হোটেলে চাকরি করতেন। চাকরি করার সময় জাপানি তরুণী নাচুকির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে প্রেমের সম্পর্ক হয় তাদের। এক বছর আগে আরিফুল চাকরি ছেড়ে জাপান চলে যান। সেখানে জাপানি তরুণী নাচুকিকে বিয়ে করেন তিনি। নাচুকির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় আয়েশা।

পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, আরিফুল ঢাকায় আরও কয়েকজন তরুণীকে ফাঁদে ফেলেছেন– এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের কয়েকজনের অন্তরঙ্গ ভিডিও তাঁর হাতে ছিল।

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত