ভালুকার বিভিন্ন গ্রামে আঁখের আবাদ করে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা পেয়েছেন হাজারো কৃষক। প্রতি মৌসুমে ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকার আঁখ রপ্তানী হয় ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
ভালুকার কৃষকরা নব উদ্যমে শুরু করেছেন অধিক উৎপাদনশীল অর্থকরী ফসল আঁখের আবাদ। অন্যান্য ফসলের চেয়ে অল্প জমিতে অধিক উৎপাদন ও বেশী মুনাফা পাওয়ায় আঁখ চাষে কৃষকদের আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
নিম্নবিত্ত স্বল্প জমির চাষীরা আঁখ চাষ করে কয়েক বছরেই তাদের অবস্থার পরিবর্তণ ঘটিয়ে পরিবারে স্বচ্ছলতা এনেছেন। এ অঞ্চলে এক সময় দরিদ্র কৃষকরা ছনের ছাউনি মাটির ঘরে ছেলে মেয়ে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। ওইসব চাষীরা বছরের পর বছর আঁখের আবাদ করে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হয়ে টিনশেড হাফবিল্ডিং বাড়ী বানিয়ে বসবাস করছেন।
ভালুকায় আঁখ চাষে স্বচ্ছলতা পাওয়ায় অগনিত কৃষকের ছেলে মেয়ে স্কুল কলেজে শিক্ষা লাভের সুযোগ পেয়েছে বলে অনেকে জানায়। এখন আর তারা এক ইঞ্চি জমিও পতিত ফেলে রাখেননা।
ভালুকার মল্লিকবাড়ী গ্রামের জয়নাল আবেদীন এক সময়ের ফেলে রাখা চালা পতিত জমিতে আঁখ আবাদ করে ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন। জয়নালের মত আঁখ চাষ করে সফলতা পেয়েছেন ভালুকার বিভিন্ন গ্রামের কয়েক হাজার আঁখ চাষী।
সরজমিন কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায় এখানে ওখানে ক্ষেত জুড়ে আইলে আইলে সাড়ি সাড়ি ১০/১২ ফুট উঁচু আঁখের মাথায় কাঁচা শুকনা লম্বা পাতায় বাতাস লেগে মড় মড় শব্দ হচ্ছে।
মল্লিকবাড়ী গ্রামের কৃষক জয়নাল আবেদীন জানান তিনি নিজ গ্রামে বাড়ী সংলগ্ন ৪ একর জমিতে অমৃত জাত আঁখের আবাদ করেছেন। ২৫/৩০টি করে আঁখের গাছ এক সাথে করে বেঁধে দেয়া হয়েছে যাতে ঝড় বাতাশে হেলে পরে নষ্ট না হয়।
তার আবাদকরা ক্ষেতে গেলে দাঁড়িয়ে থাকা আঁখ দেখে পা যেন আপনিতেই থেমে যায়। অমৃত জাতের আঁখ আকৃতিতে লম্বা, বেশী ফলন প্রচুর রস ও মিষ্টি হয়ে থাকে। ফলে এর চাহিদা বেশী হওয়ায় ক্ষেত হতে পাইকার এসে কিনে নিয়ে যায়।
তিনি জানান জমি চাষ,চারা রোপন, সার, সেচ, কীটনাশক ও শ্রমিক বাবদ ৪ একর জমিতে ৫ লাখ টাকার মত খরচ করেছেন। ৪ একর জমির আঁখ ক্ষেতে থাকা অবস্থায় ঢাকার এক মহাজনের কাছে ১১ লাখ টাকা বিক্রি করে ৩ লাখ টাকা অগ্রিম নিয়েছেন। মহাজন ক্ষেত থেকে আঁখ কেটে নেয়ার সময় বাকি ৮ লাখ টাকা বুঝিয়ে দিবেন। এ বছর খরচ বাদ দিয়ে তিনি ৬ লাখ টাকা মুনাফা পাবেন বলে আশা করছেন।
প্রায় ১০ বছর যাবৎ আঁখের আবাদ করে সংসার খরচ চালিয়ে পৈত্রিক জমি বাদে নিজে ১০ কাঠা জমি ক্রয় করেছেন। গত বছর এ জমি হতে তিনি ১১ লাখ টাকার উপরে আঁখ বিক্রি করেছিলেন।
তিনি জানান প্রতি বছর ফাল্গুন চৈত্র মাসে জমি চাষ করে শুকনো মসৃন ধুলো মাটিতে আইল করে লাইনে নির্দিষ্ট দুরত্বে আঁখের চারা রোপন করতে হয়। আস্তে আস্তে চারা বড় হতে শুর করলে বেড়ে যায় পরিচর্যার মাত্রা। সময় মত সার, সেচ দিয়ে পরিচর্যা করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। আঁখের ফলন পেতে এক বছর সময় লাগে তার পরও অন্যান্য ফসলের চেয়ে দ্বিগুনের বেশী লাভ পাওয়া যায়।
