গলাচিপা উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নে সিদ্দিক প্যাদার বসত। জীবিকার তাগিদে পার্শ্ববর্তী উপজেলা রাঙ্গাবালীর বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের ‘এফ বি সুজন’ নামের ট্রলারে জেলে হয়ে কাজ করতো। সিদ্দিকের উপর্জনের টাকায় চলত সংসার। চলতি বছরের (০৯ আগস্ট) উত্তাল সাগরে ১২ জন মাঝিমাল্লাসহ ডুবে যায় এফ বি সুজন নামের ট্রলারটি। ট্রলার ডুবির আধা ঘন্টা পরে অন্য ট্রলারের সহায়তায় ডুবে যাওয়া ট্রলারের ১১ জন জেলে জীবিত উদ্ধার হলেও সন্ধান মেলেনি সিদ্দিকের।
উত্তাল বঙ্গোপসাগরে নিখোঁজ ওই জেলেকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেনি কেউ। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন তিনি। বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে সে খবরও অজানা পরিবারের কাছে। আবহাওয়া খারাপ হলেই সিদ্দিকের স্ত্রী-সন্তানদের অশ্রুশিক্ত নয়ন, দেখার যেনো কেউ নেই। এ নির্মম চিত্র শুধু জেলে সিদ্দিক প্যাদার পরিবারে নয়। রয়েছে উপকূলীয় পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলায়। ট্রলার ডুবিতে নিখোঁজ এবং মৃত জেলেদের পরিবার বলছে, সাগরের ট্রলারে পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট ও বয়া নেই। উত্তাল সাগরে যেটি দ্বারা ভেসে ভেসে অন্তত নিজেকে জীবিত রাখবে। অর্থ সংকট নাকি অবহেলা করে নিরাপত্তা সরঞ্জাম দিচ্ছে না ট্রলার মহজনরা। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের তদারকি জোরদার করার দাবি জানান।
মৎস্য সংশ্লিষ্টরা বলেন, সুরক্ষাসরঞ্জাম হিসেবে, লাইফ জ্যাকেট-বয়া। সংকেত জানার জন্য রেডিও। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ফার্স্টএইড বক্স এবং যোগাযোগের জন্য জেলে ট্রলারগুলোতে মুঠোফোন সংরক্ষণে থাকার কথা রয়েছে। অথচ মুঠোফোন ছাড়া সুরক্ষাসরঞ্জামের কিছুই নেই অধিকাংশ ট্রলারে। এছাড়াও সাগরে যে সব জেলেরা মাছ শিকারে যায় তাদের অনেকেরই একাডেমিক শিক্ষা নেই। এতে করে একেক সময়ের ঝড় যাপটায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব জেলেদের মাঝে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবার ব্যবহার এবং দুর্যোগ মোকাবেলায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একদিকে নিষেধাজ্ঞা অপরদিকে বৈরী আবহাওয়ায় উত্তাল থাকে সাগর। এই দুইয়ের চাপায় পিষ্টে গেছে জেলেরা। তার উপরে আবার এনজিওর ঋণ এবং স্থানীয় সুদী মহজনদের সুদের জ্বালা। যার ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও মাছ শিকারে যেতে হচ্ছে সাগরে। আবহাওয়া খারাপ হলে নিজস্ব ট্রলারে সংকেত জানার কোন ব্যবস্থা নেই। গভীর সাগরে মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। আশপাশে থাকা ট্রলিং অথবা লাল জালের জেলেরা হ্যান্ডমাইক দিয়ে সংকেতের খবর জানিয়ে দেয়। এছাড়াও ডাঙা থেকে সাগরে এলে আমরা ভেবে নেই এ যাত্রায় মৃত। জীবন ঝুঁকি নিয়ে মাছ শিকার করলেও আমাদের নিরাপত্তার কথা কেউ মাথায় রাখে না।
মৎস্য বিভাগের তথ্য বলছে, ঘুর্ণিঝড় ও বৈরী আবহাওয়ায় ২০১৬-২২ সাল পর্যন্ত ১৩টি ট্রলার ডুবির ঘটনা রয়েছে। এতে ১২ জন জেলে মারা যায়। স্থানীয় জেলেরা বলছেন- ট্রলার ডুবি, জেলে নিখোঁজ ও মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি। মৎস্য বিভাগ আরো জানায়, দেশের মৎস্য সম্পদের সুরক্ষা ও মাছের বংশবিস্তারে সাগরে মাছ ধরার ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। এরপরে নদ-নদী ও বঙ্গোপসাগরে ইলিশের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হবে ৭ অক্টোবর। শেষ হবে ২৮ অক্টোবর। এছাড়াও বাচ্চা ইলিশকে বড় হবার সুযোগ দেয়ার জন্য পয়েলা নভেম্বর থেকে শুরু হয় জাটকা অর্থাৎ বাচ্চা ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা। এই নিষেধাজ্ঞা চলে ২০২২ সালের ৩০শে জুন পর্যন্ত। এ উপজেলায় নিবন্ধিত জেলে রয়েছে ১২ হাজার ৮২০ জন। যারা সরকারি সুবিধাভোগী, অনিবন্ধিত জেলের সংখ্যা দ্বিগুন। যাদেরকে পর্যায়ক্রমে নিবন্ধিত করা হবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আনোয়ারুল হক বাবুল বলেন, ‘সংকেত সময়ে উপকূলীয় জেলেদের নিরাপদে অবস্থান করতে মাইকিং করা হয় মৎস্য ঘাটগুলোতে। সংকেত না জেনে যেসকল ট্রলার সাগরে থাকে ওইসকল জেলে ট্রলারের নিরাপত্তা এবং অবস্থান জানার জন্য ‘গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম’ (জিপিএস) প্রদান করা হবে। যার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
বাবু/জাহিদ