শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫ ২৮ আষাঢ় ১৪৩২
শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫
নেত্রকোনায় বেশিরভাগ সয়াবিন তেলে ভেজাল, তেল খেয়ে অসুস্থ হচ্ছেন অনেকেই
সোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা
প্রকাশ: শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:১৪ PM আপডেট: ১৭.০৯.২০২২ ১২:২১ PM

নেত্রকোনার বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করা ৫১টি খাদ্যপণ্যের ৬৪০টি নমুনা জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের গবেষণাগারে পরীক্ষা করে ৩০টি পণ্যের ১৮৩টি নমুনাতেই ভেজাল তেলের গন্ধ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে জেলা শহরের বেশ কয়েকটি মিষ্টির দোকানে যতগুলো নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে, তার সব কটিতেই ভেজাল মিলেছে। সয়াবিন তেলে ভেজাল পাওয়া গেছে শতকরা বেশিরভাগ আর সরিষার তেলে ভেজাল মিলেছে শতকরা ৫২ ভাগ।

ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় প্রায়ই অভিযান চালায়। জব্দ হয় বিভিন্ন ভেজাল পণ্যসামগ্রী, মামলা হয় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে, জরিমানা আদায় হয়, সাজাও হয়। এত কিছুর পরও থামছে না ভেজাল খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন ও বিক্রি। শুধু নেত্রকোনাতেই নয়, দিন দিন ভেজাল খাদ্যদ্রব্য ছড়িয়ে পড়েছে জেলার গ্রামগঞ্জে; যা বড় ধরনের হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। আসল বা ভেজাল চেনার কোনো উপায় না থাকায় মানুষ প্রতিনিয়ত ঠকছে আর চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, খাদ্যে ভেজালের কারণে দেশে নিত্যনতুন রোগের প্রকোপ বাড়ছে। মানুষের রোগশোক লেগেই থাকছে। ভেজাল হিসেবে নানা বিষাক্ত ও ক্ষতিকর উপাদান বিভিন্ন খাদ্য হয়ে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। এমন কোনো পরিবার পাওয়া যাবে না যারা খাদ্যে ভেজালের কারণে ভুক্তভোগী হয়নি। আর এ সংকট উত্তরণের একমাত্র পথ খাদ্যে ভেজাল রোধে অভিযান অব্যাহত রাখা।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, খাদ্যে ভেজাল শুধু নেত্রকোনা শহরেই নয়, সারা জেলায় ছড়িয়ে আছে। আমরা আমাদের পরীক্ষায় এর প্রমাণ পাচ্ছি প্রতিনিয়ত।ভেজাল খাদ্য মানুষের জন্য খুবই ক্ষতিকর। বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যের সঙ্গে নানা বিষাক্ত রং, রাসায়নিক কিংবা অখাদ্য উপাদান মেশানো হয়। পরীক্ষাগারে দেখা গেছে, তেলের রং কখনো স্বচ্ছ বা গাঢ় করা অথবা ঝাঁজ বাড়ানোর জন্য বিশেষ ধরনের রং ও রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আবার হলুদ-মরিচের গুঁড়ায় এখনো ইটের গুঁড়া জাতীয় উপাদান মেশানো হয়। মিষ্টিতেও নানা রাসায়নিক ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যার সবটাই জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

জেলা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি বছরের আগষ্টে সারা জেলা থেকে ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয় ৫১টি খাদ্যপণ্যের ৭৪০টি নমুনা। এর মধ্যে পরীক্ষাযোগ্য নমুনা ছিল ৬৪০টি। নির্দিষ্ট গাইডলাইন অনুসারে পরীক্ষার পর ৩০টি পণ্যের ১৮৩টি নমুনার মধ্যে ভেজাল পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে সয়াবিন তেলের ২৮টি নমুনার মধ্যে ২১টি ভেজাল ও সাতটি খাঁটি পাওয়া গেছে। একইভাবে সরিষার তেলের ৫৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর ২৯টি নমুনায় ভেজাল ও ২৬টিতে খাঁটি তেল পাওয়া গেছে। অন্যদিকে ল্যাবে আসা মিষ্টির ৩২টি নমুনার সব কটিতেই পাওয়া গেছে ভেজাল।

এ ছাড়া অন্যান্য পণ্যের মধ্যে লবণের ১৭টি নমুনায় ভেজাল ও ৫৭টিতে খাঁটি, হলুদের গুঁড়ার ১১টিতে ভেজাল ও ৫০টিতে খাঁটি, মধুর দুটিতে ভেজাল ও দুটিতে খাঁটি, গুড়ের ছয়টিতে ভেজাল ও ৯টিতে খাঁটি, বিস্কুটের ১০টি নমুনায় ভেজাল ও ৪৩টিতে খাঁটি, পাঁচটি ডালের নমুনায় ভেজাল ও ৪৯টিতে খাঁটি, সেমাইয়ের দুটি নমুনায় ভেজাল ও একটিতে খাঁটি, দুটি জেলির দুটিতেই ভেজাল পাওয়া যায়। একইভাবে একটি ঘির নমুনায় একটিতেই ভেজাল মিলেছে, ডালডার দুটি নমুনার একটিতে ভেজাল ও একটিতে খাঁটি পাওয়া যায়।