আঁখ ও সবজি চাষ করে সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা এনেছেন জয়নালের মত এলাকার শত শত কৃষক। ওই গ্রামের কৃষক আবুল কালাম জানান তারা ৪ ভাই মিলে ২ একর জমিতে আঁখের আবাদ করেছেন। তারা পৈত্রিক সূত্রে প্রায় ৪০ বছর যাবৎ আঁখের আবাদ করে আসছেন। একই গ্রামের মন মোহন সরকার ১২ কাঠা, রাজু বেপারী ১০ কাঠা, রফিকুল ১৪ কাঠা জমিতে আঁখের আবাদ করেছেন।
চাষীরা জানায় শুধু মল্লিকবাড়ী, নয়নপুর ও সোনাখালী গ্রামেই ১৫ শর মত আঁখ চাষী রয়েছে। উপজেলার মল্লিকবাড়ী, নয়নপুর, চাঁনপুর, সোনাখালী, পাঁচগাঁও ,কাতলামারী, পাড়াগাঁও, কাদিগড় আঙ্গারগাড়া, তালাব, গাদুমিয়া. কামারিয়াচালা, বাটাজোর, তামাট এলাকায় প্রচুর আঁখের আবাদ হয়েছে।
স্থানীয়ভাবে স্যালু চালিত কলে আঁখের রস ছাড়িয়ে জ্বাল করে চাকা বা পাটা গুড় তৈরী করেন চাষীরা। বাজারে যার যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। মৌসুমের শুরুতেই গুড়ের চাহিদা বেশী থাকায় অনেকে আঁখ মাড়াই করে পাটালীগুড় তৈরী করে বেশী মুনাফায় বিক্রি করেন।
প্রতি কাঠায় ৩ থেকে ৪ ছেও অর্থাৎ ৮ মণ গুড় উৎপাদন হয় যা প্রতি মণ গুড় ২৫০০ টাকা হিসাবে ৮ মণ গুড় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বিক্রি আসে। অথচ এক কাঠা উঁচু জমিতে ধান পাওয়া যায় মাত্র ৩ থেকে ৪ মণ যার মূল্য আসে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা মাত্র।
আঁখের আবাদে মুনাফা দ্বিগুণেরও বেশী। চাষীরা জানান বাপ দাদার আমল হতে তারা আঁখের আবাদ করে অনেকেই স্বচ্ছল জীবন যাপন করছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আঁখ চাষ কৃষকের জন্য খুবই লাভ জনক।
চাষীদের অভিযোগ চড়া সুদে স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে তারা চাষাবাদ করে থাকেন। তাদের অর্জিত লাভের মোটা অংশ চলে যায় সুদের টাকা পরিশোধ করতে। তাছাড়া ফসল পরিচর্যায় কৃষি বিভাগের পরামর্শ পেলে ভাল হয়।
রোপন মৌসুমে ন্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ, সরকারী প্রনোদনা ও কৃষি বিভাগের সহযোগিতা পেলে আগামীতে ভালুকায় চাষীরা আঁখ চাষে আরও বিস্তার ঘটিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দৃষ্টান্ত স্থাপনে সক্ষম হবেন বলে তাদের দাবী।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নুসরাত জামান জানান এ বছর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে মোট ১৪ শ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের আঁখের আবাদ হয়েছে। আঁখ চাষে সরকারী প্রনোদনা না থাকলেও কৃষি বিভাগের আওতায় বেশ কয়েকটি প্রদর্শণী প্লট রয়েছে। তাছাড়া মাঠ পর্যায়ে আঁখ চাষীদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
ওই এলাকার একজন আঁখ ব্যবসায়ী জানান ভালুকার বিভিন্ন গ্রামে প্রচুর আঁখ চাষ হয় প্রতি বছর এ অঞ্চল হতে ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ৩৫ থেকে ৪০ কোটি টাকার আঁখ ও পাটাগুড় রপ্তানী হয়।