দেশজুড়ে এখন প্রধান আলোচনার বিষয় আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে এ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। এই সপ্তাহে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার কথা আছে। এমন খবরে সারাদেশের মতো ভোটের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে নওগাঁতেও।
উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁয় সংসদীয় আসন ছয়টি। নওগাঁর এই ছয়টি আসনে বিএনপির একাধকি সম্ভাব্য প্রার্থী থাকলেও জামায়াতে ইসলামী ইতিমধ্যে ছয়টি আসনেই একক প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে।
বরেন্দ্র জনপদের তিন উপজেলা নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসন নওগাঁ-১। উপজেলাগুলো হলো ভারত সীমান্তবর্তী সাপাহার, পোরশা ও নিয়ামতপুর। আম উৎপাদনের ব্যাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে খ্যাতি রয়েছে এই তিন উপজেলার।
অতীতে এ আসনটি ভোটযুদ্ধে আওয়ামীলীগ এবং বিএনপির পালাবদল হয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগের দখলে থাকা আসনটি এবার পুনরোদ্ধারে মাঠে নেমেছে বিএনপি। তবে শুরু থেকেই আসনটিতে নিজেদের অবস্থান তৈরিতে তৎপর জামায়াত। এই আসনে বিএনপির একাধকি সম্ভাব্য প্রার্থী থাকলেও জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর একক প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
এই আসনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা আদিবাসী মানুষ বসবাস করে। অতীতের বিভিন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এসব ভোটাররা বেশ ফ্যাক্টর। এই আসনে কোনো প্রার্থীকে জিততে হলে এসব ভোটারদের কাছে টানতে হবে। এজন্য তাদের সমর্থন পেতে বেশ তৎপরতা দেখা গেছে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং জামায়াতকে। তাদের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। শুনছেন তাদের সুখ-দুংখের কথা। তবে এখনো অন্য কোনো দল তাদের প্রার্থী ঘোষণা বা তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীদের খুব একটা তৎপরতাও দেখা যায়নি।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এ আসনের বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছে- তিনবারের সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ও নিয়ামতপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ডা. ছালেক চৌধুরী, নিয়ামতপুর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান, পোরশা উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক লায়ন মাসুদ রানা, নিয়ামতপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি নুরুল ইসলাম, যুবদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য মাহমুদুস সালেহীন এবং পোরশা উপজেলা বিএনপির সভাপতি আহম্মেদ মোজাম্মেল হক শাহ্ চৌধুরী।
জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে জেলা কর্মপরিষদ সদস্য ও সাপাহার আল হেলাল ইসলামী একাডেমি এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মাহবুবুল আলম এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর নওগাঁ জেলা শাখা প্রধান উপদেষ্টা আলহাজ্ব হাফেজ হযরত মাওলানা আব্দুল হক শাহ্ চৌধুরীকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। তারাও নিয়মিত গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন।
নেতাকর্মীরা জানান, মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি জানান দিতে কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ শুরু করেছেন। তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন। রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয়তা বাড়িয়েছেন। এছাড়াও সাধারণ মানুষের মন জয় করতে গণসংযোগ ও কুশলবিনিময় করছে।
বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য ৩১ দফার যে রাষ্ট্র মেরামতের রুপরেখা দিয়েছেন তা জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে প্রতিদিনই হাটবাজার, গ্রাম, পাড়া-মহল্লায় গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করছি। এছাড়াও আমাদের এই আসনে যেসব আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ আছে তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুকে বুক মিলেয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছি। যাতে তারা শান্তিতে বসবাস করে। এছাড়াও বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিলো এই এলাকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য বেগম খালেদা জিয়া কাজ করেছেন। সেই সুফল তারা এখনো ভোগ করছেন এবং বিএনপিকে মনে রেখেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৩১দফা রাষ্ট্র মেরামতে আদিবাসীদের জীবন মানউন্নয়নের কথা তুলে ধরছি। তারাও সাড়া দিচ্ছেন। ১৭ বছর ধরে দলের আন্দোলন, সংগ্রামে রাজপথে আছি। সাধারন মানুষ আমার সাথে আছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়েছিলাম। আশা করি আগামীতেও পাব।
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী লায়ন মোঃ মাসুদ রানা বলেন, আমরা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য ৩১ দফার যে রাষ্ট্র মেরামতের রুপরেখা দিয়েছেন তা জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে প্রতিদিনই জনে-জনে, পাড়ায়-পাড়ায়, গ্রামে-গন্ঞ্জে, মাঠে-ময়দানে, হাটবাজারে গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করছি। আমি ৯০ দশকের ছাত্রদলের সোনালী যুগের ফসল হিসাবে ১৯৯২ সালে ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে সক্রিয় কর্মী এবং ২০০৬ সালের ১/১১ এর ক্রান্তিকালীন সময় হতে বিগত ১৭/১৮ বছর ধরে দলের সকল আন্দোলন, সংগ্রামে জনগণকে সাথে নিয়ে রাজপথে আছি এবং ২০১২ সালে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের করা নওগাঁ জেলার ১ম রাজনৈতিক মামলার ১নং আসামি এবং পরবর্তী সময়ে আরও ৫টি রাজনৈতিক মামলার আসামি ও বিভিন্ন নির্যাতন, হয়রানির শিকার হই। নওগাঁ-১ আসনের হিন্দু, মুসলিম ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সকল শ্রেণিপেশার সাধারণ মানুষ আমার সাথে আছে। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি’র প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছিলাম। আশা করি এবার ২০২৬ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ভোট করার সুযোগ পাবো ইনশাআল্লাহ। আল্লাহর রহমতে দল যদি আমাকে প্রতীক দিয়ে ভোট করার সুযোগ করে দেন সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে আসনটি উপহার দিতে পারব ইনশাআল্লাহ।
বিএনপির আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী মাহমুদুস সালেহীন বলেন, শুধু মনোনয়ন পাওয়ার আশায় নয়, মানুষের পাশে থাকার জন্য মাঠে কাজ করছি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন জনগণের সাথে থাকতে। জনগণই নেতা বানাবে। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী মাঠে কাজ করছি। জনগণও আমাকে সাড়া দিচ্ছে। কারণ বয়সে আমি যুবক। আমি যুবদল করে আসছি। সেই হিসেবে তরুণদের প্রায়োরিটি বেশি থাকছে। পাশাপাশি বয়োজ্যেষ্ঠরাও বলছে পরিবর্তন দরকার। কারণ স্বৈরাচার শেখ হাসিনা যেভাবে পালিয়েছে এরপর থেকেই দেশে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। সেই প্রেক্ষাপটে এইটুকু বলতে পারি জনগণও আমাকে সাদরে গ্রহণ করছে। এই অঞ্চলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি ও সাঁওতালদের বসবাস আছে। আমি তাদের কাছে গিয়ে কথা বলেছি তারাও বলছে বিগত সময়গুলোতে তাদেরকে থেকে শুধু ভোট নেওয়া হয়েছে। তাদের কাছে গিয়ে বসে তাদের কথাগুলো শোনা হয়নি। তারাও বলছেন কে কোন সম্প্রদায়ের মানুষ তা বিবেচনা না করেই, তাদের পাশে থেকে তাদের কথাগুলো শুনবে এমন মানুষকেই চায়।.
জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মাহবুবুল আলম বলেন, নিয়মিত গণসংযোগ ও প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছি। মানুষের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। গত ১৫ বছর মানুষ কোন ভোট দিতে পারেনি তারা এখন ভোট দিতে চায়। তারা জামায়াতের ইসলামীর ওপর ভরসা রাখতে চয়। শুধু তাই নয় এই এলাকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা আদিবাসী মানুষের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছি তারাও আমাদের ওপর ভরসা রাখতে চাচ্ছে। আমি আশাবাদী আল্লাহ চাইলে আমি জিতব।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর প্রার্থী আলহাজ্ব হাফেজ হযরত মাওলানা আব্দুল হক শাহ্ চৌধুরী বলেন, এবারের নির্বাচনে ভোটাররা প্রতীক এর পাশাপাশি ব্যক্তিত্বের বিষয়কেও গুরুত্ব দিবেন বলে আশা করছি। বিজয়ী হলে দুর্নীতিমুক্ত, উন্নয়নমুখী, যুববান্ধব ও ন্যায় ইনসাফের ভিত্তিতে সমাজ গড়ব।
জানা যায়, ১৯৯১ সালে বিএনপির প্রার্থীকে হারিয়ে এই আসনে জয় পায় আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ডা. ছালেক চৌধুরী আওয়ামীলীগের প্রার্থীকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনেও মনোনয়ন পেয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন তিনি। এরপর ২০০৮ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের কাছে পরাজিত হলে আসনটি হাতছাড়া হয় বিএনপির। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে পুনরায় আওয়ামী লীগ থেকে সাধন চন্দ্র মজুমদার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৮ ও ২০২৪ সালের একাদশ ও দ্বাদশ সংসদের দুটি বিতর্কিত নির্বাচনে নির্বাচিত হন সাধন চন্দ্র মজুমদার।
জেলা নির্বাচন অফিস সুত্রে জানা গেছে, সাপাহার, পোরশা, নিয়ামতপুর উপজেলা নিয়ে এই আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৫৬ হাজার ১৬৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ২৬ হাজার ৯২৫ ও মহিলা ভোটার ২ লাখ ২৯ হাজার ২৪১ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছে ৩ জন।