দিনে-রাতে লোকারণ্য। সামনে থেকে দেখলে মনে হবে মেলা বসেছে। সময়ের সাথে বাড়-কমে ভাসমান মানুষের সংখ্যা। এ চিত্র আখাউড়ায় গড়ে উঠা অসংখ্য মাদক আস্তানার। যেখানে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে বিভিন্ন জাতের মাদক বিক্রি। কিশোরদেরও দেখা যায় এই ভীড়ে। জানাগেছে এইসব আস্তানায় স্কফ, ফেন্সিডিল, গাঁজা ও ইয়াবা বেচাবিক্রি হয় দেদারছে।
মাদক কিনতে আসে বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষ। অনেকে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে মাদক সেবন করে। সাধারণ লোকজন থাকেন আতঙ্কে। মাদকব্যবসায়ীদের দাপটে অসহায় এখানকার সাধারণ মানুষ।মাদকে ভাসছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া।
অনুসন্ধানে জানা যায় প্রশাসনের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারি মাদক কারবারিদের সঙ্গে যোগসাজশে আখাউড়াকে বানিয়েছে মাদকের স্বর্গরাজ্য। মাঝেমধ্যে পুলিশ লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে দু-চারজনকে গ্রেপ্তার করলেও মূল হোতা,পৃষ্ঠপোষক এবং সরবরাহকারীরা থাকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। প্রশাসনের একটি অংশ ও রাজনীতিকদের ছত্রছায়ায় শহরময় চষে বেড়ায় এ কারবারীরা।
মাদকের বিরুদ্ধে কথা বলে কেউ টিকে থাকতে পারে না। হামলা-মামলাসহ চলে নানা নির্যাতন। সীমান্তের ওপার থেকে আসা মাদকের ছিটেফোঁটা ধরা পড়লেও রাঘব বোয়ালরা থেকে যায় অন্তরালেই।ফলে, দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে এখানকার মাদক ব্যবসায়ীরা। কয়েক’শ মাদক ব্যবসায়ীর কাছে জিম্মি এই উপজেলার মানুষ।
তারা ধরণ বদলেছে ব্যবসার। নতুন স্টাইলে চলছে বিকিকিনি। মাদক বহন ও বিক্রিতে ব্যবহার হচ্ছে শিশু-কিশোররা। উপজেলার মনিয়ন্দ ইউপির জয়পুর মুড়া, পাথার টেক, নয়মুড়া, মাঝিগাছা, শিবনগর, খারকোট, ইটনা ঘাগুটিয়া, মোগড়া ইউপির বাউতলা, উমেদপুর, রাজেন্দ্রপুর, জয়নগর, ছয়ঘরিয়া,খলাপাড়া, উত্তর ইউপির আনোয়ারপুর, আজমপুর, রাজাপুর চানপুর দক্ষিণ ইউপির হীরাপুর, কালিকাপুর, সাহেবনগর, আব্দুল্লাহপুর, ছোট কুড়িপাইকা, নুরপুর, পৌরসভার দূর্গাপুর, তারাগন, খরমপুর, মসজিদ পাড়া ও দেবগ্রাম এলাকায় জমজমাট ‘মাদক মাফিয়া’দের কারবার। এসব এলাকায় মাদকের মহাসমারোহ চললেও থানা পুলিশ শুধু মাদক নির্মূলের ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত।
আস্তানায় বিক্রি ছাড়াও চায়ের দোকানে ও বাড়িতে মাদক পৌঁছে দেয়া হয়। ফেসবুক ম্যাসেন্জার ও হোয়াসট অ্যাপে অর্ডার করে লোকেশন দিলে জায়গামত পৌঁছে যায় ইয়াবা, ফেনসিডিল ও স্কফ। মুঠোফোনে কল দিলে ইজিবাইক ও মোটরসাইকেল যোগেও পৌঁছে দেয়া হয়।
মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে চিন্হিত মাদক মাফিয়ারা। নিষিদ্ধ এ কারবারে জড়ানোর নাম এসেছে কয়েক জন ইউপি সদস্যেরও। তারা হলেন মনিয়ন্দ ইউনিয়নের দুইজন সদস্য এবং একই ইউনিয়নের ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের দুই সভাপতি। উত্তর ইউনিয়নের একজন ইউপি সদস্য তার ছেলেকে দিয়ে এ কারবার করান বলে তথ্য রয়েছে। নিষিদ্ধ ব্যবসার উপর সামাজিক চাপ ঠেকাতে চালানো হচ্ছে নতুন কৌশল। কমিশন দিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে স্থানীয় নেতাদের। দাপট নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে কিশোর গ্যাং গড়ে তুলেছে মাদক কারবারীরা। মাদকাসক্ত ও উঠতি কিশোরদের বাহিনীতে ভিড়িয়ে নির্বিঘে ব্যবসা চালানো হচ্ছে। এর সুবাদে বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, মাদক ব্যবসায়ীরা সীমান্তের ওপারে ক্রয়কৃত মাদকের মূল্য পরিশোধ করেন এপারে আর এর সাথে জড়িত আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের এক ইউপি সদস্য ও পৌর শহরের কয়েকজন স্বর্ণ(জুয়েলারি) ব্যবসায়ী। নাম না প্রকাশ করার শর্তে বেশ কিছু মাদক কারবারি সাথে কথা বলে জানা যায় পুলিশকে ম্যানেজ করেই তারা ব্যবসা করে থাকেন। এজন্য তাদের প্রতি মাসে বিশাল অঙ্কের টাকা পুলিশের হাতে তুলে দিতে হয়। মাসোহারা না দিলেই পুলিশ গ্রেপ্তার বাণিজ্য শুরু করে বলেও জানান তারা।
এ ব্যপারে জানতে চাইলে কসবা আখাউড়া পুলিশ সার্কেলের সহকারি পুলিশ সুপার মোঃ কামরুল ইসলাম বলেন কসবা ও আখাউড়া ভারত সীমান্তবতী দুটি থানা। সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়াতে কসবা এবং আখাউড়ার কিছু বহিরাগত লোক মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত আছে। আমরা চেষ্টা করছি যারা বড় মাপের সাপ্লাইয়ার অথবা ব্যবসায়ী তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি।
আখাউড়া উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪টি ইউনিয়ন হচ্ছে সীমান্তবর্তী এলাকায়। এখানে কিছু মাদক ব্যবসায়ী আছে। কেউ কেউ আবার রাজনীতির সাথে জড়িত। তারা বিভিন্ন কৌশলে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
মাদকের সাথে পুলিশের জড়িত থাকার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাদকের সাথে যদি কোন পুলিশ সদস্য আপোষ করে বা জড়িত হয়, যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাই এবং তদন্তে প্রমানিত হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করব। ইতোমধ্যে অনেকে মাদকের সাথে জড়িয়ে চাকরীচ্যুত হয়েছে এমন নজির কিন্তু অহরহ আছে।
-বাবু/এ.এস