হাসিনা এবং তার দোসররা যে অপরাধ বাংলাদেশে করেছে, সেরকম জঘন্য অপরাধ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীও করেনি। এমন মন্তব্য করেছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল।
তিনি বলেন, মরদেহ পুড়িয়ে ফেলা, আহত মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলা, আনআর্মস (নিরস্ত্র) আহত মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলা- এগুলো যুদ্ধাপরাধ।
আজ মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনিস্টিটিউটের মিলনায়তনে ‘জুলাই গণহত্যার বিচার, আলোচনা ও তথ্যচিত্র প্রদর্শন’ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।
আইন উপদেষ্টা বলেন, আপনারা বলতে পারেন, এরকম তো ২৫ মার্চ কালরাত্রে ঘটেছে। অবশ্যই, ২৫ মার্চের কালরাত্রে ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ওটা তো অন্য দেশের বাহিনী। আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছি, তারপর। মানে আপনি যদি পারসপেক্টিভ দেখেন, পারসপেক্টিভ ওয়াজ ডিফারেন্ট। ৭১ সালে ডেডবডি পুড়িয়ে ফেলেছে, এরকম কোনো ফুটেজ আমি দেখিনি; একজন গুলি খেয়েছে, তাকে ধরে পিছু নিয়ে যাচ্ছে তার বন্ধু, সে অবস্থায় গুলি করেছে—এরকম কোনো ফুটেজ, কোনো বর্ণনা আমি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাইনি। অন্যরকম নৃশংসতা থাকতে পারে, কিন্তু এরকম নৃশংসতার গল্প পাইনি।
আসিফ নজরুল বলেন, আপনারা বিভিন্ন প্রত্যাশার কথা, বেদনার কথা বলেন। মাঝে মাঝে একটু দুঃখ লাগে। আজকে তাজুল (চিফ প্রসিকিউটর) কিছু কথা বলল যে আমরা কীভাবে কাজ করি। আমি আপনাদের বলতে পারি, তাজুল কীভাবে কাজ করে। তাজুল রাত ২টা পর্যন্ত কাজ করে, একটা নতুন কিছু হলে চকচকে চেহারা করে আইন মন্ত্রণালয়ে দৌড়ে আসে, বলে স্যার ওরকম একটা এভিডেন্স পেয়েছি। এই যে ইমোশন, এই যে পরিশ্রম, এই যে কষ্ট এই পুরা টিম করছে- আমরা লেগে আছি।
আসিফ নজরুল ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলেন, তাজুলের সঙ্গে দেখা হলে প্রথম কথা, আমরা নিজের কাছে নিজে মুখ দেখাতে পারব না, আল্লাহর কাছে জবাব দিতে পারব না। বারবার একটা কথাই বলি, বিচার কত ভালোভাবে করা যায়, কতটুকু করা যায়। তারপরও অনেক অভিযোগ শুনি, অনেক কিছু শুনি, খুব দুঃখ লাগে মাঝে মাঝে।
আইন উপদেষ্টা বলেন, এটার জন্যই তো আমাদের সন্তানরা প্রাণ দিয়েছিল। আপনারা আমাদের প্রশ্ন করবেন, সমালোচনা করবেন; কষ্ট লাগলেও শুনব, আবার রিফোকাস করব। কিন্তু আপনাদের একটা জিনিস বলতে চাই, আমি একজন রিলিজিয়াস মানুষ, আমি যখন নামাজ পড়ি বা যখন আমি এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছি, সবসময় বলি আমি যেন আল্লাহর কাছে জবাব দিতে পারি। আমি যখন জায়নামাজে যাই, দোয়া পড়ি, তখন মনে হয় আল্লাহ তো আমাকে দেখছে। আমি কি আল্লাহর কাছে জবাব দিতে পারব?উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর আপনাদের কনফিডেন্টলি বলে যাই, ওপরে আল্লাহ আছে, অবশ্যই পারব।
আসিফ নজরুল বলেন, আমি একজন খুব ইমোশনাল মানুষ, আমি একজন লেখক। আমি যখন এই গণঅভ্যুত্থানকালে ছিলাম, আমি কল্পনা করতে পারিনি এরকম এইরকম বর্বরতা হয়েছে। শুনতাম, আবু সাঈদের মৃত্যুটা দেখেছি। তার চেয়ে ভয়াবহ দৃশ্য পরে দেখেছি; আপনারা দেখেছেন, লাশ জ্বালিয়ে দিচ্ছে। একটা ছেলেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তার বন্ধু, সে মরে যাচ্ছে মনে হচ্ছে, তারপরও তাকে গুলি করছে।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, এসব দৃশ্য দেখলে, যতবার দেখি, যতবার দেখি মাথায় আগুন চেপে যায়, আর চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে। আমি আন্তর্জাতিক আইন পড়েছি ল’য়ের স্টুডেন্ট হিসেবে। যুদ্ধক্ষেত্রে আপনার শত্রু যদি আনআর্মস থাকে, তার হাতে যদি কিছু না থাকে, যুদ্ধক্ষেত্রে আপনি তাকে গুলি করতে এলাউড না। গুলি করলে আপনি যুদ্ধাপরাধ করবেন। যুদ্ধক্ষেত্রে যদি একজন গুলি খেয়ে আহত হয়ে পড়ে থাকে, তারপর আপনি তাকে গুলি করতে এলাউড না। কারণ এটা যুদ্ধাপরাধ। যুদ্ধের ময়দানে আপনি আহত লোককে যদি চিকিৎসা না দেন, সেটা যুদ্ধাপরাধ। যুদ্ধের ময়দানে আপনি যদি ডেডবডি পুড়িয়ে ফেলেন, এটা যুদ্ধাপরাধ।
‘আমরা তো মানুষ। এই বিচারের সঙ্গে যারা ইনভলভ আছে, আমরা বেছে বেছে মানুষগুলোকে ঠিক করেছি। আমি তাজুলকে চিনতাম না। তাজুলকে যখন ঠিক করা হয়, চিফ প্রসিকিউটর করা হয়, অনেক মানুষ আমাকে বলেছে তাজুলকে কেন দিচ্ছেন, কন্ট্রোভার্সি হবে। কীসের কন্ট্রোভার্সি? আমার দরকার এরকম ল’য়ার, যাকে ১০০০ কোটি টাকায় কিনতে পারবে না। সরি, অনেক বড় বড় ল’য়ার আছে, আমার এ আস্থা নাই তাদের প্রতি। ১০০০ কোটি টাকা দিয়ে কিনতে পারবে নাকি বা পারবে না এটা শতভাগ আস্থা নাই। তাজুলের জন্য আছে। তাজুলের দক্ষতা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নাই। এই আইনে প্রসিকিউট করার ব্যাপারে তাজুলের সঙ্গে তুলনা হয়তো প্রয়াত ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বা দুই-একজন মানুষ হবে। আর কেউ পারবে না।’
আইন উপদেষ্টা বলেন, আপনারা আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখেন। আমার দায়িত্বে, আমাদের দায়িত্বে বিন্দুমাত্র অবহেলা করি না। আপনাদের প্রতি দায় না, এটা আল্লাহর প্রতি দায়, আমরা এভাবে দেখছি জিনিসটা। এরকম হত্যাকাণ্ডের বিচারের দায়িত্ব যারা পায়, তারা যদি বিচার না করে আল্লাহ তাদের বিচার করবে, এটা আমরা জানি।