এ ছাড়া একই ল্যাবে চলতি বছরের জুনে পরীক্ষা করা খাদ্যপণ্যের ৭২৭টি নমুনার মধ্যে ২২১টিতে ভেজাল পাওয়া যায়।

ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথের পাবলিক অ্যানালিস্ট কর্মকর্তা বলেন, প্রতিদিনই সারা জেলার স্যানিটারি ইন্সপেক্টররা বিভিন্ন হাট-বাজার থেকে বিভিন্ন পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে তা জেলায় পাঠিয়ে দেন। এসব নমুনার ভেতরে যেসব উপাদান থাকা প্রয়োজন তা কমবেশি তাৎক্ষণিকভাবেই শনাক্ত করা হয়। আবার অনেক নমুনা প্রয়োজন অনুসারে ফুড সেফটি ল্যাবে পাঠানো হয়। মিষ্টিতে যে পরিমাণ ফ্যাট থাকার কথা অনেক সময় আমরা এর চেয়ে কম বা বেশি পেয়ে থাকি। এ ক্ষেত্রে বোঝা যায়, ওই মিষ্টিতে দুধের উপস্থিতি কম অথবা দুধের পরিবর্তে অন্য কিছু ব্যবহার করা হয়েছে। একইভাবে তেলের ক্ষেত্রে সাধারণত ফ্যাটি এসিড সঠিক মাত্রায় না থাকলেই এটা ভেজাল বলে ধার্য হয়। তবে কোনো নমুনায় রাসায়নিক কোনো মিশ্রণ আছে কি না তা পরীক্ষা করা হয় ফুড সেফটি ল্যাবে।

এর আগে ২০১৪ সালে জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের আওতায় জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণাগারে দেশি-বিদেশি একদল গবেষক ৮২টি খাদ্যপণ্য নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মহাখালী, গুলশান এলাকাসহ আরো বেশ কিছু বড় মার্কেট থেকে এসব খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এতে গড়ে ৪০ শতাংশ খাদ্যেই মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৩ থেকে ২০ গুণ বেশি বিষাক্ত উপাদান শনাক্ত হয়। এসব খাদ্যে নিষিদ্ধ ডিডিটি থেকে শুরু করে রয়েছে কার্বামেড, কার্বাইড, অ্যালড্রিন, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, সিসা, ফরমালিনসহ আরো বেশ কিছু রাসায়নিক-ধাতব মিশ্রণের উপস্থিতি।

ওই গবেষণায় বিশেষ করে ৩৫ শতাংশ ফল ও ৫০ শতাংশ শাকসবজির নমুনায় বিষাক্ত বিভিন্ন কীটনাশকের উপস্থিতি শনাক্ত হয়। আর আম ও মাছের ৬৬টি স্যাম্পলে পাওয়া গেছে ফরমালিন। চালের ১৩টি স্যাম্পলে মিলেছে মাত্রাতিরিক্ত বিষক্রিয়াসম্পন্ন আর্সেনিক। পাঁচটি স্যাম্পলে পাওয়া গেছে ক্রোমিয়াম। ৩০টি হলুদের গুঁড়ার স্যাম্পলে ছিল সিসাসহ বিভিন্ন ধাতব। লবণেও সহনীয় মাত্রার চেয়ে ২০-৫০ গুণ বেশি ক্ষতিকারক উপাদান পাওয়া গেছে। মুরগির মাংস ও মাছে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এ ছাড়া প্যাকেটজাত জুসে পাওয়া গেছে বেনজোয়িক এসিড। এ ছাড়া ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানের ল্যাবে পরীক্ষা করে মিষ্টি, রসগোল্লা, ছানা, ছানার সন্দেশ, ছানার মিষ্টি, আচার, চমচম ও মধুর শতভাগ নমুনায় ভেজাল মিলেছিল। আবার ৭৮ শতাংশ সয়াবিন তেল, ৪৬ শতাংশ সরিষার তেল, ৯৩ শতাংশ ঘি, ৯২ শতাংশ ডালডায় ভেজাল ছিল।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহামুদুর রহমান এই প্রতিনিধিকে বলেন, খাদ্যে ভেজাল রোধে জনসচেতনতা খুবই জরুরি। খাদ্যের ভেজাল থেকে নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে মারাত্মকভাবে।

ময়মনসিংহ বিভাগীয় জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বলেন, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর,ও ময়মনসিংহ বিভাগীয় শহর থেকে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষার পর যেগুলোতে ভেজাল পাওয়া যায় সেগুলো চিহ্নিত করে স্ব-স্ব স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের কাছে পাঠানো হয়। এরপর ওই ইন্সপেক্টররা বিধি অনুসারে ওই নমুনা যে দোকান থেকে সংগ্রহ করেছেন সেই দোকানদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন। আর ময়মনসিংহ বিভাগ থেকে প্রতি মাসের প্রতিবেদন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও নতুন চালু হওয়া নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সভায় উপস্থাপন করা হয়। আবার অনেক সময় কর্তৃপক্ষ থেকেও আমাদের কাছে নানা তথ্য চাওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ আরো সুসংগঠিত ও শক্তিশালী হিসেবে কার্যকর হওয়ার পর ভেজালের বিরুদ্ধে আরো দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।

বাবু/এসএম
« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত