শিশুদের বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সিআইপিআরবি এই প্রতিপাদ্য কে সামনে রেখে বরিশাল জেলার বিভিন্ন উপজেলায় শিশুদের বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে সংস্থাটি। এবং শিশুদের নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন কর্মসূচি ইতিমধ্যেই সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
অক্টোবর ১৬, ২০২৫: আমরা বলতে পারি তালতলির রহিমা-মোফাজ্জল দম্পতি কথা। তারা তাদের ৫ টি সন্তানকে হারিয়েছেন অকালে, প্রতিরোধযোগ্য একটি কারণে- 'পানিতে ডুবে মৃত্যু'। বরিশালের ফারিয়া, ইয়াসিন, আব্দুল্লাহ ও ওদের মতো হাজারও সম্ভাবনাময় শিশু যারা আপন উৎকর্ষতায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতো অন্যান্য উচ্চতায়, তারা এখন শুধুমাত্র একটি পরিসংখ্যান। বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে ২০২৩ বলছে - প্রতিদিন গড়ে ৫২ জন মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়, যাদের মধ্যে প্রায় ৪০ জনই শিশু। অথচ এই অকালমৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য, যদি আমরা সচেতন হই এবং কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারি।
১৯৫৯ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ এবং ১৯৮৯ সালে শিশু অধিকার কনভেনশন (CRC) গৃহীত হওয়ার প্রেক্ষাপটে প্রতিবছর ২০ নভেম্বর বিশ্ব শিশু দিবস পালিত হয় । বিশ্বব্যাপী শিশুদের অধিকার, কল্যাণ ও সুরক্ষা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এই দিনটিকে গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয়। বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, যাতে শিশুদের নিরাপদ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ গঠনে সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব আরও জোরালোভাবে প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশ সরকার শিশু অধিকার সুরক্ষা এবং বিকাশে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে প্রশ্ন থেকে যায় শিশু অধিকার নিয়ে বিশ্বব্যাপী এত আলোচনা ও কর্মসূচি থাকলেও তা কি পর্যাপ্ত? সমতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করে শিশুর বিকাশের অনুকূল পরিবেশ তৈরী করতে গেলে প্রথমেই সুস্থ ও নিরাপদ পরিবেশ শিশুর বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে হবে।
তবে আশার কথা হলো সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ইতোমধ্যে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও ‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশুযত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং সাঁতার সুবিধা প্রকল্প’বাস্তবায়ন করছে। একইভাবে, পানিতে ডুবা প্রতিরোধে জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ণের মাধ্যমে এই কাজকে একটি জাতীয় ইস্যু হিসেবে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) ২০০৫ সাল থেকে শিশুদের পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধে গবেষণা করছে এবং নানা অংশীজনকে সম্পৃক্ত করছে। তাদের গবেষণায় প্রমাণিত- আঁচল (সমন্বিত শিশুযত্ন কেন্দ্র) কার্যক্রমে ১ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের নিরাপদ পরিবেশে রাখলে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঝুঁকি ৮২ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। একইভাবে, ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের স্থানীয়ভাবে সহজ পদ্ধতিতে জীবন রক্ষাকারী সাঁতার শেখানো হলে মৃত্যুর ঝুঁকি ৯৬ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পায়। এই কার্যক্রমগুলোকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈজ্ঞানিক ও উদ্ভাবনী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
সিআইপিআরবি যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউশন এবং প্রিন্সেস শার্লিন অফ মোনাকো ফাউন্ডেশন এর সহযোগিতায় ২০১৬ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত পটুয়াখালী এবং বরগুনা জেলায় পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রতিরোধ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা, প্রতিবন্ধকতা ও লার্নিং এর মাধ্যমে সিআইপিআরবি দেখেছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শিশুদের পানিতে ডুবা প্রতিরোধ কার্যক্রম বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। তাই এই কার্যক্রমগুলোকে কিভাবে আরো টেকসই ও ফলপ্রসূ করা যায়-তা নিয়ে গবেষণা করতে ২০২৫ থেকে 'নিরাপদে ভাসা প্রকল্প' বাস্তবায়ন করছে সিআইপিআরবি। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে প্রাসঙ্গিক বিষয়ের আলোকে পানিতে ডুবা প্রতিরোধ কার্যক্রমকে সফলভাবে বাস্তবায়ন করাই এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। প্রকল্পটির নানামূখী কার্যাবলীর মধ্যে রয়েছে- শিশুযত্ন কেন্দ্র (আঁচল) পরিচালনা, জীবনের জন্য সাঁতার কার্যক্রম (সুইমসেফ) বাস্তবায়ন এবং ফার্স্ট রেসপন্স প্রশিক্ষণ প্রদান। কার্যক্রমগুলো চালাতে প্রয়োজনীয় লোকবলের উপস্থিতি ধরে রাখা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সাথে তাল মিলিয়ে চলার শক্তি বৃদ্ধি করা- নিরাপদে ভাসা প্রকল্পের প্রধান কাজগুলোর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য।
নিরাপদে ভাসা প্রকল্পের দুটি কর্ম এলাকা তালতলী ও বাকেরগঞ্জ উপজেলায় বর্তমানে ১৫০ টি আঁচল ও ২৫ টি সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। আঁচল কেন্দ্রগুলোতে ১০০ জন প্রশিক্ষিত শিশু যত্নকারীর মাধ্যমে ১-৫ বছর বয়সী প্রায় ৩৮০০ শিশুকে নিরাপদ রাখতে ও তাদের শৈশবকালীন প্রারম্ভিক বিকাশ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উৎকর্ষমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। সুইমসেফ কার্যক্রমের অধীনে এ বছর পরিচালিত হচ্ছে ২৫ টি কেন্দ্র । ৫০ জন কমিউনিটি সাঁতার প্রশিক্ষক ৬-১০ বছর বয়সী ৫০০০ হাজার শিশুকে জীবন রক্ষায় সাঁতার কৌশল শেখাচ্ছেন। কমিউনিটি থেকে নির্বাচিত এই শিশু যত্নকারী ও সাঁতার প্রশিক্ষকদেরকে ফার্স্ট রেসপন্স সেবা প্রদানেও দক্ষ করে তোলা হবে । এই দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে তারা বিভিন্ন ইনজুরিতে বিশেষ করে পানিতে ডুবা থেকে উদ্ধারের পর প্রয়োজনীয় প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দিতে পারবেন। এছাড়াও রয়েছে জনসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম যেমন- উঠান বৈঠক, অভিভাবক সভা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস উদযাপন ইত্যাদি এবং অংশীজনদের সম্পৃক্তকরণ কার্যক্রম যেমন-ভিলেজ ইনজুরি প্রিভেনশন কমিটি ও ইউনিয়ন ইনজুরি প্রিভেনশন কমিটি গঠন, মাসিক/ষান্মাসিক সভা পরিচালনাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে তাদের সম্পৃক্ত করা।
নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্পের লক্ষ্য অর্জিত হলে যে কোনো পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও জলবায়ু পরিবর্তনে শিশুদেরকে পানিতে ডুবার ঝুঁকি থেকে সুরক্ষিত রাখার কার্যকরী উপায় জানা ও বাধাহীনভাবে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। যা পানিতে ডুবা প্রতিরোধ বিষয়ক জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে সমৃদ্ধ ও বাস্তবমুখী করতেও সহায়ক হবে। শিশুদের নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানান সংস্থাটির কর্মকর্তাগণ।